জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া। প্রায় একশতক পূর্বে হিন্দুস্তানের এক বুযুর্গ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এ প্রতিষ্ঠানটি।উদ্দেশ্য ছিল বাতিল ফেরাকাকে রুখে দাড়াতে এ জামিয়া হবে অপ্রতিরুদ্ধ এক দূর্গ।
হিন্দুস্তানি ওই বুযুর্গের আশা প্রত্যাশা আল্লাহ কবুল করেছেন। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ মাইলে আজ সত্যিই বাতিল রুখে দেওয়ার এক দূর্গের নাম জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া।
ঐতিহ্যবাহী এ জামিয়ার হাল ধরেছেন এ পর্যন্ত অনেক ওলি আল্লাহ, বুযুর্গ ও শায়েখ।স ময়ের ব্যবধানে তারা সায় দিয়েছেন দয়ালু স্রষ্টার ভালোবাসা মিশ্রিত আহ্বানে। চলে গেছেন পরলৌকিক জগতে প্রভুর কৃপায় ভাসতে। কিন্তু তাদের স্থালাভিসিক্ত করে গেছেন তাদেরই হাতে গড়া কিছু যোগ্য ব্যক্তিকে।
এরই ধারাবাহিকতায় আজকের জামিয়ার হাল ধরেছেন বিশিষ্ট লেখক, গবেষক, শায়খুল হাদিস, পীরে কামেল আল্লামা মুফতি মুবারকুল্লাহ। তিনি তার হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে দিনদিন ভিন্ন মাত্রা যোগ করছেন প্রাণের এ প্রতিষ্ঠানে।
তার যোগ্যতা, সরলতা ও মহানুভবতা তাকে শ্রদ্ধার পাত্র বানিয়ে তুলেছেন জামিয়ার প্রতিটি অনু-পরমানুর কাছে।
সময়ের যোগ্য এই সন্তান কিছুদিন আগে তার জীবনের নানাগল্পসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন আাওয়ার ইসলামের সঙ্গে। কথা বলেছেন জামিয়ার ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়েও। আওয়ার ইসলাম পাঠকের জন্য তার সাক্ষাতকারটি তুলে ধরছি।
সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন আওয়ার ইসলাম প্রতিবেদক কাউসার লাবীব।
বাড়ির আঙ্গিনা থেকে যেভাবে তিনি শিক্ষাঙ্গনের প্রশস্ত ময়দানে
আমি প্রথমে গ্রামের স্কুলে প্রাইমারী স্কুলে পড়ি। এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া মালিহাতা মাদরাসায় শরহে জামি পর্যন্ত পড়ি। এরপর ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়ায় শরহে বেকায়ায় ভর্তি হয়ে দাওরা পর্যন্ত পড়ি।
এরপর রমজানে মিরপুর জামিয়া হুসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ মাদরাসায় শায়েখ শামসুদ্দীন কাসেমী রহ. এর কাছে তাফসির পড়ি। রমজানের পর আমি ভর্তি আল-জামিয়া আল- ইসলামিয়া জমিরিয়া কাসেমুল উলুম পটিয়া মাদরাসায় ইফতা পড়ি।এরপরপরই আমার শিক্ষকজীবনে পদার্পণ।
তবে এর মাঝ দিয়ে সরকার যখন আলিয়া মাদরাসার দাখিলকে মেট্টিকের মান দেয়, তখন আমি আলিয়া থেকে দাখিল দিই এবং পর্যায়ক্রমে ধামতি ইসলামিয়া কামিল মাদরাসা থেকে ১৯৯১ সালে কামিল পাশ করি।
জ্ঞানের এ দীপ যখন থেকে আলো বিলাচ্ছেন জ্ঞানঘরে
আমার শিক্ষক জীবন শুরু হয় জামিয়া ইসলামিয়া ইউনিছিয়া থেকে। এটা প্রায় ৩৪ বছর আগের কথা। এরপর ধীরে ধীরে এদারার সহকারী সম্পাদক ও জামিয়ার নায়েবে মুফতি পদোন্নতি হয় আমার।
বর্তমানে জামিয়া ইউনুছিয়ার প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করছি। সঙ্গে বেশ কয়েকটি মাদরাসা পরিচালনার দায়িত্বে আছি।
যার হাতে প্রতিষ্ঠিত সত্যের এক দূর্গের এবং সে দূর্গের পরতে পরতে মিশে আছে যাদের মেধা, শ্রম ও ঘাম
এই জামিয়া ইউনুছিয়ার নাম নিলেই যাদের নাম সঙ্গে নিতে হয় তাদের মধ্যে অন্যতম আল্লামা ফখরে বাঙ্গাল তাজুল ইসলাম, বড় হুজুর আল্লামা সিরাজুল ইসলাম ও আমার মুরব্বি মুফতি নুরুল্লাহ রহ.। আর যার নামে এ মার্কায শায়েখ ইউনুছ রহ., তিনি তো হয়ে আছেন চির উজ্জ্বল।
হযরত ইউনুছ রহ. স্বপ্নের মাধ্যমে রাসুল সা. এর নির্দেশ পেয়ে কাদিয়ানি ফেতনায় ভরপুর এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে কাদিয়ানিদের সঙ্গে বহস করেন ও তাদের পরাজিত করেন। সঙ্গে কাদিয়ানি হয়ে যাওয়া মুসলমানদের নতুন করে কালিমা পড়িয়ে মুসলমান বানান।
এর কয়েক বছর পর তিনি মনস্থ করেন নিজ দেশ হিন্দুস্তানে ফিরে যেতে। কিন্তু এলাকার মানুষ তিনি চলে গেলে কাদিয়ানি ফেতনা আবার মাথা চাড়া দেওয়ার কথাটি জানান। তখন তিনি সাধারণ মানুষের ঈমানকে হেফাজতের মাধ্যম হিসেবে এ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
আলহামদুলিল্লাহ, এ যাবত জামিয়া ইউনুছিয়া সর্বপ্রকার বাতিলের বিরুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। সেটা হোক কাদিয়ানি ফেতনা বা মওদুদি ফেতনা।
বক্তৃতার ময়দানে শায়েখ মুবারকুল্লাহকে যেভাবে পেয়েছে ইসলাম প্রেমি জনতা
আমি যে মাদরাসায় পড়েছি সেখানে সাপ্তাহিক বক্তৃতা সেমিনার হতো। বলা যায় ওই সেমিনারই আমার ওয়াজ মাহফিলের হাতেখড়ি। এরপর ফারেগ হয়ে ধীরে ধীরে আমি বক্তাজীবনে পা বাড়াই এবং মানুষও আমাকে খুব মহব্বতের সঙ্গে গ্রহণ করেন।
পাশাপাশি আমি ওয়াজ মাহফিল করে থাকি কারণ হলো, এর মাধ্যমে ইসলামের কথা হাজার হাজার মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলেম ওলামায়ে কেরামের সঙ্গে ভালো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়।
তার কলমের নিব যার প্রেরণায় হয়েছিল শাণিত
যার অনুপ্রেরণায় আমার কলম হয়েছে শাণিত তিনি হলেন মুফতি নুরুল্লাহ রহ.। তিনি আমাদের বলতেন ‘অন্তত তালিমুল ইসলামের তরজমা করে বই লেখা শুরু করো। সাহস সঞ্চয় করো।
তার এসব অনুপ্রেরণা থেকে আমি ‘হালতে জাহান্নাম’ বইয়ের বাংলা তরজমা করি এবং এটা জামিয়ার দফতরে বড় হুজুর ও মুফতি সাহেবকে শোনাই। এতে তারা অত্যন্ত খুশি হন, সঙ্গে আমার জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করেন।
তারা মাঠে ময়দানে গিয়েও বলতেন, ‘আমাদের মাদরাসার লেখালেখির একটা অভাব ছিল, মুফতি মোবারকুল্লাহ সেটা পূরণ করেছে’।
জামিয়ার দুইজন প্রাণপুরুষ ও তাদের বাংলা চর্চা
হযরত মুফতি নুরুল্লাহ রহ. স্কুলে ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে তারপর মাদরাসায় ভর্তি হন এবং বড়হুজুর রহ. আলিয়া মাদরাসায় ফাজিল পরীক্ষা দিয়ে তারপর লেখাপড়া করতে দেওবন্দ যান।
তারা যেহেতু ছোটবেলা থেকেই বাংলা ভাষার দীক্ষা নিয়েছেন, তাই তারা বাংলা ভাষাকে খুব মহব্বত করতেন। তারা নিজেরাও বাংলা ভাষায় কয়েকটি বই লিখেছেন। তারা চাইতেন দীনের নাবিকরা বাংলা ভাষায় দক্ষতা অর্জন করুক।
শায়েখ মুবারকুল্লাহর কলম-কালি আমাদের উপহার দিয়েছে যে অনন্য খেদমত
এ পর্যন্ত আমার ৬০টি কিতাব বাজারে এসেছে। আরো কিছু কিতাব বাজারে আসার অপেক্ষায় আছে। আমার এ কিতাবগুলোর মাঝে সবচেয়ে আলোচিত বলা যায় ফতোয়ায়ে জামিয়া ইউনুছিয়া।
এছাড়া মহব্বতে রাসুল, এসো ওয়াজ শিখি, কুরআন আপনাকে কী বলে? কুরআন হাদিসের আলোকে মাসায়েলে আমাল, ইসলাহুল ওলামা, মওদুদিবাদ একটি ভ্রান্ত মতবাদ ইত্যাদি বইগুলো বেশ পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে।
পাশাপাশি পটিয়ায় পড়াকালীন শিশুদের জন্য লেখা ‘হায়রাতুল ফেকাহ’র অনুবাদ ‘আজব হলেও গুজব নয়’ বইটি এ পর্যন্ত ৫ এডিসন শেষ হয়েছে। এখন অবশ্য বইটি আর বাজারে নেই।
মাতৃভাষা লালনে এক ভাষাপ্রেমির কিছু অতুলনীয় উদ্যোগ
আমরা যখন লেখাপড়া করতাম তখন বাংলা চর্চাটা সহজ ছিল না।অনেক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যদিয়ে আমরা তা লালন করেছি। নিজের উদ্যোগে নিজের মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করেছি।
তাই তারা যদি বাংলা ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে চায় তাহলে নিজ উদ্যোগেও এগুতে পারে।
তবে ছাত্রদের জন্য জামিয়ায় নিয়োগ হওয়ার পর থেকেই বাংলা ভাষা শিক্ষার বিভিন্ন মাধ্যম তৈরি করার চেষ্টা করছি। যেমন, আমি এদারার দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা, অংক, ইংরেজি অন্তর্ভূক্ত করি।
এরপর বেফাককে অনুরোধ করে ১০শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা, অংক, ইংরেজিকে অন্তর্ভূক্ত করি।এভাবে বিভিন্নভাবে আমি তাদের মাতৃভাষায় প্রাজ্ঞ করার চেষ্টায় ব্যপৃত।
যেভাবে গড়ে উঠতে পারে ইসলামিক মিডিয়ার নির্মল ভূবন
আমি মনেকরি বাংলা ভাষার চর্চা ওলামায়ে কেরামের মাঝে এখনো তেমনভাবে হয়ে উঠেনি। তাই আমরা মিডিয়ায় কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারছি না। তেমন মিডিয়াও গড়ে তুলতে পারছি না।
এছাড়া আমাদের জানার খুবই অভাব। আমরা শুয়ে বসে সময় কাটাতে খুব পছন্দ করি। ঘরের কোণায় বসে থাকাকে অনেক কিছু ভাবি, তাই বহির্বিশ্বের অনেক বিষয় থেকে আমরা দূরে।
ইহুদি, খৃস্টানদের চক্রান্তের কথা আমরা তেমন ভাবি না। তাই মিডিয়ার গুরুত্বও বুঝি না।মানসম্পন্ন মিডিয়া গড়েও তুলি না। পাশাপাশি অর্থনৈতিক দৈন্যতার বিষয়টি তো রয়েছেই।
তবে আমি আশাকরি আমাদের মুরব্বিগণ যদি সচেতন দৃষ্টিতে যত্নশীল হয়ে মিডিয়ার অভাবে ঘুঁচাতে এগিয়ে আসে তাহলে অন্যান্য জায়গার মতো মিডিয়ায়ও আমাদের সফলতা বয়ে আসবে।
মুসলিমরা না থাকলে আমরা বাঁচতাম না: হিন্দু সাধু
আরআর