তারেকুল ইসলাম
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বাংলাদেশের একশ্রেণীর সেকুলাররা ভাবেন, ভাষা-আন্দোলন এদেশের সর্বস্তরের তথা গণমানুষের সেকুলার মন-মানসিকতার ফল এবং শুধু ভাষা-আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি মুসলমান তাদের আত্মপরিচয় সন্ধান করেছে। প্রকৃতপক্ষে তারা ভাষা-আন্দোলনের চেতনা ও ইতিহাস বিকৃত করছেন।
কারণ এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমান ৪৭-এর দেশভাগের সময় প্রধানত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উচ্ছেদকল্পে বিশেষত প্রজাপীড়ক হিন্দু জমিদারশ্রেণীর শোষণ থেকে মুক্তিলাভের জন্যই পাকিস্তানের সাথে গাঁটছড়া বাঁধে।
কিন্তু পরবর্তীতে পশ্চিম পাকিস্তানের জালিম শাসকদের অত্যাচার ও বঞ্চনা দিনে দিনে বাড়তে থাকলে পূর্বপাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানেরা ফ্যাসিবাদবিরোধী ও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে।
ঠিক এসময় মাতৃভাষার ওপর আঘাত এলে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলিম সমাজ ইসলামি চেতনা ও মুসলিম জাতিসত্তার কথা ভুলে গিয়ে মাতৃভাষার দাবিতে রাজপথে নেমে সেকুলার চেতনায় উদ্ভাসিত হয়েছে— সেকুলারদের এমন ধারণা শুধু উদ্ভটই নয়, এর নেপথ্যে রয়েছে ইসলামের প্রতি তাদের সুপ্ত ঘৃণা ও বিদ্বেষও।
আমাদের ভাষা-আন্দোলন ফ্যাসিবাদবিরোধী ও জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের চিরন্তন লড়াইয়ের প্রেরণাদীপ্ত অনুষঙ্গ হিসেবে দেদীপ্যমান। এক্ষেত্রে ইসলামের জুলুমবিরোধী চেতনাও অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল, যা ভাষা-আন্দোলনের জনক সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের আদর্শ ও ভূমিকায় লক্ষণীয়।
অথচ তথাকথিত সেকুলার আবেগ ও উগ্র বাঙালি জাতিবাদী চেতনা দ্বারা আমাদের রক্তাক্ত ভাষা-আন্দোলনের মূল স্পিরিটকে এতদিন ধরে কলুষিত ও বিকৃত করা হয়েছে। এই ইসলামবিদ্বেষী সেকুলার আবেগ ও উগ্র বাঙালি জাতিবাদকে পরাজিত করা না গেলে বাঙালি মুসলমানের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভবিষ্যত অন্ধকার দেখি।
মাতৃভাষা সকল জাতির ন্যায্য অধিকার, সেদিন এ অধিকার যারা কেড়ে নিতে চেয়েছিল তারা স্বধর্মের লোক হলেও অন্যায় করেছিল আমাদের সাথে। তাই আমরা আমাদের অধিকার আদায়ে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম।
কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমাদের ইসলামি চেতনা ও মুসলিম জাতিসত্তার সাথে ভাষা-আন্দোলনের কোনো বিরোধ ছিল। বরং আমাদের নিজস্ব তাহজিব তমদ্দুন, স্বাতন্ত্র্য ও আত্মচেতনা রক্ষার মূল অবলম্বন হয়ে পড়ে ভাষা-আন্দোলন।
আজকে এদেশের অথর্ব সেকুলাররা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সবকিছুকেই সেকুলারাইজ করার প্রয়াস চালায়। প্রকৃতপক্ষে, ভাষা-আন্দোলনের সাথে সেকুলার চেতনার কোনো সংযোগই ছিল না, পরোক্ষভাবেও না।
সাধারণত বায়ান্ন’র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মিছিলে সালাম-রফিক-বরকত-জব্বারের গুলিবিদ্ধপূর্বক শহীদ হওয়া দিয়েই আমরা লেখা শুরু করি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বায়ান্ন’তে যারা মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন, যারা পাক হানাদারের বুলেটবৃষ্টির মুখে শহীদ হলেন—সেদিন তাদেরকে ভাষা-আন্দোলনে নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা দিয়েছিল কোন সংগঠন?
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বছর তথা ১৯৪৭-এর দেশবিভাগের বছরেই ভাষা-আন্দোলন শুরু হয় তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে। পরবর্তীতে তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল।
যাই হোক, সংগঠনটির পুরো নাম ছিল পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস। পূর্বপাকিস্তান তথা বাংলাদেশ তখনো পাকিস্তান থেকে পৃথক না হওয়ায় সংগঠনটির নামের আগে ‘পাকিস্তান’ শব্দটি ছিল।
এ কারণেই এই সংগঠনের নাম মুখে নিতে বা লিখতে তথাকথিত সেকুলার প্রগতিশীলদের এত এলার্জি! উগ্র সেকুলার বাঙালি জাতিবাদ চর্চার ফলে তারা পাকিস্তান ও উর্দু ভাষার প্রতি একাট্টা ঘৃণা বা রেইসিজমের চর্চা করে যাচ্ছেন এবং শোভেনিজমের মোহে তারা ভয়ঙ্করভাবে নিমজ্জিত!
কিন্তু আমরা এখন বুঝি, আমাদের সেকুলার বর্ণচোরা প্রগতিশীলদের পাকিস্তানফোবিয়ার নেপথ্যে মূল অনুঘটক হচ্ছে ইসলামোফোবিয়া। তাদের কথিত ‘পাকিস্তানের ভূত’-এর পলিটিক্যাল মিনিং হলো- ইসলামি ভূত। সুতরাং সেকুলারিজম ও চেতনাবাজির আড়ালে তারা মূলত ইসলামের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ চর্চার অপরাজনীতিই করে থাকেন।
তমদ্দুন মজলিসের মূল উদ্দেশ্য ছিল, এদেশে বিপ্লবী ইসলামি আদর্শের প্রতিষ্ঠা এবং পূর্বপাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিকে সার্থক আন্দোলনে রূপদান করা। অথচ আজকে ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস ও চেতনা বিকৃত করে ইসলামি তাহজিব-তমদ্দুন থেকে বাঙালি মুসলমানকে বিচ্যুত করার সেকুলার প্রয়াস বিদ্যমান।
আর বাংলাভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে এই পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমানরাই। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা সাতচল্লিশেই হিন্দিকে তাদের জাতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে ভারতের সাথে থেকে গিয়েছিল। ভারতে বাংলার রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা আদায়ের দাবিতে তারা কখনো লড়াই করেনি। পক্ষান্তরে, বুকের রক্ত দিয়েই বাঙালি মুসলমান বাংলাভাষার মর্ম বুঝেছে।
অন্যদিকে, সর্বত্র হিন্দির দাপটে কলকাতায় আজ বাংলাভাষা শ্রীহীন ও ক্ষীণকায় হয়ে পড়েছে। এমনকি কলকাতার বাংলাভাষী ঔপন্যাসিক ও সাহিত্যিকদের বইয়ের বিশাল চাহিদা ও মূল বাজারও বাংলাদেশে। সুতরাং, সব বিবেচনায় এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, বাংলাভাষার আগামী দিনের ভবিতব্য ঢাকাকেন্দ্রিক বাঙালি মুসলমানের হাতেই সপ্রাণ ও সবাক জেগে থাকবে, ইনশাআল্লাহ।
প্রসঙ্গক্রমে, ভারতবর্ষের জাতীয় ভাষা বা রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের অভিমত জানা জরুরি। আমরা তো শুধু জিন্নাহকেই দোষারোপ করি উর্দুর প্রতি তার পক্ষপাতিত্বের কারণে। অথচ খোদ রবীন্দ্রনাথও ভারতের জাতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দিকেই সমর্থন করতেন, বাংলাকে নয়!
১৯১৮ সালে বিশ্বভারতী’তে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় হিন্দি ভাষার পক্ষে রবীন্দ্রনাথের ওকালতির বিরোধিতা করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেকে বাংলা ভাষা হিন্দি অপেক্ষা উন্নততর এবং বাংলাকেই ভারতের সাধারণ ভাষায় পরিণত করা যেতে পারে।’
স্বাধীনতা পেলে ভারতবর্ষের জাতীয় ভাষা বা রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ সম্পর্কে জানতে চেয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে একটা পত্র লিখেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তখন গান্ধীর পত্রের জবাবে হিন্দির পক্ষে অভিমত দিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: The only possible national language for inter-provincial intercourse is Hindi in India. অর্থাৎ, আন্তঃপ্রাদেশিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভারতের একমাত্র সম্ভাব্য জাতীয় ভাষা হতে পারে হিন্দি। (প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্র বর্ষপঞ্জী, কলকাতা, ১৯৬৮, পৃষ্ঠা-৭৮)।
এটাও পড়ুন: ‘নবী নুহ আ. এর প্রপৌত্র থেকেই বাংলাভাষার প্রচলন ঘটেছিল’