মুহসিন আল কাদির: ফেসবুকে হঠাৎ করেই আলোচনায় এসেছে ইসলামী ঐক্যজোটের সাবেক চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ. এর ৩০ বছর পুরনো একটি নির্বাচনী পোস্টার।
যা রীতিমতো ফেসবুক ইউজারদের মধ্যে চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও আলোচনা এখন কিছুটা স্থিমিত তবে গেল সপ্তায় এ নিয়ে তুমুল হৈচৈ হয়ে গেল।
বড়রা বলে থাকেন, ফেসুবক একটা বিতর্কের জায়গা এবং বিতর্কটা এখানে স্বাভাবিকে রূপ নিয়েছে। খুব মামুলি বিষয়েই চলে দীর্ঘ আলোচনা। অনেক সময় বিষয়ের গভীরতা বুঝতে না পেরে অযথাই বিতর্কে জড়ান কেউ কেউ। চলতে থাকে পক্ষে বিপক্ষে একক বা গ্রুপভিত্তিক সমালোচনা।
কোন কেনটি শেষ হয় ইস্যুর বদলে। আবার কোনটা শেষ হয় এক পক্ষ দুর্বল হয়ে পড়লে।
তেমনি দীর্ঘ দিন ধরে ফেসবুক জগতে চলতে থাকে ‘জিহাদ নির্বাচন’ বিতর্ক। সাম্প্রতি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশে’র নায়েবে আমির ও চরমোনাই জামিয়া রশিদিয়া আহসানাাবদ মাদরাসার শায়খুল হাদিস মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করিমের এক বক্তব্য ঘিরে তর্কের সূত্রপাত। সেটা গড়াল মুফতি আমিনী রহ. এর ৩০ বছর আগের একটি পোস্টার পর্যন্ত।
মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করিমের চরমোনাইতে দেয়া এক বক্তব্যে ভোটের রাজনীতিকে জিহাদের সাথে তুলনা করলে এ বিতর্ক দেখা দেয়। ইউটিউব ও ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ৪ মিনিট ২৪ সেকেন্ডের বক্তব্যে তিনি প্রথমে বর্তমান সময়ে সশস্ত্র বিপ্লব কেন সম্ভব নয় সে বিষয়ে সংক্ষিপ্ত ব্যাখা দেন।
এর পর তার বাবা চরমোনাইয়ের মরহুম পীর সৈয়দ ফজলুল করিম রহ.এর উদ্ধৃতি দিয়ে তাকে বলতে দেখা যায়, ‘আমরা নির্বাচন করি না আমরা জিহাদ করি। এই জিহাদে যারা অংশ গ্রহণ করবে তারা মুজাহিদ। এতে যারা সময় দেবেন, অর্থ খরচ করবেন তাদের প্রতিটি কাজের বিনিময়ে সওয়াব লেখা হবে।
তবে এই মুজাহিদ হলো তারাই যারা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর হুকুমাত কায়েম করার জন্য সাধনা করবে, মুজাহাাদা করবে।
তার এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সমালোচনা ও বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন হাজারো মানুষ।
একদল বলছেন কথাটা যৌক্তিক, ইসলামি জিহাদের নাানা প্রকার ও প্রেক্ষাপট রয়েছে। নিজের নফসের সাথে মুজাহাদা করাকেও বড় জিহাদ বলা হয়েছে হাদিসের ভাষায়। জিহাদ শব্দকে অনেক সময় রুপক অর্থে ব্যবহর করে কোন কাজের ফজিলত বর্ণনা করা হয়। তার মানে এই নয় যে সে কাজই প্রকৃত জিহাদ বা ময়দানের জিহাদের সমান মর্যাদা রাখে।
আর বিপক্ষের লোকেরা এটা নিয়ে হাস্যরস করেছেন। উড়িয়ে দিয়েছেন মামুলি বিষয় বলে। তার ব্যাপারে অভিযোগ তুলেছেন, প্রকৃতি জিহাদ বিধানের অপব্যাখ্যা করারও।
আর এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতেই আলোচনা উঠে আসে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ব প্রথম তাওবার রাজনীতির ডাক দেয়া হজরত মাওলাানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর ১৯৮৬ সালের রাজনীতির ইশতেহার ও সে সময়ের নির্বাচনি পোস্টার।
জনসম্মুখে এনে দেখনোর চেষ্টা করা হয় যে, সুস্থ ও ইসলামি রাজনীতিকে বহু আগেই যুদ্ধের সমতূল্য বলা হয়েছে।
আলোচনায় আসে প্রচলিত নির্বাচনকে হাফেজ্জী হুজুর রহ.ও একই অর্থে নিয়েছিলেন। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আমীরে শরীয়ত হযরত হাফিজ্জি হুজুর বেতার ও টিভি ভাষণে বলেন,
“বিগত ১৯৮১ সালে ইসলামী হুকুমত কায়েমের নির্বাচনী জিহাদের ডাক, তাই এমন এক গণ-জোয়ার সৃষ্টি করল, যার ফলে সরকারী-সকল বিরোধী দলই ইসলামের সামনে নতজানু হতে বাধ্য হলো। আর সে নির্বাচনে এটাই ছিল বিরাট সাফল্য। মানব জাতির এ ঐতিহ্যগত দায়িত্ব পালনের মানসে পরবর্তী সাংগঠনিক রূপ পেল, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন।
বর্তমানে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আরেকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বস্তুত প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতি যোগ্য নেতৃত্ব বাছায়ের নির্ভরযোগ্য পন্থা নয়। একথা জানা ও বিশ্বাস করা সত্ত্বেও এ নির্বাচনে খেলাফত আন্দোলনের অংশ গ্রহণের কারণ দেশের সার্বিক সংকটময় পরিস্থিতি।
ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন সকল স্তরেই আজ এক দুর্বিসহ অনিশ্চয়তার সম্মুখীন। এ পরিস্থিতির হাত থেকে সার্বিক জাতীয় নিরাপত্তার উত্তরণের লক্ষ্যে সাময়িক বিকল্পরূপে আন্দোলন ও জিহাদের অংশ হিসাবেই খেলাফত আন্দোলন বর্তমানে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
সূত্র: হাফেজ্জী হুজুর রহ. রচনাসমগ্র, হাফেজ্জী হুজুর গবেষণা ফাউন্ডেশন, লালবাগ, ঢাকা (প্রকাশকাল: ২০১২), পৃ. ১২১
৮৬ পরবর্তী সময়ে বি বিড়িয়া-২ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেন মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ.। তার সেই নির্বাচনী পোস্টার ফেসবুকে ভাইরাল হয় কয়েক দিন আগে। কেউ একজন নিজ টাইমলাইনে প্রায় ৩০ বছর পুরনো সেই পোস্টারটি শেয়ার করলে মূহুর্তে তা ছড়িয়ে পড়ে।
পোস্টারটিতে লেখা আছে, ‘আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া-২ সরাইল এলাকা থেকে হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন মনোনীত প্রার্থী আলহাজ হজরত মাওলানা মুফতি ফজলুল হক আমিনীকে বটগাছ মার্কায় ভোট দিয়ে খেলাফত প্রতিষ্ঠার জেহাদে শরীক হোন।
মুফতি আমিনী রহ.এর নির্বাচনী পোস্টার ভাইরার হওয়ার পর আগের বিতর্ক থেমে যায়। পোস্টারটি যেন জ্বলন্ত অঙ্গারে এক পশলা পানি ঠেলে দিয়েছে।
তবে পোস্টারটি কে বা কারা সবার আগে ফেসবুকে শেয়ার করেছে তা জানা যায়নি।
মুফতি ফজলুল হক আমিনী একজন ইসলামী প্রাজ্ঞ চিন্তাবিদ। মাদরাসা ও দীনি ময়দানে সরব থাকলেও রাজনীতির মাঠেও তাকে দেখা গেছে অনন্য ভূমিকায়। তিনি ছিলেন রাজনৈতিক দল ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান।
আশির দশকেখেলাফত আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনীতিতে আসেন। পরে তিনি খেলাফতে ইসলামী নামে আলাদা দল গড়েন এবং এর চেয়ারম্যান হন। তিনি খেলাফত আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর জাতামা।
২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন থেকে চারদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে সাংসদ নির্বাচিত হন। আন্দোলনের মাঠে থাকায় তার বিরুদ্ধে নানা সময়ে নানা অভিযোগ উত্থাপন করেছে প্রতিপক্ষরা। কিন্তু এসব এড়িয়ে একটি সংগ্রামী জীবন তিনি উপহার দিয়ে গেছেন ধর্মপ্রাণ মানুষকে।
মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ.কে শেষ জীবনে গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হয়। ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকার একটি হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন।
জাতির এই দুর্দিনে মুফতী আমিনীকে খুব মনে পড়ে
আরআর