মাওলানা জামিল বিন আশরাফ আলী
বাংলাদেশসহ বিশ্বের কতিপয় দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ একটি বার্নিং ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। ইসলামের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্রের কারণেই এই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের উত্থান। তারা ইসলামকে কলঙ্কিত করতে, সত্যিকার ইসলামপন্থি, ইসলাম প্রচারক ও ইসলামী আন্দোলনকারীদের বিতর্কিত করতে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে ব্যবহার করছে।
অন্যদিকে ইসলামী দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক উন্নতির পথ রোধ করতে এবং এসব দেশে তাদের সামরিক আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে একে কাজে লাগাচ্ছে। তারা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কিছু বিভ্রান্ত মুসলিমকে বেছে নিয়েছে। পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্রের কারণে হোক কিংবা অন্য কোন কারণে হোক যারাই এই পথে পা বাড়িয়েছে তারা জঘন্যতম অপরাধে জড়িত হয়েছে এবং ফিতনা-ফাসাদে লিপ্ত হয়েছে।
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের কারণ, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে ইসলামের শিক্ষা এবং দ্বীনি দাওয়াতি কাজের গুরুত্ব সম্পর্কে মূল্যবান আলোচনা রয়েছে কুরআন-হাদীস ও ইসলামী গ্রন্থসমূহে। ইসলামের আলোকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে অত্যন্ত চমকপ্রদ বিশ্লেষণসহ মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে তাতে সুনির্দিষ্ট ধারণাও দেয়া আছে।
ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে, তারা প্রিয় নবী (সা.)-এর শিক্ষা ও আদর্শ থেকে অনেক দূরে। সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদের কোন ধর্ম নেই। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল ও আতঙ্কগ্রস্ত করে পার্থিব সম্পদ অর্জন, ক্ষমতা দখল ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বলতে যা বুঝায় : সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদ ত্রাস শব্দ হতে উদ্ভূত। এর অর্থ হল ভয়, ভীতি, শঙ্কা। সন্ত্রাস হল আতঙ্কগ্রস্ত করা, অতিশয় ত্রাস বা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা। আর সন্ত্রাসবাদ হল, রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য হত্যা, অত্যাচার ইত্যাদি কার্য অনুষ্ঠান নীতি। অর্থাৎ কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কোন জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রণালীবদ্ধ সহিংসতার মাধ্যমে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা।
জঙ্গি, জঙ্গিবাদ ও জঙ্গিবাদী শব্দগুলোর মূল হল জঙ্গ। এটি ফার্সী ও উর্দু ভাষার শব্দ। জঙ্গ অর্থ যুদ্ধ, তুমুল কলহ, লড়াই, প্রচণ্ড ঝগড়া। জঙ্গি অর্থ যোদ্ধা। সেভাবে জঙ্গিবাদ অর্থ জঙ্গিদের মতবাদ, দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকাণ্ড। ধর্মীয় কারণে রাজনৈতিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে চোরাগোপ্তা হামলা, অতর্কিত আক্রমণ, হত্যা করা, আত্মঘাতী হামলা কিংবা কোন নির্দিষ্ট মতবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে জনগণের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করাকে জঙ্গিবাদ বলে।
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের অতীত বর্তমান : বর্তমানে মুসলিম অমুসলিম প্রায় সকলে ইসলাম ধর্মের নামে যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করা হচ্ছে তাকে সন্ত্রাসবাদ না বলে জঙ্গিবাদ বলেই আখ্যায়িত করছে। জঙ্গি বা জঙ্গিবাদ নামে কোন খবর প্রকাশিত হলে ধরে নিচ্ছে এটা মুসলিমদের কাণ্ড।
শুধু তাই নয়, ধরে নেয়া হয় যারা সুন্নতি লিবাস পরিধান করে, দাড়ি রাখে, টুপি পরে তারাই সাধারণত এই কাজের সাথে জড়িত। সে যাই হোক ধর্মের নামে যে সন্ত্রাস এটি কিন্তু নতুন বিষয় নয়। প্রাচীনকাল থেকে তা চলে আসছে। ইয়াহুদী উগ্রবাদী ধার্মিকগণ ধর্মীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছেন। মানব ইতিহাসে প্রাচীন যুগের প্রসিদ্ধতম সন্ত্রাসী কর্ম ছিল ইয়াহুদী যীলটদের (Zealots) সন্ত্রাস।
খৃস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী ও তার পরবর্তী সময়ে রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে বসবাসকারী উগ্রবাদী এ সকল ইয়াহুদী নিজেদের ধর্মীয় ও সামাজিক স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আপোসহীন ছিল। যে সকল ইয়াহুদী রোমান রাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা করত বা সহ অবস্থানের চিন্তা করত এরা তাদেরকে গুপ্ত হত্যা করত। প্রয়োজনে এরা আত্মহত্যা করত, কিন্তু প্রতিপক্ষের হাতে ধরা দিত না।
মধ্যযুগে খৃস্টানদের মধ্যে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে সন্ত্রাসের অগণিত ঘটনা দেখা যায়। বিশেষত ধর্মীয় সংস্কার, পাল্টা সংস্কার (Reformation and Counter-Reformation) এর যুগে ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্টদের মধ্যে অগণিত যুদ্ধ ছাড়াও সন্ত্রাসের অনেক ঘটনা দেখা যায়। ইসলাম ধর্মের প্রথম যুগে জঙ্গিবাদের কিছু ঘটনা পরিলক্ষিত হয়। যেমন ৩৫ হিজরী সালে (৬৫৬ খৃ.) ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান উসমান (রা.) কতিপয় বিদ্রোহীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন।
এভাবে যুগে যুগে বিভিন্ন জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের অসংখ্য ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ১৭৪৯ সাল থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত ফরাসী বিপ্লবের সময় ক্ষমতা দখলকারী কিছু বিপ্লবীর তাদের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে পরিচালিত হিংসাত্মক আচরণ।
১৮৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধের সময় এবং উনিশ শতকে কুক্ল্যাকস ক্ল্যান নামক শ্বেতাঙ্গ গ্রুপ কৃষ্ণাঙ্গ ও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীলদের উপর সন্ত্রাসী হামলা চালায়। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করে যাইয়নবাদী ইয়াহুদীরা ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে।
তাদের উদ্দেশ্য ছিলো ফিলিস্তিন থেকে ফিলিস্তিনীদের তাড়িয়ে দেয়া। তাদের মুকাবিলায় ফিলিস্তিনীরাও নিজেদের ভূখ- রক্ষার লড়াই শুরু করে। বর্তমান বিশ্বে জঙ্গিবাদের উত্থান হয় ১ সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংস করে দেয়ার পর।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র টুইন টাওয়ার ধ্বংসের জন্য সৌদী নাগরিক ওসামা বিন লাদেন ও তাঁর সংগঠন আল কায়েদাকে দায়ী করে। কিন্তু তারা আজ পর্যন্ত এর কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ দিতে পারেনি।
বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের উত্থান : আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। দেশটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ¦ল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বিশ্বে একটি উদার মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, কিন্তু ধর্মান্ধ নয়।
ধর্মপ্রীতি এদেশের ঐতিহ্য। আমাদের সমাজ কাঠামোর ভেতর কোন সাম্প্রদায়িকতা নেই। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য এদেশে কোন ব্যবস্থা নিতে হয় না। কিন্তু একটি কুচক্রিমহল বাংলাদেশের এ ঐতিহ্যকে মোটেই সহ্য করতে পারছে না।
তাই তারা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক ধারা বিনষ্ট করে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে বাংলাদেশকে একটি সন্ত্রাস কবলিত মৌলবাদী জঙ্গি রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করার মাধ্যমে বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপের অজুহাত সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। এজন্য তারা ইসলামের নামধারী কয়েকটি সংগঠনকে ব্যবহার করছে। সাম্প্রতিককালে ইসলামের নামে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে (গুলশান ও শোলাকিয়া) সারা দেশবাসী উদ্বিগ্ন।
গভীরভাবে বিবেচনা করলে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, ঘটনাদ্বয় ইসলামকে হেয় করার উদ্দেশ্যেই হয়েছে। অবশ্যই এহেন কর্মকাণ্ড ইসলামবিদ্বেষীদের সুদূরপ্রসারী চক্রান্তেরই ফসল।
সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কুরআন ও হাদীসের কঠোর হুঁশিয়ারি
১. হত্যাকারীর স্থান হবে জাহান্নামে : হত্যাকারীর স্থান হবে জাহান্নামে উল্লেখ করে কুরআনে বলা হয়েছে, “কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম, সেখানে সে স্থায়ী হবে।’’ [সূরা নিসা : ৯৩]
২. অন্যায়ভাবে হত্যাকারী বিশ্বের সবাইকে হত্যাকারী হিসেবে আল্লাহর কাছে চিহ্নিত : কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে, ‘‘নরহত্যা অথবা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করা ব্যতীত কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকেই হত্যা করল।’’ [সূরা মায়িদা : ৩২]
৩. অশান্তি সৃষ্টি করতে বারণ : কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে, ‘‘দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর তাতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না।’’ [সূরা আরাফ : ৫৬]
৪. সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদীর ওপর আল্লাহর লা’নত : কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে, ‘‘যারা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদের জন্য রয়েছে লা’নত এবং মন্দ আবাস।’’ [সূরা রা’দ : ২৫]
৫. সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ হত্যা অপেক্ষা গুরুতর : কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে, ‘‘ফিতনা (অর্থ : প্রলোভন, দাঙ্গা, বিশৃঙ্খলা, যুদ্ধ, শিরক, ধর্মীয় নির্যাতন ইত্যাদি) হত্যা অপেক্ষা গুরুতর।’’ [সূরা বাকারা : ১৯১]
৬. প্রত্যেক মুসলিম এর প্রতি অন্য ভাই এর রক্ত, মাল ও সম্মানকে ক্ষুণœ করা হারাম করা হয়েছে : আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমাদের কোন ভাই যাতে করে অন্য মুসলিম ভাইকে ছোট না করে অর্থাৎ তার মান ও সম্মান ক্ষুণœ না করে। কেননা প্রত্যেক মুসলিম এর প্রতি অন্য ভাই এর রক্ত, মাল ও সম্মানকে ক্ষুণœ করা হারাম করা হয়েছে। (রক্ত দ্বারা উদ্দেশ্য হত্যা করা।” [সহীহ মুসলিম-৪/১৯৮৬, হাদীস-২৫৬৪]
৭. কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম হত্যা সম্পর্কিত মোকদ্দমার ফায়সালা হবে : “কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে মোকদ্দমার ফায়সালা হবে তা হলো, রক্তপাত বা হত্যা সম্পর্কিত।” [বুখারি : ৬৩৫৭]
৮. কবিরা গোনাহসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় গোনাহ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “কবিরা গোনাহসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় গোনাহ হলো আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করা, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া এবং মিথ্যা কথা বলা।” [বুখারি : ৬৮৭১, মুসলিম : ৮৮]
৯. হত্যাকৃত ব্যক্তি কিয়ামতের দিবসে হত্যাকারী সম্পর্কে বলবে ‘হে প্রভু সে আমাকে হত্যা করেছে : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “হত্যাকৃত ব্যক্তি কিয়ামতের দিবসে হত্যাকারীর মাথার অগ্রভাগ নিজ হাতে ধরে এমনভাবে নিয়ে আসবে যে হত্যাকারীর গলার রগসমূহ থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকবে। তখন হত্যাকৃত ব্যক্তি এ কথা বলতে বলতে হত্যাকারীকে আরশের কাছে নিয়ে আসবে ‘হে প্রভু সে আমাকে হত্যা করেছে।” [মুসনাদে আহমদ : ২৫৫১, তিরমিজি : ২৯৫৫]
লেখক: মুহাদ্দিস, পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড মাদরাসা কুমিল্লা।