সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর
কবি ও কলামিস্ট
‘ধর্মহীন পৃথিবী’র ব্যাপারে কথা বলছেন বিজ্ঞামনষ্ক লোকজন। আমাদের দেশে সাধারণ লিখিয়ে দু-চারজন বললেও, পশ্চিমা সমাজের বহু বিজ্ঞজন ধর্মহীন পৃথিবীর কথা বলে আসছেন।
ধর্মহীন পৃথিবী কেন দরকার, বিজ্ঞানপ্রণীত আগামী সভ্যতা বিনির্মাণে এর প্রয়োজনীয়তা, কীভাবে এমন সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠবে— এসব বিষয়ে বিস্তর আলোচনা করে চলেছেন তারা।
স্বভাবতই, বিজ্ঞানপুজ্য বর্তমান সভ্যতা তাদের ঈশ্বরহীন পৃথিবীর নান্দনিক থিউরি ঢক ঢক করে গিলতে শুরু করেছে। যে পৃথিবীতে ঈশ্বর নেই, সে পৃথিবীতে ধর্মও নেই। ধর্ম নেই মানে নানা ধর্ম নিয়ে মানুষের মাঝে সংঘাতও নেই। সংঘাত না থাকার ফলে বিশ্ব বিজ্ঞানের ডানায় ভর করে তরতরিয়ে এগিয়ে যাবে।
পশ্চিমের বিজ্ঞানপুজারী ব্যক্তিবর্গ এমন পৃথিবীর স্বপ্নই দেখছেন বহুদিন ধরে।
এখন আমার যেটা প্রশ্ন— আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম হয়েছে কতোদিন? ধরা যাক আইজ্যাক নিউটনের বলবিজ্ঞান ও মহাকর্ষীয় ধারণা থেকেই আধুনিক বিজ্ঞানের নতুন অগ্রযাত্রা। তাহলে বলা যায়, আধুনিক বিজ্ঞানের বয়স বড়জোর সাড়ে তিনশো বছর।
ধর্মের জন্ম কবে? ধর্মের জন্ম মানুষ পৃথিবীতে আগমনের পর থেকেই। এটা বিজ্ঞানও স্বীকার করে। হোক তাদের থিউরি অনুযায়ী সেটা যেকোনো লৌকিক বা আচরিক ধর্ম, কিন্তু মানুষের আবির্ভাবের পর থেকেই ধর্ম পৃথিবীতে আছে। এবং বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, ধর্মের অস্তিত্ব মানুষ আগমনের সঙ্গে সঙ্গে সেই যে শুরু হয়েছে, আজ পর্যন্ত পৃথিবীর বুক থেকে ধর্মের বিলুপ্তি ঘটেনি।
লোকজ বিশ্বাসের কারণে বা আধিপত্য বিস্তারের কারণে বিভিন্ন ধর্মের বিলুপ্তি ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে প্রবল বিক্রমে বিস্তার লাভ করেছে নতুন আরেক ধর্ম। পৃথিবীর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত তাই ধর্মের কোনো বিলোপ ঘটেনি।
কিন্তু বিজ্ঞান? বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত পাল্টে যাচ্ছে। বছরে বছরে বিজ্ঞানের একই শাখায় নতুন থিউরি আসছে পুরোনো থিউরিকে ভুল প্রমাণিত করে। প্রতিদিন বিজ্ঞান নতুন ফর্মুলা আবিষ্কার করে অতীতের মেশিনকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিচ্ছে। আপ থেকে আপগ্রেড হচ্ছে এবং হতেই থাকবে। পৃথিবীতে মানুষ যতোদিন থাকবে ততোদিন বিজ্ঞান পরিবর্তিত হতেই থাকবে।
এখন, যে জিনিস নিজেই নিজের থিউরির ওপর স্থায়ী নয়, যেটার একদিনের স্থায়িত্ব নেই— সেই বিজ্ঞান কীভাবে ধর্মের স্থান দখল করতে পারে? বিজ্ঞানের শেষকথা বলে কিছু নেই, বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখার অপূর্ণাঙ্গ— কারণ এটা মানুষের তৈরি।
মানুষ যতোদিন পৃথিবীতে আছে ততোদিন বিজ্ঞান নিজেকে নিজে ছাড়িয়ে যাবে, প্রতিদিন সে মানুষের হাত দিয়েই পরিবর্তিত হবে।
সহজকথা যা বলতে চাই, ধর্মের স্থায়িত্ব অযুতকাল ধরে পৃথিবীতে টিকে আছে। শত ঘাত-প্রতিঘাত, যুদ্ধ-বিগ্রহ, আস্তিক-নাস্তিক সংঘাত, প্রলয়ঙ্কারী ধ্বংসযজ্ঞ, প্রতাপশালী সম্রাটের রক্তচক্ষুকে তুচ্ছ করে ধর্ম নিজের অস্তিত্ব সর্বত্র বিরচিত করে রেখেছে।
মানুষের জন্য ধর্মই শেষকথা, কেননা মানুষ অলৌকিক প্রাণী। তার জন্য অলৌকিক ঈশ্বরই কেবল আরতি হতে পারে, মনুষ্যনির্মিত বিজ্ঞান নয়। বিজ্ঞান রোবটিক সাবজেক্টের ধর্ম হতে পারে, দ্যাটস্ ওকে; কিন্তু মানুষের নয়।
একদিন মানুষ গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে যাত্রা করবে। ভিন্ন গ্রহে বসতি স্থাপন করতে পারে। গ্র্যাভিটি অতিক্রম করে ঘুরে বেড়াবে মহাকাশের যত্রতত্র। প্রতিটি গ্রহে মহা প্রতাপে নির্মিত হবে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা...।
মহাকাশে যাত্রার প্রাক্কালে স্পেসশিপের দরজায় দাঁড়িয়ে একজন মুসলিম পড়বে বিসমিল্লাহ।
একজন খ্রিস্টান স্পেসযাত্রী গলায় ঝুলানো ক্রুশে দেবে ট্রিনিটি চুম্বন। একজন হিন্দু নভোচারীর পকেটে থাকবে কৃষ্ণের রেপ্লিকা...। ধর্মকে পৃথিবী থেকে জুদা করার উপায় নেই, বিজ্ঞান যতোই মহাকর্ষিক উৎকর্ষ অর্জন করুক, মানুষ থাকলে পৃথিবীতে ধর্ম থাকবেই। ধর্মহীন পৃথিবী বলতে কোনো স্বপ্ন নেই।
০২
পশ্চিমা সমাজ বিশ্বব্যাপী তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ফ্যাশন, জীবনাচার, বোধ ও বিশ্বাস আমাদের প্রাচ্যে নানা কায়দায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে। বস্তুত সাদাচোখে দেখলে, পশ্চিমারা তাদের এ চেষ্টায় প্রায় ৯০ ভাগ সফল।
টিভি, সিনেমা, ইন্টারনেটের মাধ্যমে পশ্চিমা সংস্কৃতি প্লাবনের মতো আমাদের সমাজে ধেয়ে আসছে। সর্বত্র তাদের রীতি-রেওয়াজ চালু হচ্ছে। বিজ্ঞানের ছায়ায় তারা রপ্তানি করছে তাদের বিশ্বাস ও বোধ।
কিন্তু তারা হয়তো কখনো ভেবেই দেখেনি, এই সংস্কৃতি আর বিজ্ঞান-বিশ্বাস রপ্তানির স্রোতের ফাঁক-ফোকড় গ’লে প্রাচ্যীয় ধ্যান-ধারণা, শিক্ষা-সংস্কৃতি, ধর্ম ও বিশ্বাস খুব সঙ্গোপনে তাদের বিশ্বাসের গোড়ায় গিয়ে আঘাত হানছে। উল্টো স্রোত বলে একটা কথা আছে, উপরের প্রবল প্রতাপশালী স্রোতের অতল দিয়ে একটা উল্টো চোরা স্রোত তাদের বিশ্বাসের দিকেও ধেয়ে যাচ্ছে।
এই প্রাচ্যীয় বিশ্বাস বর্তমানে তাদের সমাজের কোণায় কোণায় গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু এই প্রাচ্যীয় বিশ্বাস খুব শিগগির একটা প্রকাণ্ড বিস্ফোরণ ঘটাবে। যেহেতু পশ্চিমে নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস বলতে তেমন কোনো শক্তিশালী বিশ্বাস নেই, তাদের সংস্কৃতি মিশ্র সংস্কৃতির আবহে গড়ে ওঠেছে, পারিবারিক এবং সামাজিক বন্ধন ঠুনকো- এসব কারণে প্রাচ্যীয় ধর্মবিশ্বাস পশ্চিমে খুব সহজে বিকাশমান হবে নিকট ভবিষ্যতে।
পশ্চিমারা কেবল ভোগের বস্তুবাদ আর সভ্যতা বিনির্মাণে বিরাট বিরাট বিল্ডিং টেকনোলজি এবং অঢেল বিজ্ঞান আবিষ্কারের মধ্যেই সুখের সংজ্ঞা খুঁজে ফিরেছে। প্রাচ্যীয় জীবনদর্শন এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের স্পিরিচুয়াল জীবনের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ ছিলো না।
আমেরিকার শাসকগোষ্ঠী আধিপত্য বিস্তারের নেশায় প্রাচ্যকে কুপোকাত করতে গিয়ে পশ্চিমকে প্রাচ্যের এই মহতি দর্শন এবং বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। এই আধিপত্য বিস্তারের নেশাই তাদের সমাজব্যবস্থাকে আমূল পাল্টে দেবে।
আজ থেকে দুশো তিনশো বছর আগে নেদারল্যান্ড, পর্তুগাল, স্পেন যেমন আধিপত্য বিস্তারের লোভে পড়ে নিজেদের সর্বস্ব খুইয়ে বসেছে, আমেরিকা-ব্রিটেনের অবস্থা তার চেয়েও করুণ হবে। স্পেন-পর্তুগাল কেবল নিজেদের আধিপত্য ও অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য হারিয়েছে, কিন্তু আমেরিকা-ব্রিটেনের নিজস্ব পরিচয়ই সঙ্কটে পড়ে যাবে।
যদি স্পেসিফিকলি বলি, আগামী ২০৫০ থেকে ২০৬০ সালের মধ্যে ব্রিটেন ও আমেরিকা পৃথিবীর সবচে উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হবে। ঈশ্বরহীন পৃথিবীর স্বপ্নে বিভোর পশ্চিমা সভ্যতা হয়তো বুঝতেই পারছে না, আধিপত্য বিস্তারের নেশায় তারা হারাতে বসেছে তাদের নিজেদেরই সাজানো উঠোন!