শাহনূর শাহীন : রাত তখন ৩টা। বইমেলায় প্রকাশিতব্য বইয়ের কাজে আগের দিন সন্ধ্যায় বাংলাবাজার গিয়েছিলাম। কাজ শেষে ফিরছিলাম শেষ রাতে। কাজের চাপে রাতে খেতেও পারিনি, খিদে পেয়েছিলো খুব।
রাস্তায় লোকজন নেই। সদরঘাট থেকে যাত্রাবাড়ী যাওয়ার জন্য ছোট ছোট বাস আছে সেগুলো তখনও চালু হয়নি। রিক্সাও নেই। যাত্রাবাড়ী-সদরঘাট, বাংলাবাজার-ইসলামপুর চৌরাস্তা ফুট ওভার ব্রিজের নিচে দেখলাম একজন ভ্যানে করে রুটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
রুটি নিলাম, সাথে হালুয়া। একসাথে অনেক বড় আকারের রুটি। ছিড়ে ছিড়ে দিচ্ছে। এর মধ্যে এক সিএনজি চালক এলো, পনেরো টাকার রুটি ভাজি চাইলো। আমাকে কতো টাকার দিয়েছেন জিজ্ঞেস করলে বললো, পনেরো টাকার। বললাম আরো পাঁচ টাকার দিন। এরই মধ্যে একটি রিক্সা এলো। চালকের বয়স আনুমানিক ৪৫ হবে।
যাবেন যাত্রাবাড়ী। হ্যাঁ। একটু দাঁড়ান। যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা যাবো, চলেন । রিক্সা চলতে শুরু করলো। চুপচাপ কিছুক্ষণ চলার পর গল্প শুরু করলাম। আঙ্কেল আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়? বরিশাল। ঢাকায় থাকেন একাই নাকি পরিবার নিয়ে? সবাইকে নিয়েই থাকি। কোথায় থাকেন? পঞ্চবটি।
কে কে আছেন বাসায়? দুই ছেলে, স্ত্রী আর আমি। ছেলে কয়জন? তিন ছেলে, কোনো মেয়ে নেই। ছেলেরা কে কোথায় কী করে? আরেক ছেলে কোথায় থাকে? বিয়ে শাদি করিয়েছেন?
বড় ছেলেকে বিয়ে করিয়েছি, বউ নিয়ে মুন্সিগঞ্জে থাকে। মেজো ছেলেকেও বিয়ে করিয়েছিলাম। মেয়ে ভার্সিটিতে পড়ে। বিয়ে দিয়েছিলাম আরো দুই বছর আগে। বিয়ের পর ছেলে বউকে কলেজে ভর্তি করিয়েছিলাম।
দু’বছর আমাদের কাছে থেকেই পড়েছে। কয়েকদিন আগে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। আমার ছেলে সিএনজি চালায় তো শিক্ষিত মেয়ের এতোদিন পর অশিক্ষিত জামাই পছন্দ হয়নি।
ছোট ছেলে কী করে? স্কুলে পড়ে। তো এতো রাতে আপনি রিক্সা নিয়ে বেরিয়েছেন! আমি রাতেই চালাই। দিনে কী করেন? দিনে বিশ্রাম করি। সেই পঞ্চবটি থেকে সদরঘাট? সন্ধার আগে রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। এদিকেই চালাই। রিক্সা এপারেই গ্যারেজে থাক। কোনোদিন মাগরিবের নামাজ পড়ি এখানে এসে আবার কোনোদিন পড়ে আসি।
গড়ে কতো টাকায় আয় হয় প্রতি রাত? ৪০০ থেকে ৫০০/৬০০ টাকার মতো থাকে মালিকের বিল দিয়ে। রিক্সা ভাড়ায় চালান? জি। বড় ছেলে টাকা-পয়সা দেয় না? বড় ছেলে আগে আমাদের সাথেই থাকতো। এখনতো দূরে থাকে। তারও সংসার হয়েছে, বউ বাচ্চা আছে। তারপরও প্রতিমাসে দুই হাজার টাকা দেয়।
আসছে মাহে রমজানুল মোবারক বিশেষ সংখ্যা
কিন্তু বাবা শহরের বাসা ভাড়া দিয়ে একজন বা দুজনের আয় দিয়ে সংসার চালানো খুবই মুশকিল। ছোট ছেলেটা এখনো পড়ালেখা করে। তাছাড়া আগে আয় আরো বেশি আয় হতো, এখন হয় না।
কেন হয় না? কী বলবো বাবা! আগে মানুষ নির্ভয়ে রাস্তায় বের হতে পারতো। এখন তো রাতের বেলায় ভয়ে মানুষ রাস্তায় বের হয় না। পুলিশ জনগণের নিরাপত্তার জন্য থাকে। কিন্তু পুলিশের ভয়েই মানুষ এখন রাস্তায় বের হয় না।
অযথা হয়রানি আর পেরেশানি তো থাকেই সাথে টাকার জন্য মানুষকে বিপদে পড়া লাগে। টাকা না দিলে পুলিশ গাঞ্জা (গাজা) হিরোইন (হেরোইন) দিয়ে থানায় নেওয়ার ভয় দেখায়। ভয় দেখিয়ে টাকা না পেলে থানায় নিয়েও যায়। অনেক গরিব মানুষ টাকার জন্য বিনা দোষে জেল খাটে। দেশটা স্বাধীন হইলেও গরীব মানুষের জন্য হয় নাই।
গরিব মানুষদেরই পেটের দায়ে রাতে রাস্তায় বের হতে হয়। কিন্তু পুলিশের ভয়ে মানুষ এখন সাহস পায় না। এজন্য এখন আগের মতো রাস্তায় বের হয় না। ভাড়াও কম পাই। আয়ও কম হয়।
কথা বলতে বলতে চলে এলাম যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা। নামলাম। ভাড়া কতো আঙ্কেল? ৫০ টাকা দিন। আরো ১০ টাকা বাড়িয়ে দিলাম। ওহ! কতো কথা বললাম অথচ আঙ্কেলের নামটা জানা হলো না! জি, আমার নাম হারুনুর রশিদ।
বাগদাদ শহরে পৃথিবী বিখ্যাত বাদশা ছিলো খলিফা হারুনুর রশিদ। খলিফা হারুনুর রশিদের কোনো অভাব অনটন ছিলো না। নিরাপত্তার ভয়ও ছিলো না। তার সময়ে রাজ্যের কোনো নাগরিকও নিরাপত্তহীনতায় ছিলো না। তিনি ছিলেন উদার ও ন্যায়পরায়ন শাসক।
কিন্তু আমাদের সমাজে, আমাদের আজকের পৃথিবীতে এরকম হাজারো হারুনুর রশিদ আছেন যারা পেটের খিদে মেটানোর জন্য বৃদ্ধ বয়সেও রাতের আঁধারে রিক্সার পেডেল ঘুরান। কাজ করেন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে। দেশের অর্থনীতিতে রাখেন বড় অবদান। কিন্তু সমাজে তারা থাকেন খুব অবহেলিত হয়ে। ভোগেন নিরাপত্তাহীনতায়।
তাদের জীবনের নিরাপত্তার কোনো গ্যারান্টি বা জবাবদিহিতা নাই। থানা পুলিশ মিথ্যে অভিযোগে তাদের আটক করে নিয়ে গেলেও কেউ তাদের খোঁজ খবর নেয় না। নিরবে অশ্রু ফেলা ছাড়া এমন মানুষগুলোর আর কিছুই করার নাই।