সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


উচ্চ আদালতে বাংলার আর কত কাল অপেক্ষা করতে হবে?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন

বাংলা পৃথিবীর সমৃদ্ধ ভাষাগুলোর একটি। আমাদের ভাষাসৈনিকদের আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্যও ছিল রাষ্ট্রের সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলা চালু করা। মানুষের মুখের ভাষাকে কাজের ভাষায় পরিণত করা।

কিন্তু আমরা আজ একথা ভুলতে বসেছি যে, দেশের সর্বক্ষেত্রে মাতৃভাষার ব্যবহার না থাকা জাতির জন্য পরাধীনতারই নামান্তর।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপান শিক্ষার সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রচলন করে মাত্র দুই দশকের মধ্যে শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশে করে।

মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করে একইভাবে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া আজ পৃথিবীতে মর্যাদাসম্পন্ন দেশ। তারা যদি নিজ নিজ মাতৃভাষার শিক্ষা নিয়ে যদি বড়মাপের প্রকৌশলী, চিকিৎসক বা ব্যবস্থাপক হতে পারে-তাহলে আমরা পারছি না কেন?

বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার আসন আজ বিশ্বের দরবারে সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত। জাতিসংঘ একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বাঙালি জাতির মাতৃভাষার সংগ্রামকে সম্মান জানিয়েছে। কিন্তু আমরা মাতৃভাষার মর্যাদা কতটা রক্ষা করতে পারছি?

প্রসঙ্গত, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল ১৩৫৯ সালের ৮ ফাল্গুন, বৃহস্পতিবার। যা এই সময়ের অনেকেরই জানা নেই। যে কারণে গৌরবের দিনটি আজ আমরা শুধুই ইংরেজি তারিখের হিসেবে ‘২১’ উদযাপন করি।

আমি বলছি না, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন নিন্দনীয়, তবে ৮ ফাল্গুনকে অবহেলা করাটা অবশ্যই নিন্দনীয়। তাই সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই ভেবে দেখা উচিত- ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগের সেই দিনটিকে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় মনে রাখার জন্য ৮ ফাল্গুনকে বিশেষায়িত করা যায় কি-না। আমি অবশ্য সম্ভব বলেই মনে করি।

এছাড়াও ৮ ফাল্গুনকে ঘোষণা করা যেতে পারে ‘জাতীয় ভাষাশহীদ দিবস’। এত করে একসাথে পালন করা যাবে ‘জাতীয় ভাষা শহীদ দিবস’ এবং ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’।

ভাবতে অবাক লাগে, বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও উচ্চ আদালতে এর চর্চা হচ্ছে না। সরকারি কাজকর্ম, নথিপত্র বা টিকা, ভাষ্য ইত্যাদি যে বাংলাতে দেওয়া হয়, সেসব ভুল-শুদ্ধ মিশ্র বাংলাতে দেওয়া হয়।

যখন বঙ্গভবনে কেউ শপথ গ্রহণ করে তখন বাংলায় শপথনামাটি পাঠ করা হয়। নিম্ন আদালতে বাংলা ভাষা মোটামুটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা এখনও স্থান পায়নি কেন? উচ্চ আদালতে বাদী, বিবাদী, সাক্ষী, কথোপকথন সব বাংলায় হলেও রায় ইংরেজিতে হয় কেন?

রেফারেন্স ইংরেজিতে- এই কি যুক্তি? না, তা হতে পারে না। আসলে এটা মানসিকতার বিষয়। তবু জানতে চাই- উচ্চ আদালতে বাংলা স্থান পাওয়ার জন্য আমাদের আর কত কাল অপেক্ষা করতে হবে?

মনে রাখা চাই- বাংলা ভাষা আমার অস্তিত্ব, আমার পরিচয়। এই পরিচয়কে নষ্ট করে দেওয়া মানে আত্মপরিচয়কে বিকৃত করা। ভুলভাল ইংরেজি বলতে পারাকে গর্ব নয়, শুদ্ধ বাংলা বলাকেই যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। পরিবার থেকে প্রশাসন- সর্বত্র চালু করতে হবে শুদ্ধ ও পরিশীলিত বাংলা ভাষার।

বাংলা নিয়ে গবেষণার উপর আরও বেশি করে জোর দিতে হবে। প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য করতে হবে বাংলা একাডেমির মতো ভাষা সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে। কারণ, বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে, তাহলে বাংলা ভাষা পিছিয়ে থাকবে কেন?

প্রয়োজনে ভাষা কমিশন গঠন করা হোক। যে কমিশন প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন দেবেন, গত এক বছরে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা কতটা কার্যকর হয়েছে, কতটা কার্যকর হয়নি, কেন হয়নি, কারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে?

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘দাওয়াত কার্ডও এখন ইংরেজিতে লেখা হয়। এটা কেন লিখতে হবে? ইংরেজি ভাষাভাষীর জন্য সেটা হতে পারে। তবে আমাদের দেশে বিয়ের কার্ড কেন ইংরেজি ভাষায় লিখতে হবে? এর মধ্যে তো কোনো আলাদা মর্যাদা নেই।’

এমন প্রশ্ন বাংলাভাষাপ্রেমী সবার। কিন্তু সবার ক্ষমতা নেই এমন প্রশ্নের উৎস বন্ধ করার। তবে প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিলে সুফল আসতে পারে।

লেখক : কবি, গবেষক ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম

২৫.০২.২০১৮


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ