সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশ, বড় ঋণের সাথে এবার ক্ষুদ্র ঋণেও সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ পরিস্থিতির। গত পাঁচ বছরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে (এসএমই) খেলাপি বেড়েছে ১৫ হাজার ৯৯৫ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এমন খবরে যে উদ্বিগ্ন হতেই হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত হালনাগাদ রিপোর্টে দেখা যায়, ২০১৫ সালে এসএমই খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। সেটি ২০১৬ সালে দাঁড়ায় ২২ হাজার কোটিতে।
২০১৭ তা-ও ছাড়িয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সুত্রে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনিয়ম-দুর্নীতি ব্যাংক খাতকে শেষ করে ফেলছে। এত দিন বড় ঋণে জালিয়াতি হয়েছে। এখন ছোট ঋণেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
ব্যাংক খাতে সুশাসন অপরিহার্য হলেও দেশে এর অভাব খুব বেশি। এ সুযোগে দুর্নীতি ও লুটপাটে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের পরিচালকদের ঋণ ভাগাভাগি, যাচাই-বাছাই ছাড়া ঋণ বিতরণ ও পুনর্গঠিত ঋণ বারবার খেলাপি হওয়ার বিষয়টি বেশি দায়ী বলে ধরে নেওয়া যায়।
এভাবে চলতে থাকলে ব্যাংক খাত একসময় অস্তিত্ব সংকটে পড়বে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবে লাখ লাখ সাধারণ গ্রাহক। কেননা সাধারণ গ্রাহকই এসব অর্থের বেশির ভাগ অংশের মালিক। দুঃখজনক হলেও সত্য, রাষ্ট্র এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে সফল হয়েছে বলে জানা নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৬ সাল শেষে দেশে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা ব্যালান্স শিটে অন্তর্ভুক্ত আর রাইট অফ করা প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা ব্যালান্স শিটে অন্তর্ভুক্ত নয়।
প্রসঙ্গত, ব্যাংকগুলো প্রতিবছর বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণকে রাইট অফ করে এবং তা ব্যালান্স শিট থেকে বাদ দেয়। রাইট অফ করা এ ঋণ ব্যালান্স শিটের অন্তর্ভুক্ত থাকে না বলে ব্যাংকগুলো তা খেলাপি ঋণ হিসেবে প্রকাশও করে না।
বইমেলায় সৈয়দ শিশিরের ‘নির্বাচিত কলাম’
গত ডিসেম্বরে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়, সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্য ঠিক করে দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যর্থ হলে নেওয়া হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।
একই সঙ্গে এসব ব্যাংকের সার্বিক সংকট কাটিয়ে উঠতে দেওয়া হয়েছে ১৩টি নির্দেশনা। বিশেষ করে খেলাপি ঋণ, মূলধন সংকট, প্রভিশন ঘাটতি, ঋণ অবলোপন কমিয়ে আনার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এসবের কোনো সুফল কি দৃশ্যমান? না।
আর দৃশ্যমান নয় বলেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ২০১৬ সালের আর্থিক স্থিতিশীলতা-বিষয়ক এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি ব্যাংকের বড় ১০ গ্রাহক খেলাপি হলে মূলধন ঘাটতিতে পড়বে ৩৭টি ব্যাংক। আর বড় সাতজন গ্রাহক খেলাপি হলে মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে ৩৩টি ব্যাংক।
একইভাবে তিনজন করে গ্রাহক যদি খেলাপি হন, তাতে মূলধন ঘাটতিতে পড়বে ২৩টি ব্যাংক। বর্তমানে ৫৭টি ব্যাংকে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ হারে মূলধন রয়েছে।
ডিসেম্বর ভিত্তিতে মোট মূলধনের পরিমাণ ৮৩ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকায় দাঁড়ালেও একই সময়ে ব্যাংকগুলোতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। তার মানে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ মোট ঋণের ৯ দশমিক ২৩ শতাংশ।
আর এ হিসাবমতে, বর্তমানের এ খেলাপি ঋণ যদি তিন শতাংশ বাড়ে তাহলে ৫টি, ৯ শতাংশ বাড়লে ২৭টি ও ১৫ শতাংশ বাড়লে ৩৫ ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়বে। এছাড়া বাজার, বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন, সুদহার, তারল্য ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঝুঁকি তো আছেই। এ অবস্থায় আমাদের ব্যাংক খাতের ভবিষ্যৎ কী?
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং রীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতিমালার আলোকে ২০১৩ সাল থেকে ব্যাংকগুলোকে নতুন পদ্ধতিতে ঋণ শ্রেণীকরণ করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে নির্বাচনের কারণে ওই বছর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ছিল বলে খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছিল।
তখন ব্যবসায়ীদের অনুরোধ ও চাপের পরিপ্রেক্ষিতে সহজ শর্তে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগও দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। যে সুযোগে গত বছর পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে।
একই সময়ে বৈশ্বিক মন্দা, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারণে বেকায়দায় পড়া বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ সুবিধা নিয়ে ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করেছে।
দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, বিশেষ সুবিধায় পুনঃতফসিল করা এসব ঋণের একটি অংশ আবারও খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে বলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে।
গত তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা। মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা, যা বিতরণ হওয়া ঋণের ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ। অথচ গত ডিসেম্বর শেষে ছিল ৯ দশমিক ২৩ শতাংশ।
অবাক হতে হয় যখন জানা যায়, ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে নেই পর্যাপ্ত আইন। বাংলাদেশে আইনের আশ্রয় নিয়ে খেলাপি ঋণ আদায় করাটা কষ্টকর বলে ব্যাংক কর্মকর্তারা তা আদায়ের জন্য চাপে থাকেন।
ঋণ আদায়ে আদালতে মামলা হলেও তা দীর্ঘসময় চলতে থাকে এবং মীমাংসা হতেও সময় লাগে। মামলা বেশি হওয়ায় এখানেও জট লেগে থাকায় সুবিধা নিচ্ছেন ঋণখেলাপিরা।
বাস্তবতা পর্যালোচনায় বলা যায়, অতিরিক্ত ঋণ প্রদানই খেলাপি ঋণের সুযোগ সৃষ্টি করে। আবার এ কথাও সত্য, প্রয়োজনের তুলনায় কম ঋণ প্রদানও অনেক ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ সৃষ্টি করে। কারণ পরিমাণমতো ঋণ না পাওয়ায় গ্রাহক প্রজেক্ট সম্পন্ন করতে পারেন না বলে আয় হয় না এবং ব্যাংকের ঋণও শোধ করতে পারেন না।
যতটা জানতে পেরেছি, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, তিনটি পর্যায়ে ঋণ শ্রেণীকরণ (খেলাপি) করা হয়। তা হলো নিম্নমান, সন্দেহজনক ও মন্দ বা ক্ষতি।
আর এ তিনটি পর্যায় বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা সি তিও (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে হয়। এক্ষেত্রে ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ নিম্নমানের ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ প্রভিশন, ৬ থেকে ৯ মাসের মধ্যে হলে সন্দেহজনক ঋণ- যার বিপরীতে ৫০ শতাংশ প্রভিশন এবং ৯ মাসের বেশি হলে তাকে মন্দ বা ক্ষতি মানে বিবেচিত হয়- এর বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়।
এক্ষেত্রে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ব্যাংকের আয়ের সমান হলে আয়ের পুরোটাই প্রভিশন ঘাটতির পেছনে ব্যয় করতে হয়। তাই এসব ক্ষেত্রে ব্যাংক ও গ্রাহকের কল্যাণে বাস্তবতার আলোকে নীতিমালা প্রণয়ন প্রয়োজন বলে মনে করি।
লেখক : কবি, গবেষক ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম
২২.০২.২০১৮