বছরে দুটি ইসলাহি ও ইসলামি মজমা বসে থাকে বরিশালের কীর্তনখোলার তীরে চরমোনাই ময়দানে। আর চরমোনাই অঞ্চলটি এ মজমার জন্যই জনসমাজে সমাদৃত। তবে এ সমাগমের পাশাপাশি রয়েছে বিশাল দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যেগুলো লেখাপড়া ও আদর্শের দিক থেকে ইলমি অঙ্গনে প্রশংসিত।
একটি চরমোনাই জামিয়া রশিদিয়া আহছানাবাদ (কওমি) মাদরাসা, আরেকটি চরমোনাই কামিল মাদরাসা। আলিয়া মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন লাখো মানুষের আধ্যাত্মিকগুরু সৈয়দ মুহাম্মদ ইসহাক রহ. ও কওমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সৈয়দ ফজলুল করীম রহ.।
সময়ের পরিবর্তনে তারা আজ স্মৃতির পাতায়। আর তাদের রেখে যাওয়া প্রাণের প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বে আছেন তাদেরই রেখে যাওয়া উত্তরসূরিগণ।
চরমোনাই কামিল মাদরাসার বর্তমান প্রিন্সিপাল সৈয়দ মুসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী। যিনি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ‘র প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটির নায়েবে আমির ও বাংলাদেশ কুরআন শিক্ষাবোর্ডের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক।
পাশাপাশি গড়ে ওঠা তাদের ভিন্নধর্মী দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, লেখাপড়ার অবস্থা, বর্তমান শিক্ষাপরিক্রমায় প্রশ্নফাঁসের হিড়িক, বাংলাদেশে শিক্ষা সিলেবাসের গ্রহণযোগ্যতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে টিম আওয়ার ইসলাম মুখোমুখি হয়েছিলেন প্রাজ্ঞ এ শিক্ষাবিদের।
সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন নজরুল গবেষক কবি মহিউদ্দিন আকবর, কবি মুনীরুল ইসলাম ও আওয়ার ইসলামের প্রতিবেদক কাউসার লাবীব।
আমাদের উপমহাদেশে বিশেষ করে আমাদের দেশে আলিয়া ও কওমি মাদরাসার মধ্যে একটি নীরব দ্বন্দ্ব দেখতে পাই। কিন্তু আপনাদের এখানে বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন। আলিয়া ও কওমি মাদরাসার দুটি ভবন দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। একসঙ্গে ভিন্নধারার দুটি মাদরাসা পরিচালনা করতে আপনাদের ভিন্ন কোনো বেগ পোহাতে হয় কিনা?
আমাদের মাদরাসাদুটি এমনভাবে পরিচালনা করা হয়, যেখানে আপনি বুঝতে পারবেন না কে কওমি মাদরাসার ছাত্র কে আলিয়া মাদরাসার ছাত্র। আমার আব্বাজান বলেছিলেন, আমি যদি বেঁচে থাকি তাহলে একটি ভার্সিটি করে দেখিয়ে দিবো- ‘ভার্সিটি মানেই অনৈসলামিক ক্যাম্পাস নয়। কিন্তু মাওলা পাক তাকে এর আগেই তার কাছে নিয়ে গেছেন।
আমাদের এখানে যেহেতু ছাত্রদের আমরা গোড়া থেকেই ইসলামিক মনন দিয়ে গড়ে তুলি তাই তারা তাদের মাঝে আলিয়া কওমি নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব কাজ করে না।
বরং তারা এক পুকুরে গোসল করে, এক মসজিদে নামাজ পড়ে, এক দোকান থেকেই কেনাকাটা করে, একই মাঠে খেলাধুলা করে। এমনকি পোশাক-আশাকও একই ধরনের। আল্লাহ পাক আমাদের এ মাদারাসা দুটিকে মেছাল হিসেবে কবুল করেছেন।
ভিন্নরকম এ মাদরাসা দুটির প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাই।
আমার দাদাজান সৈয়দ এছহাক রহ. ১৯২৪সালে এখানে একটি মসজিদ গড়ে তুলেন। তখন শহর থেকে প্রায় ৫কিলোমিটার দূরের এ জায়গাটি ছিল একেবারে জঙ্গল। তেমন কোনো মানুষ এখানে বসবাস করতো না।
কেননা এটা ছিল অনুন্নত একটি চর। যা মোনাই নামে এক দরবেশ আবাদ করেছিলেন। তার নামেই এ অঞ্চলের নাম হয় চরমোনাই।
এরপর এখানে একটি মাদরাসা গড়ে তুলেন আমার দাদা এবং সেটি ১৯৫৪সালে সরকারের পক্ষ থেকে দাখেল মঞ্জুর হয়। এরপর পাকিস্তান আমলেই এখানে হাদিস বিভাগ যুক্ত হয়। বর্তমানে আমি এখানে নিযুক্ত হওয়ার পর তিন বিষয়ে অনার্স যুক্ত হয়।
আর আমার আব্বাজান সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. যখন দেখলেন সরকার ধীরে ধীরে আলিয়া মাদরাসা থেকে আরবি ও ইসলামিক বিষয়গুলো উঠিয়ে দিচ্ছে, তখন তিনি ১৯৮৩ সনে জামিয়া রশিদিয়া আহছানাবাদ নামে একটি কওমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
বর্তমানে এ কওমি মাদরাসায় দারুল হাদিসসহ ফেকাহ, তাফসির, হাদিস ও আরবি সাহিত্য বিভাগ রয়েছে।
শিক্ষা সিলেবাসে পরিবর্তন থাকলেও লেবাসে আমলে বিন্দু পরিমাণ কোনো পার্থক্য না রেখেই তিনি এ মাদরাসা দুটি পরিচালনা শুরু করেন। আজ অব্দি এভাবেই আলহামদুলিল্লাহ চলে আসছে।
মাদরাসাদুটির লেখাপড়া ও ছাত্র সংখ্যা কেমন?
আল্লাহর অশেষ রহমতে আমাদের উভয় মাদরাসার রেজাল্টই অত্যন্ত ভালো। কওমি মাদরাসা এ বছরও বেফাকে পুরো বাংলাদেশে ১৪তম হয়েছে।
আর আলিয়া মাদরাসায় এ বছরও অনেকগুলো ‘এপ্লাস’ এসেছে। এছাড়া আমরা লেখাপড়ায় অনন্য অবদান রাখায় রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে স্বর্ণপদকও পেয়েছি।
দু মাদরাসা মিলিয়ে আমাদের এখানে ছাত্র সংখ্যা প্রায় ৫হাজার। এর মধ্যে আলিয়ায় ২২শ থেকে ২৫শ, কওমিতে ২৫শ থেকে ২৮শ ছাত্র রয়েছে।
দেশব্যাপী সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশ্ন ফাঁসের এক হিড়িক পড়েছে। শিক্ষার্থীরাও এটিকে মোক্ষম সুযোগ বানিয়ে নিজের ফায়দা লুটছে। তো আপনার আলিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীরা কি এ প্রশ্নফাঁস থেকে পরীক্ষার সময় ফাঁয়দা নিয়েছে?
সত্যিকথা যদি বলি আমার এখানের শিক্ষার্থীরা এসব থেকে বিন্দু পরিমাণও কোনো ফায়দা নেয়নি। আসলে আপনাকে জানতে হবে কখন একজন শিক্ষার্থী প্রশ্নফাঁস থেকে ফায়দা নেয়।
একজন শিক্ষার্থী তিনটি মূহুর্তে প্রশ্ন ফাঁস থেকে ফায়দা নেয়, এক. যখন সে ঠিক মতো লেখাপড়া না করে। দুই. লেখাপড়া ভাবেই করে, তবে যেহেতু এমন একটা সুযোগ এসেছে তাই একটু নজর দিয়ে আসে সেখানে। তিন. যদি আল্লাহর ভয় না থাকে।
https://www.facebook.com/newsourislam/videos/2050743175141546/
আপনি জানেন আমাদের এখানে লেখাপড়া খুবই মানসম্পন্ন তাই তাদের ফাঁস প্রশ্ন দেখতে হয় না। আর আমাদের এখানের ছাত্রদের গার্ড খুবই কড়া। তারা নেটে ঢুকে প্রশ্ন দেখার মতো কোনো সুযোগ এখানে পায় না। এর থেকে ফায়দাও নেয়ারও সুযোগ নেই।
সবশেষ আমাদের ছাত্রদের লেখাপড়ার আগে আমরা আখলাক শিক্ষা দিই, খোদা ভীতির দীক্ষা দিই। তাই তারা মহান স্রষ্টার ভয়ে এসবের দিকে নজর দেয় না।
প্রশ্নফাঁস রোধে সরকার ও জনগণ কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে?
কয়েকটি পদক্ষেপে এগুলো প্রশ্নফাঁস অবশ্যই রোধ করা সম্ভব। এক. লেখাপড়ার মান বাড়ানো। দুই. দূর্নীতি কমানো। তিন. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের নজরদারী বাড়ানো।
চার. শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের ইসলামের দীক্ষায় দীক্ষিত করা এবং শিক্ষার্থীদের আল্লাহর ভয় শেখানো। আল্লাহকে ভয় করলে কখনো প্রশ্নফাঁসে কেউ জড়াতে পারবে না।
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাসিলেবাস নিয়ে আপনার কী অভিমত?
আমাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস এরকম,সেখানে শিক্ষার্থীরা ইসলামের কোনো ছোঁয়া পায় না বললেই চলে। আলিয়া শিক্ষাসিলেবাস হলো দুই নৌকায় পা দেওয়ার মতো। আর কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা উর্দূ ফার্সির জাতাকলে আরবি ও মাতৃভাষা থেকে অনেকদূরে।
তাই আজ বর্তমানে আমরা ভালো ইঞ্জিনিয়ার পেলে তার মধ্যে দীন পাই না। ভালো আলেম পেলে তার মধ্যে জাগতিক মানসম্পন্ন তেমন জ্ঞান দেখতে পাই না। আর আলিয়ার মানহীন সিলেবাস শিক্ষার্থীদের করে তুলছে সমাজের কাছে বোঝা।
এসব দুরবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে এসে মানসম্পন্ন যুগোপযুগী সিলেবাস প্রণয়ন করে যোগ্য ও মেধাবী প্রজন্ম গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন।
আমাদের সময় দেয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
আপনাদেরও অনেক ধন্যবাদ।
আরও পড়ুন: নির্বাচনের ট্রামকার্ড ইসলামি দল: টানছে উভয় জোটই, ২ দুই সিটিতে নির্বাচন করবেন ৫ আলেম
আরআর