সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ৪ বছর পূর্তিতে রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এক সামাজিক সংলাপে বক্তারা প্রশ্ন তুলেছিলেন, ৫ ডলারে পোশাক কিনে ২৫ ডলারে বিক্রি! মাঝের ২০ ডলার যায় কোথায়?
রানা প্লাজা দুর্ঘটনা জাতি হিসাবে আমাদের লজ্জার কারণ। তাই খতিয়ে দেখা দরকার- এ দুর্ঘটনার পর পোশাকখাতে কী পরিবর্তন এনেছে, শ্রমিকদের ভাগ্যের কতটা উন্নতি ঘটেছে। সেটি না হলে যে আমরা এর কলঙ্ক মোচন করতে পারব না।
এ ক্ষেত্রে বলতে হচ্ছে, কোনো মালিকের একার পক্ষে টেকসই শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা অসম্ভব। কারণ যখন ২৫ ডলারে বিক্রি করা একটি পোশাক ৫ ডলারে কিনে নেওয়া হয়!
শোনা যায়, মাঝখানের এই ২০ ডলারে কি না শ্রমিক-মালিক কারও সংশ্লিষ্টতা থাকছে না। যদি তা-ই হয়, তাহলে যে এত কম পয়সায় শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা সত্যিই কঠিন।
এ অভিযোগ দীর্ঘদিনের- পণ্যের ন্যায্য মূল্য দিচ্ছে না বিদেশি ক্রেতারা। বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক কিনে বিদেশি ক্রেতারা অনেক মুনাফা করলেও তারা উৎপাদকদের অনেক কম মূল্য পরিশোধ করে।
বাংলাদেশে তৈরি পোশাক পণ্যের উৎপাদন খরচ এবং উন্নত দেশগুলোতে সেই পণ্যের খুচরা বিক্রয় মূল্যের মধ্যে ব্যবধান অবাক করার মতো।
দেখা গেছে, বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক কিনে একটি পণ্যে বহুগুণ মুনাফা করছে। অর্থাৎ খুচরা ক্রেতাকে এক টাকার পণ্যের জন্য সাত টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে।
সম্প্রতি দুটি বিদেশি ব্রান্ডের কয়েকটি পণ্যের খুচরা মূল্যের ট্যাগ ও বাংলাদেশে ওই পণ্যের উৎপাদন খরচ বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি খুচরা প্রতিষ্ঠানে পোলো ব্যান্ডের শার্টের ট্যাগে দেখা গেছে, শার্টটির খুচরা বিক্রয় মূল্য ৪২ ডলার বা তিন হাজার ৪৭৫ টাকা। যদিও বাংলাদেশে শার্টটির উৎপাদন খরচ হয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ বা ২৭৩ টাকা।
পোশাকের দাম বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে বায়ারদের সঙ্গে দরকষাকষি করা যেতেই পারে। অবশ্য বায়াররা তাদের ব্যবসা দেখবে, তাদের চাপ দিলে তারা ইথিওপিয়া বা পাশের দেশ ভারত চলে যাবে। গার্মেন্টস খাত এগিয়ে নিতে ভারত ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে, এ বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।
অনেকে মনে করেন, পোশাকের দাম বাড়ানোর বিষয়টি ইইউর পলিসিগত সিদ্ধান্তের আওতায় পড়ে না। এটি মালিক এবং ক্রেতার দরকষাকষির বিষয়। পাঁচ ডলারে পোশাক বিক্রি করতে ক্রেতাদের বিস্তারিত জানাতে হয়।
কিন্তু বিদেশি ক্রেতারা যখন ২৫ ডলারে পোশাক বিক্রি করেন, তাতে কত দিয়ে কেনা তা লেখা থাকে না। এমন বাস্তবতায় বায়ারদের উচিত শ্রমিকের স্বার্থে তাদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে পোশাকের দাম পুনর্বিবেচনা করা।
দি গার্ডিয়ান সম্প্রতি পোশাকের মূল্য বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে বলছে, বাংলাদেশের শ্রমমান উন্নয়নে তৈরি পোশাকের দাম বাড়াতে হবে। ক্রেতারা স্থানীয় মার্কেটে যে দামে পোশাক বিক্রি করছে তার চেয়ে কয়েকগুণ কম দামে আমদানি করছে। এটার মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন।
দি ডিপ্লোম্যাট তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, সস্তায় টি-শার্ট দেওয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশেরই রয়েছে। নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্বেও বাংলাদেশের পোশাক খাত এগিয়ে যাচ্ছে।
পোশাক খাত সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উৎপাদন ও খুচরা মূল্যের মধ্যে এ বিশাল ব্যবধানের পেছনে কোনো কারণ নেই। তবে স্থানীয় পণ্য পরিবহন ও অন্যান্য সব খরচ উৎপাদন খরচের ৬০ শতাংশ মাত্র।
যতদূর জানা গেছে, ৩ দশমিক ১ ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক পণ্য খুচরা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৫ ডলার হতে পারে। কিন্তু খুচরা পর্যায়ের মূল্যের সঙ্গে শিপমেন্ট, মজুদ এবং পরিবহন খরচ যুক্ত হয়ে দাম বেড়ে যায়।
অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে কয়েকটি দেশের খুচরা ক্রেতাদের পণ্যের মূল্যের সঙ্গে আমদানি শুল্কও পরিশোধ করতে হয়। বিশেষ করে যেসব দেশে বাংলাদেশ ডিউটি ফ্রি বাজার সুবিধা পায় না।
রানা প্লাজা ধসের পর নিরাপদ কর্মপরিবেশ উন্নয়ন ও শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হলেও পোশাকের দর বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি রাখছেন না পশ্চিমা ক্রেতারা।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে পোশাকের ন্যায্য দর আদায়ে একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশসহ এশিয়ার পাঁচ দেশ।
এ লক্ষ্যে ‘আ লিক সহযোগিতা ফোরাম’ নামে একটি ফোরাম গঠন করেছে দেশগুলোর পোশাক খাতের সংগঠনগুলো। দর বাড়ানো ছাড়াও শিল্পের স্বার্থে একসঙ্গে আরও কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করবে এ ফোরাম।
আপাতত বাংলাদেশ, চিন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও পাকিস্তানকে নিয়ে এই ফোরাম গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এসবে কাজের কাজ হয়েছে কতটা?
বরং গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে বলা যায়, দর বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি রাখছেন না ক্রেতারা। দরদামে বিশেষ করে বাংলাদেশের বেলায় নানা কৌশল নেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা।
আবার রফতানি আদেশ পেতে উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যায্য প্রতিযোগিতাও দর কম পাওয়ার অন্যতম কারণ।
বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে পোশাকের ন্যায্য দর আদায়ে একটি ইউনিফাইড প্রাইসব কোড বা সমন্বিত দরবিধি প্রণয়নের প্রয়োজনের কথা বলেছেন বিজিএমইএ নেতারা।
এ নিয়ে ইদানীং সরকারি বিভিন্ন পর্যায়েও কথা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ব্যবস্থায় যে অসুবিধাও আছে তা নিয়ে কি ভেবেছেন তারা?
যেমন, দরের একটা সিলিং নির্ধারিত থাকলে ক্রেতারা সর্বনিম্ন দরই দিতে চাইবে। এতে হিতে বিপরীত হওয়ারও আশঙ্কা আছে। তবুও বলি, পোশাকের ন্যায্য দর পেতে উদ্যোক্তাদের একটা ন্যূনতম মান ধরেই দরকষাকষি করা উচিত।
লেখক : কবি, গবেষক ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম
০১.০৩.২০১৮