শাইখুল হাদিস মুফতি মনসূরুল হক
মি‘রাজ আরবি উরুজ শব্দ থেকে নির্গত, যার অর্থ ঊর্ধ্বে গমন করা। আর মি‘রাজ শব্দের অর্থ ঊর্ধ্বে আরোহনের বাহন।
মি‘রাজের ঘটনা কখন সংঘটিত হয়েছিলো এ ব্যাপারে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে নির্ভর যোগ্য সূত্রে শুধু এতটুকুই পাওয়া যায় যে, মি‘রাজের ঘটনা হিজরতের এক বা দেড় বছর আগে সংঘটিত হয়েছিল।
কিন্তু মাস, দিন তারিখের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য কোন দলীল নেই। যদিও সাধারণ জনগণের মাঝে প্রসিদ্ধ হলো রজব মাসের ২৭ তম তারিখে সংঘটিত হয়েছিল। (আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়াহ ও শরহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়াহ খঃ৮ পৃঃ ১৮/১৯)
পরিভাষায় মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত রাত্রে ভ্রমণকে ইসরা ও সেখান থেকে সিদরাতুলমুনতাহা ও তদুর্ধ্ব পর্যন্ত ভ্রমণকে মি‘রাজ বলা হয়। ইসরা ও মি‘রাজের ঘটনা সম্পর্কে কুরআনে কারীমে ইরশাদ হচ্ছে-
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آَيَاتِنَا إِنَّه هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ
অর্থ: পবিত্র ওই মহান সত্ত্বা যিনি রাত্রি বেলায় তাঁর বান্দাকে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়েছেন, যার আশপাশকে আমি বরকতময় করেছি। এটা এজন্য যাতে আমি তাকে আমার নিদর্শনাবলী দেখাতে পারি। (সূরা বনী ইসরাইল আয়াত নং-১)
হাদিসের আলোকে মি‘রাজের সংক্ষিপ্ত ঘটনা
একদা রাতে রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত উম্মে হানী রা. এর ঘরে শুয়েছিলেন। রাসুলের অর্ধনিদ্রা অবস্থায় হজরত জিবরিল আ. অন্যান্য ফেরেশতাসহ অবতরণ করেন এবং হুযুর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে মসজিদে হারামে নিয়ে যান।
রাসুল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন হাতীমে কা’বায় ঘুমিয়ে পড়েন। হজরত জিবরিল ও মীকাঈল আ. নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জাগিয়ে যমযমের পাশে নিয়ে সীনা মুবারক বিদীর্ণ করে অন্তরাত্না বের করে যমযমের পানিতে ধুয়ে ইলম ও হিকমতে পরিপূর্ণ করে স্বর্ণের তশতরীতে রাখেন। অতঃপর পুনরায় বক্ষে স্থাপন করে দেন।
এরপর বোরাক নামক বাহনে করে হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে মসজিদে আকসা পর্যন্ত নিয়ে যান। অতঃপর সেখান থেকে আসমানে নিয়ে যান। প্রথম আসমানের কাছে গিয়ে জিবরীল আ. দরজা খোলার আবেদন জানান। ফেরেশতাগণ অভিবাদন জানিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বরণ করে নেন। এভাবে সপ্তম আসমান অতিক্রম করেন।
এসময়ে যথাক্রমে প্রথম আসমানে হযরত আদম আ., দ্বিতীয় আসমানে ইয়াহইয়া এবং ঈসা আ. তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসুফ আ. চতুর্থ আসমানে হযরত ইদরীস আ. পঞ্চম আসমানে হযরত হারুন আ. ষষ্ঠ আসমানে হযরত মূসা আ. সপ্তম আসমানে হযরত ইবরাহীম আ. এর সাথে সাক্ষাৎ হয়।
সবাই হুযুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অভ্যর্থনা জানান। সপ্তমাকাশ থেকে রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রফরফ নামক বাহনের মাধ্যমে সিদরাতুল মুনতাহা ও আরশে আজীমে গমণ করেন।
সেখানে অনেক আশ্চর্য ও বিস্ময়কর জিনিস প্রত্যক্ষ করেন। জান্নাত জাহান্নাম স্বচোখে দেখেন। পরিশেষে আল্লাহর দীদার ও কালাম লাভে ধন্য হন। এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে উপঢৌকন স্বরুপ পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাযের বিধান নিয়ে জমিনের দিকে প্রত্যার্বতন করেন।
হজরতের সব বয়ান ও কিতাবসহ আলেমদের বয়ান একসঙ্গে পেতে ইনস্টল করুন ইসলামী যিন্দেগী অ্যাপ
পথিমধ্যে হযরত মূসা আ. এর পরামর্শক্রমে কয়েকবার আল্লাহর কাছে গিয়ে নামাযের সংখ্যা কমানোর আবেদন জানান। অবশেষে পাঁচ ওয়াক্ত নামায (যাতে পঞ্চাশ ওয়াক্তের সওয়াব পাওয়া যাবে।) এর বিধান নিয়ে বাইতুল মুকাদ্দাস হয়ে মক্কায় ফিরে আসেন। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৩৮৮৭, ফাতহুলবারী ৭/২৫০,২৫৯, শরহে যুরকানী ৮/৪২, সীরাতে ইবনে হিশাম ২/১০, খাসায়েসুল কুবরা ১/১৫২
রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মি‘রাজ স্বশরীরে হয়েছিল, স্বপ্ন যোগে নয়
হুযুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মি‘রাজ জাগ্রত অবস্থায় স্বশরীরে হয়েছিল। তবে এছাড়া অন্য সময় হুযুরের স্বাপ্নিক মি‘রাজও হয়েছে। যার বর্ণনা হাদীস শরীফে এসেছে।
তথাপি কতিপয় লোক রাসুলের স্বশরীরের মি‘রাজকে কিছু ভ্রান্ত যুক্তি তর্কের মাধ্যমে অস্বীকার করার চেষ্টা করে। যা আদৌ ঠিক নয়। মূলত প্রসিদ্ধ মি‘রাজ স্বশরীরে হওয়ার ব্যাপারে কুরআনের আয়াত ও অনেক সহীহ হাদীস সহ বিভিন্ন দলিল রয়েছে।
তন্মধ্যে: ১. রুহানী মি‘রাজ কোনো আশ্চর্যের বিষয় নয়। বরং শারীরিক মি‘রাজই আশ্চর্যের বিষয়। এ দিকে ইংগিত করে আল্লাহ তা‘আলা উক্ত ঘটনার বর্ণনার শুরু করেছেন ‘সুবহানা’ শব্দ দিয়ে। তাছাড়া উক্ত আয়াতে ‘বি আবদিহী’ (অর্থাৎ, নিজের বান্দাকে) শব্দ রয়েছে। যা মি‘রাজ স্বশরীরে হওয়ার প্রমাণ বহন করে।
২. মি‘রাজ যদি স্বাপ্নিক হত তাহলে কেউ মুরতাদ হত না। কারণ স্বপ্নের কোনো কিছুকে কেউ অস্বীকার করে না।
৩. স্বশরীরে মি‘রাজ হওয়ার ব্যাপারে উম্মতের ইজমা রয়েছে। অতএব প্রসিদ্ধ মি‘রাজকে রুহানী বা স্বাপ্নিক বলে ব্যক্ত করার কোন অবকাশ নেই। (শরহে যুরকানী ৮/১৩৮)
মি‘রাজের শিক্ষা ও নসীহত
মি‘রাজের রাত্রে হুযুর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তাঁর উম্মতকে তিনটি জিনিস হাদিয়া দেওয়া হয়।
১. এই উম্মতের যে কোনো ব্যক্তি শিরকমুক্ত ঈমান নিয়ে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে চিরকাল আযাব দিবেন না। বরং তাকে একদিন অবশ্যই স্থায়ী জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং চিরকালের জন্য আরামে রাখবেন।
২. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। যে ব্যক্তি এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাযকে গুরুত্ব সহকারে আদায় করবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে পঞ্চাশ ওয়াক্তের সওয়াব দিবেন এবং নিজ দায়িত্বে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।
৩. সূরায়ে বাকারার শেষ আয়াতসমূহ, যার মধ্যে এউ উম্মতের প্রতি আল্লাহর পরিপূর্ণ রহমত মাগফিরাত দয়া ও অনুগ্রহ এবং কাফেরদের মুকাবেলায় সাহায্য ও সফলতার প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
তাছাড়া এ আয়াতসমূহ রাত্রে ঘুমানোর পূর্বে পড়লে তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ, তাহাজ্জুদের সওয়াব সহ সমস্ত বিপদ আপদ থেকে সে ব্যক্তি হিফাযতে থাকে।
সুতরাং প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জরুরি যে প্রাথমিক ভাবে এ তিনটি বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া এবং সঠিক ও সুন্দরভাবে তা হাসিল করা। সাথে সাথে দীনের অন্যান্য বিষয় অর্জনে সচেষ্ট হওয়া। বিশেষ করে দীনের যে পাঁচটি বিষয়ের ইলম অর্জনকে ফরযে আইন ঘোষনা করা হয়েছে তা অবশ্যই হাসিল করা। (সূরা বাকারাঃ ১৭৭, মুসলিম হাদীস নং ২৮৯)
শবে মি‘রাজ সম্পর্কিত বর্জনীয় বিষয়সমূহ
মি‘রাজের ঘটনা কোন্ বছর কোন্ মাসের কোন্ তারিখে এবং কোন্ রাতে হয়েছিল তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে অনেক মতভেদ রয়েছে এবং এ রাতটি পৃথিবীর ইতিহাসে একবারই এসেছে।
কিয়ামত পর্যন্ত আর কখনো মি‘রাজ সংঘটিত হবে না। সুতরাং কোন একটা তারিখ চূড়ান্ত মনে করা ও অন্যান্যগুলিকে ভুল বলা যাবে না। অর্থাৎ, পরিপূর্ণ নিশ্চয়তার সাথে এ কথা বলা যায় না যে কোন তারিখের কোন্ রাতে মি‘রাজের ঘটনা ঘটেছিল।
শবে মি‘রাজের ইবাদত বন্দেগীর ব্যাপারে কোন ফযীলত কুরআন হাদীসের মাধ্যমে প্রমাণিত নয়। সুতরাং সম্ভাব্য এই দিনে রোযা রাখা শবে কদরের মত এই রাতকে ফযীলতপূর্ণ মনে করা। রাতে ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল হওয়া। দিনে রোযা রাখা। সরকারিভাবে শবে মি‘রাজ পালনের উদ্যোগ নেওয়া। এই রাত্রকে উদ্দেশ্য করে মসজিদে ভিড় জমানো। মসজিদে আলোকসজ্জা করা। রাত্র জাগরণ করা। বাড়ি বাড়ি মিলাদ পড়া। প্রচার মাধ্যমে এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করা। পত্রপত্রিকায় বিশেষ নিবন্ধন প্র্রকাশ করা। শবে মি‘রাজ উপলক্ষে হালুয়া রুটির আয়োজন করা ইত্যাদি কোনটাই সহীহ নয়।
শবে মি‘রাজ যদি শবে বরাত বা শবে কদরের মত ফযীলতপূর্ণ কোন ইবাদতের রাত হত। তাহলে তার দিন তারিখ সংরক্ষিত থাকত। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এ ব্যাপারে হাদীস বর্ণিত হত। সাহাবায়ে কেরাম রা. এর কোন না কোন আমল পাওয়া যেত।
অথচ এ বিষয়ে কুরআন হাদীসে কোন আমলের কথা বর্ণিত নেই। অতএব বৎসরের অন্যান্য দিনের মত স্বাভাবিক ইবাদত বন্দেগী করাই আমাদের এ দিনের কর্তব্য। (সূরায়ে মায়েদা- আয়াত ৩, বুখারী-হাদীস ২৬৯৭, মুসলিম-হাদীস ৫৯৬)
রজব মাস শুরু হলেই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই দু‘আ খুব বেশী করে পড়তেনঃ اَللّٰهُمَّ بَارِكْ لَناَ فِيْ رَجَبَ وَشَعْبانَ وَبَلّغْنَا رَمَضَانْ
(আল্লাহুম্মা বারিকলানা ফী রজাবা ওয়া শা’বান ওয়া বাল্লিগনা রমাযান)
অর্থ: “হে আল্লাহ পাক আপনি আমাদের রজব ও শাবান মাসে বরকত দান করুন এবং রমযান শরীফ পর্যন্ত পৌঁছে দেন।” أخرجه الطبرانى فى الأوسط الحديث৩৯৩৯-
সূত্র: হযরতওয়ালা মুফতী মনসূরুল হক এর ‘আমালুস সুন্নাহ কিতাব থেকে
www.darsemansoor.com Islami Jindegi App
আরআর