সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
সমাজ যেন দিন দিন অনিরাপদ হয়ে ওঠছে। নতুন নতুন সমস্যা হাজির হচ্ছে আমাদের সামনে। তেমনি এক সমস্যা- হঠাৎ করে ভয়ংকর হয়ে ওঠছে ‘বখে যাওয়া কিশোর অপরাধীরা’।
অবশ্য হঠাৎ করে বলা ঠিক নয়। বলা যায়, এত দিন বিষয়টি জোরালোভাবে আলোচনায় আসেনি। সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এসব কিশোরদের তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের ওপর হামলে পড়া কিংবা অপহরণের ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে।
১২ মার্চ একটি সহযোগী দৈনিকে প্রকাশ, চট্টগ্রামে অপহরণে জড়িত থাকার অভিযোগে চার কিশোরকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এরমধ্যে দুজন স্কুলপড়ুয়া বাকি দুজন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। ১১ মার্চ রোববার নগরীর সদরঘাট থানা এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
চট্টগ্রাম সদরঘাট থানার ওসি নেজাম উদ্দিন গণমাধ্যমকে জানান, নগরীর সেন্ট্রাল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের কদমতলী শাখার সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র মেহেদী হাসান মিসকাতকে অপহরণ করা হয়। পরে তার পরিবারের কাছে ১০ লাখ টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করে তারা।
অপহৃত মেহেদীর পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর শেষ রাতে তিনজনকে এবং পরে তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী মাঈনকে দুপুরে মাদারবাড়ী এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত একাধিক খবরে জানা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায়ও নানা নামে গড়ে উঠেছে কিশোর অপরাধীদের বিশেষ গ্রুপ। এসব গ্রুপের সদস্যদের বেশিরভাগই টিনএজার বা ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী। সন্ত্রাসী কার্যকলাপের পাশাপাশি তারা মাদক ব্যবসার সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে। এদের প্রতিটি গ্রুপে একজন দলনেতা থাকে।
যে প্রভাবশালী ব্যক্তির ছেলে এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বেশি পারদর্শী তাকে দেওয়া হয় গ্রুপের নেতৃত্ব। এসব খবরে আমরা যা পাই তা একটা প্রজন্মের নষ্ট হয়ে যাওয়া একাংশের খণ্ড চিত্র। এ চিত্র যদি বদলানো না যায়, তা হলে ভবিষ্যতে সমাজ, রাষ্ট্র আমাদের বাসোপযোগী থাকবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, যে বয়সে নিজেকে গড়ে তোলা ও পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়ার কথা, সে বয়সে এমন অপরাধে জড়ানোর কারণ কী? আসলে কিশোর অপরাধের জন্য বহুবিধ কারণ দায়ী। কোনো নির্দিষ্ট কারণে অপরাধ সৃষ্টি হয় না।
এক্ষেত্রে স্বীকার করতেই হয়-ইন্টারনেট, ফেসবুক, টেলিভিশন, বিদেশি অনুষ্ঠান দেখে আমরা ভিনদেশি সংস্কৃতিকে গ্রহণ করছি। বিভিন্ন ভয়ংকর ভিডিও গেমস এবং অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্র কিশোরদের চিন্তা-চেতনায় প্রভাব ফেলছে। স্কুলগুলো অতিমাত্রার বাণিজ্যিক হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা পাচ্ছে না।
কিশোরদের জন্য কাউন্সেলিং জরুরি হলেও তাদের তা করানো হচ্ছে না। তরুণরা যত দ্রুত টেকনোলজি গ্রহণ করছে, তত দ্রুত মূল্যবোধ গ্রহণ করছে না। তাছাড়া টেকনোলজি ব্যবহারকালে তারা বুঝতে পারছে না দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে কতটুকু গ্রহণ করা উচিত। ফলে হিতে বিপরীত ঘটছে।
একাধিক বেসরকারি সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠনের জরিপে দেখা গেছে, অপরাধের সঙ্গে জড়িত শিশুদের ৯০ শতাংশ মাদকসেবী। ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইনের মতো মরণনেশায় আসক্ত তারা। আর এ নেশার খরচ জোগাতেই তারা যেন মরিয়া হয়ে ওঠে।
অপরাধ জগৎ থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে চাইলেও তাদের পক্ষে তা কঠিন হয়ে পড়ে। আর এ সুযোগটি গ্রহণ করে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। তারা শিশু-কিশোরদের দিয়ে খুন-রাহাজানির মতো বড় অপরাধ করিয়ে থাকে। কারণ অপ্রাপ্তবয়স্করা আইনগতভাবে কিছুটা ছাড় পেয়ে থাকে এবং পুলিশও তাদের তেমন একটা সন্দেহ করে না বা বলা যায়, নজরদারির মধ্যে রাখে না।
সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের সমাজ ও পরিবার এখন পার করছে এক অস্থির সময়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের অভাবে পরিবারের উপার্জনশীল ব্যক্তি বা অভিভাবকদের ওপর অস্বাভাবিক চাপ, সর্বোপরি বিশ্বায়নের ধাক্কায় পরিবারের বন্ধন, মূল্যবোধ সব কিছু যেন অস্বাভাবিক হয়ে পড়ছে।
এমতাবস্থায় ইচ্ছে করলেও পরিবারে সন্তানদের যথাযথ দেখাশোনা করা সম্ভব হয়ে ওঠছে না। দিন দিন বাড়ছে ব্রোকেন ফ্যামিলির সংখ্যা। এসব ফ্যামিলিতে বেড়ে ওঠা সন্তানরা পাচ্ছে না বাবা-মায়ের পরিচর্যা। এর একটি নীতিবাচক প্রভাব পড়ছে সন্তানদের সামাজিকীকরণে।
এ কথাও স্বীকার করতে হবে, অনেক সময় জীবিকা অর্জনের জন্য নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশু-কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধে। কিন্তু তাদের কি সুপথে ফেরানো সম্ভব নয়? সম্ভব। যদি সঠিক পদ্ধতি মেনে সেই চেষ্টা করা হয়।
এমন পরিস্থিতিতে সন্তানকে সুপথে ফেরাতে হলে অভিভাবকদের অবশ্যই ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার পাশাপাশি সচেতন হতে হবে। সন্তানের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কারণ চিহ্নিত করতে হবে।
এক্ষেত্রে মনে রাখা চাই, মানসিক অক্ষমতা বা দোষত্রুটির কারণেও কোনো শিশু-কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে। তবে প্রত্যাখ্যাত হওয়া, পারিবারিক দাম্পত্য-কলহ, পিতা-মাতার অতি উচ্চাশা, অতিরিক্ত আদর ও স্নেহ, অতিশাসন, অসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ, নিরাপত্তাবোধের অভাবেও তাদের মধ্যে কেউ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক কারণ যে আরও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন দারিদ্র্য, বিপর্যস্ত গৃহ, অস্বাস্থ্যকর বিদ্যালয় প্রথা। সেই সঙ্গে সামাজিক কারণ তো আছেই।
আসলে কি, কিশোর বয়সটাই বেপরোয়া ও আগ্রাসী একটা বয়স। কৌতূহলের বশে বা অজ্ঞাতসারেই কিশোর বয়সীদের পা পড়ে যেতে পারে অন্ধকার জগতে। তাই কিশোররা যেন অপরাধে জড়াতে না পারে এবং কেউ তাদের অসৎকাজে ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
গোটা সমাজেই শিশু-কিশোরদের সুস্থ-সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এজন্য সবার আগে পরিবার তথা বাবা-মাকে এগিয়ে আসতে হবে। সন্তানরা কী করে, কার সঙ্গে সময় কাটায়- এসব খেয়াল রাখতে হবে।
সন্তানদের অযৌক্তিক আবদার পূরণ করার আগে ভাবতে হবে। সন্তানদের ছোটবেলা থেকে যদি স্নেহ আদর দিয়ে ভালোভাবে শিশুর চরিত্র গঠনে ভূমিকা রাখা হয়, তাহলে শিশু-কিশোর অপরাধীর সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব।
লেখক : কবি, গবেষক ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম
[email protected]
২১.০৩.২০১৮