আসিফ আসলাম: পাকিস্তান কা মতলব কিয়া হ্যাঁয়? লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ; (পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হল, আল্লাহর কালিমা উঁচু করা) ১৯৪৭ সালে এই স্লোগান শুনিয়ে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছিলেন, তখন ধর্মপ্রাণ, হক্কানি আলেম-ওলামা জান বাজি রেখে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিলেন।
কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ২৪ বছরের মাথায় বাঙালির ওপর পাকসেনাদের হত্যাযজ্ঞ ও বর্বরতা দেখে বুঝতে পারলেন যে মুসলিম রাষ্ট্রের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আলেমরা যার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন সেই জালেমদের মাধ্যমে তা কখনই প্রতিষ্ঠিত হবে না।
আর আল্লাহর কালিমা জিন্দা করার সেই ‘মধুস্লোগান’ নিছক চাপাবাজি বৈ কিছুই ছিল না।
তখন জামায়াতে ইসলামী, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামের তথাকথিত কিছু নামধারীরা ছাড়া আলেমদের এক বিরাট অংশ মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সংগ্রামে যোগ দেয়। জালেম হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে হাতে অস্ত্র তুলে নেন আলেম সম্প্রদায়।
জনপ্রিয় লেখক, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ গ্রন্থে ১৩ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন ‘বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের কোনো বন্ধু ছিল না। তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল একদল দেশদ্রোহী। তারা ছিল কাউন্সিল মুসলিম লীগের খাজা খায়রুদ্দীন, জামায়াতে ইসলামীর গোলাম আযম প্রমুখ।
পাকিস্তানিদের সাহায্যের জন্য দেশদ্রোহীদের নিয়ে যে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়েছিল সেটি ছিল জামায়াতে ইসলামীরই সশস্ত্র দল। হানাদার বাহিনীর পদলেহী হিসেবে এরা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ওপর যে জুলুম ও অত্যাচার করেছে তার অন্য কোনো নজির ইতিহাসে নেই।
মুক্তিযুদ্ধে আলেম সমাজের ভূমিকা প্রসঙ্গে তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমান তার বিশ্লেষণে একটা পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। তিনি সেই সময়ে ইসলামপন্থী দল বা সামাজিক সংগঠনগুলোকে তাদের ঝোঁক বা অনুসৃত ধারা অনুসারে ভাগ করেছেন।
তিনি তার বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলেম সমাজের ভূমিকা ও প্রভাব গ্রন্থের ২২নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘সেই সময়ে বাংলাদেশের আলেম সমাজকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তারা ছয় ধারায় বিভক্ত ছিলেন।
১. বিভিন্ন ইসলামী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আলেম ২. বিভিন্ন সাধারণ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আলেম ৩. সরকারি-আধা সরকারি মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষক আলেম ৪. কওমি সাদ্রাসাগুলোর শিক্ষক আলেম, ৫. বিভিন্ন খানকাহ, সিলসিলা ও পীর-মুরিদী সংশ্লিষ্ট আলেম
৬. ইমাম, মুয়াজ্জিন ও ব্যক্তি পর্যায়ের আলেম, এ ধারাগুলোর মধ্যে ইসলামপন্থী দলে জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামের বাইরে আলেম সমাজের এক বিশাল অংশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় অবস্থান নেন।
এদের মধ্যে অনেকেই রণাঙ্গনে সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য খেতাবপ্রাপ্ত হন।’
সংগ্রামের সময় বাংলাদেশের শীর্ষ আলেম মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থান নেন।
মাওলানা শাকের হোসাইন শিবলী তার আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন মাওলানা ইমদাদুল্লাহ আড়াইহাজারী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কী করবেন এ ব্যাপারে দেশবরেণ্য আলেম মাওলানা হাফেজ্জী হুজুরকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর অত্যাচার করেছে, সুতরাং তারা জালেম।
জুলুম আর ইসলাম এক হতে পারে না। তুমি যদি মুসলমান হও তবে পাকিস্তানিদের পক্ষে যাও কীভাবে? এটা তো জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের প্রতিবাদ প্রতিরোধ।’
‘জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম’ পাকিস্তানের সেক্রেটারি মুফতি মাহমুদ সব সময় বাঙালি মুসলমানদের পক্ষে ছিলেন। ২৬ মার্চের আগে তিনি ঢাকায় এসে এ অংশের নেতাদের বলে দিয়েছিলেন, ‘আপনারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলুন, দেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করুন।’
মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘সে সময় আমার দায়িত্ব ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা ও যুবকদের যুদ্ধে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা।
তা ছাড়া মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী, মাওলানা আবদুস সোবহান, মাওলানা দানেশ, মাওলানা আতাউর রহমান খান, মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, মাওলানা ইমদাদুল্লাহ আড়াইহাজারী ও মাওলানা ফরিদউদ্দীন মাসউদ প্রমুখ বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সার্টিফিকেটের অধিকারী।
পাক হানাদার বাহিনী এসে কালিমা জিজ্ঞেস করত। বলতে পারলে বুঝত তারা মুসলমান। আর না পারলে হিন্দু প্রমাণিত হতো। এ ক্ষেত্রে অনেক আলেম নিজেদের ঘরে এসব হিন্দুদের আশ্রয় দিয়ে তাদের কালেমা শিখিয়েছেন এবং পাক বাহিনীর অত্যাচার থেকে রক্ষা করেছেন।
২৫ মার্চের পর সেই সময়ের বড় মাদ্রাসাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এবং মাদ্রাসাছাত্রদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল।
এত কিছুর পরও কি কেউ বলবেন আলেম সমাজ স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন, স্বাধীনতার শত্রু ছিলেন? আসল সত্য হল হক্কানি আলেম সমাজ স্বাধীনতার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বন্ধু ছিলেন। আলেম ওলামা স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র অংশগ্রহণ করেছিলেন।
তবে, হ্যাঁ, অল্পসংখ্যক আলেম ছিলেন নীরব। তার কারণ প্রথম তারা বহু ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাই স্বাভাবিক কারণেই তারা পাকিস্তান ভেঙে ফেলার কথা হয়তো তখনও ভাবতে পারেননি।
দ্বিতীয়ত ভারতবেষ্টিত এই ছোট্ট ভূখণ্ডটি ভৌগলিক স্বাধীনতা অর্জন করলেও রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কতটা ভারতীয় আগ্রাসনমুক্ত থাকতে পারবে, সে বিষয়ে একটা বিরাট সংশয় দেখা দিয়েছিল তাদের মনে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর মতো নির্লজ্জভাবে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে লুটপাট, হত্যা-ধর্ষণে কোনো আলেম কখনও অংশ নেননি।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যারা পাক হানাদার বাহিনীর পদলেহন করেছে, নিজের দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তারা অপরাধী, তারা ক্ষমার অযোগ্য। অবশ্যই তাদের কঠিন সাজা দিতে হবে।
পরিশেষে ৯নং সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও বলছি ‘বাঙালি হয়ে যারা বাঙালির ঘরে আগুন দিয়েছে, বাঙালি মা-বোনদের ওপর পাশবিক নির্যাতনে মদদ জুগিয়েছে, শরিক হয়েছে, অহেতুক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তারা যে পক্ষের হোক না কেন ধর্মীয় ও মানবিক দিক থেকে তারা অপরাধী। আর অপরাধীর বিচার সবসময় কাম্য।
এটি নৈতিক, মানবিক ও প্রচলিত আইনের বিধান। অপরাধিকে বিনা বিচারে ক্ষমা প্রদর্শন করা একটি ক্ষমাহীন অপরাধও বটে।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর
আরও পড়ুন: ‘যুদ্ধের সময় আমাদের বাড়িতে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দিয়েছিলাম’