আওয়ার ইসলাম: আলেক্সান্ডার কোগানকে অব্যাহতি দেওয়ার আগ পর্যন্ত নিবিড়ভাবে তার সঙ্গে কাজ করেছে ফেসবুক। কোগানের বিশ্ববিদ্যালয় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষককে ৫৭ বিলিয়ন ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের তথ্য দিয়েছিল ফেসবুক। সেখান থেকেই গ্রাহকদের তথ্য নিয়ে ২০১৫ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
ফেসবুকের দুজন কর্মীও যুক্ত ছিলেন গবেষণার কাজে। কেমব্রিজ, হার্ভাড, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরাও ছিলেন দলে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য জানা যায়।
ফেসবুক তথ্য বেহাত নিয়ে যে আলোচনার মূলে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. কোগানের একটি অ্যাপ, যার নাম ছিল ‘দিস ইজ ইওর ডিজিটাল লাইফ’। সরাসরি ২ লাখ ৭০ হাজার ফেসবুক ব্যবহারকারী ওই অ্যাপের ব্যবহারকারী হলেও অ্যাপটি ব্যবহারকারীদের বন্ধুতালিকায় থাকা ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ করেছিল।
এভাবে সংগৃহীত প্রায় ৫ কোটি ব্যবহারকারীর তথ্য থেকে তাদের মানসিক অবস্থার চিত্র তৈরি করা হয়েছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে নির্বাচনি প্রচারণায় ভুয়া খবর ছড়িয়ে জনমত প্রভাবিত করতে ওইসব তথ্য ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীতে কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকার ক্রিস্টোফার উইলি প্রতিষ্ঠানটির এই তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে সবকিছু ফাঁস করে দেন।
কেমব্রিজের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘এটা ক্রেমব্রিজের স্পেকট্রের ল্যাব ও ফেসবুকের মাধ্যমে এই গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।’ ফেসবুক অবশ্য এই নিয়ে মন্তব্য করেনি।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টো সেন্টার ফর ডিজিটাল জার্নালিজম এর গবেষণা পরিচালক জোনাথন আলব্রাইট বলন, ফেসবুকের এমন তথ্য প্রকাশ করাটা স্বাভাবিক নয়। এটা অবশ্যই আলক্সজান্ডার কোগানের সঙ্গে ফেসবুকের একটি সমঝোতা ছিল।
তবে ফেসবুকের মুখপাত্র ক্রিস্টিন চেনের দাবি, তারা এই তথ্যের গুরুত্ব বুঝতে ভুল করেছে। ২০১৩ সালে কোগানের সঙ্গে তথ্য শেয়ারের ব্যাপারে তিনি বলেন, তাদেরকে শুধু সংখ্যা বলা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য কতজন এই সময়ে বন্ধুত্ব করেছে শুধু সেই সংখ্যা প্রকাশ করা হয়েছিল।কোনও ব্যক্তিগত তথ্য সেখানে ছিল না।’
একটা সময় কোগানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয় ফেসবুকের। কোগান চেন বলেন, ‘আমরা যখন জানতে পারি তিনি ফেসবুকের শর্ত ভেঙে অ্যাড ডেভেলপ করছেন তখন তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ইতি টানি। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্রথম এই তথ্য বেহাতের কথা জানতে পারে ফেসবুক।’
সেসময় ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে এই বিষয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়। এরপর ২০১৬ সালে কোগানের সঙ্গে সম্পর্কের ইতি টানে ফেসবুক।
১৬ মার্চ শুক্রবার অবজারভারের প্রতিবেদনে বলা হয়, কোগান ওই ৫ কোটি মার্কিনির তথ্য অবৈধভাবে ব্যবহার করেছেন। ফেসবুক এক বিবৃতি দিয়ে কোগানের ব্যাপারে জানায়, ‘তিনি ফেসবুকের সঙ্গে মিথ্যাচার করেছেন।’
মঙ্গলবার আরেকটি বিবৃতিতে ফেসবুক জানায়, পুরো প্রতিষ্ঠান প্রতারিত বোধ করছে এবং তারা ক্ষুব্ধ। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গও কোগানের এই কাজকে ‘বিশ্বাসভঙ্গ’ বলে উল্লেখ করেছেন।
তবে কোগানের সঙ্গে কিভাবে তাদের এত ভালো সম্পর্ক তৈরি হলো। এবং এতদিন পর্যন্ত তাদের দূরত্বের কথা চাপা থাকলো সেই বিষয়ে কোনও ব্যাখা দেয়নি ফেসবুক।
বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে কোগান আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছেন, ‘ফেসবুক ও কেমব্রিজ অ্যানালিটিকিয়া দুই পক্ষই আমাকে বলির পাঠা বানাচ্ছে।’
ফেসবুকের এই কাজটি শুরু করে কোগানের প্রতিষ্ঠা করা গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল সাইন্স রিসার্চ কেমব্রিজের আরেকজন গবেষক জোসেফ চ্যান্সেলরকে নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেছিলেন তিনি।
চ্যান্সেলর বর্তমানে ফেসবুকে কর্মরত। ২০১৫ সালের জুন থেকে আগস্ট মাসে জিএসআর ফেসবুকের ২ লাখ ৭০ হাজার গ্রাহককে প্রশ্ন করে। তাদের বন্ধুদের কাছ থকেও তথ্য নেয়। সবমিলে পাঁচ কোটির বেশি গ্রাহকেরও তথ্য চলে আসে তাদের কাছে। ফেসবুকের দাবি এখানেই কোগান শর্তভঙ্গ করেছেন। তাদের বলা হয়েছিল যে, শুধুমাত্র গবেষণার কাজে তথ্যগুলো ব্যবহার করার কথা ছিল।
এক ইমেইল বার্তায় কোগান বলেন, ২০১৩ সালে তিনি গবেষণার কাজেই ফেসবুক অ্যাপটি তৈরি করেছিলেন। সেবছরই জিএসআর প্রতিষ্ঠার পর তিনি বেশ কয়েকটি গবেষণা করেন। জিএসআর প্রতিষ্ঠার পর অ্যাপসটি এর আওতায় এনে নাম ও লোগো পরিবর্তন করেন তিনি। তখন আর সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হিসেবে থাকে না। তিনি বলেন, ‘আমরা স্পষ্ট করে বলেছি যে এটা বাণিজ্যিক কাজেই ব্যবহৃত হবে।
শুধু শিক্ষা বা গবেষণার কথা আমরা কখনও বলিনি। আমরা গ্রাহকদের কাছে স্পষ্ট করে অনুমতি চেয়েছি যে তাদের তথ্যগুলো আমরা ব্যবহার করবো। প্রয়োজনে বিক্রি ও লাইসেন্সও করে রাখবো। কিন্তু ফেসবুক এই বিষয়ে কিছুই বলছে না।’
শুধু কোগানই ফেসবুকের সমালোচনা করছেন না। আলব্রাইটও বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয় ফেসবুকই বেশি তথ্য জানিয়েছে। তারা এমন ব্যবস্থা কেন করলো যার মাধ্যম গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য জানা যায়।’
তথ্য ফাঁসকারী ক্রিস্টোফার উইলি অবজারভারকে বলেন, ‘ফেসবুক জানতো যে কোগানের অ্যাপে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাতেই এটা জানান দেয়। কোগান তখন দাবি করেছিল এটা গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হবে। ফেসবুক তখন তাতে সায় দেয়।’
তবে কেমব্রিজ থেকে পাঠানো ইমেইলে কোগান এসব দাবিকে ‘অতিরঞ্জিত’ বলেছেন। তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে ফেসবুকের সঙ্গে কোনও আলাপ হয়নি। আমরা কখনোই দাবি করিনি যে এটা শিক্ষা বা গবেষণা কাজে ব্যবহৃত হবে। কারণ আমাদের তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কোনও সংযোগ নেই।’
২০১৫ সালের কোগান ও ফেসবুকের গবেষকদের ওই রিপোর্টের তথ্যগুলোও ফেষবুক অ্যাপের মাধ্যমে নেওয়া হছিল। ফেসবুক ৫৭ বিলিয়ন বন্ধুত্বের তথ্য দিয়েছিল আর সেখান থেকে ছোট ছোট তথ্য খুঁজে বের করেছিল কেমব্রিজের গবেষকরা। তাদের তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে জড়িত ছিল না ফেসবুক।
গবেষকদের দাবি, অনুমতি নিয়েই গ্রাহকদের তথ্য নেওয়া হয় এখাবে কোনও প্রতারণা করা হয়নি। ২০১৫ সালে আগস্টে সেই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেপ্টেম্বরেই জিএসআর ছেড়ে চলে যান চ্যান্সেলর। নভেম্বরে যোগ দেন ফেসবুকে। ফেসবুক বা চ্যান্সেলর কেউই এই বিষয়ে মন্তব্য করেননি।