মুহাম্মদ জিয়াউল হক
ঢাকার পথে পথে ছিটানো একুশের রক্তে রচিত হয়েছে এ দেশের ভাষাময় রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, অর্থনীতি ও ধর্মের অভূতপূর্ব বিকাশ ৷
৫২' র পর হতেই কার্যত ইসলামের পন্ডিতগণ এ ভাষায় ধর্মীয় সাহিত্য চর্চার একটি বাস্তবিক ও ঐতিহাসিক তাগাদা অনুভব করেন ৷ নানা সাময়িকী ও নিয়মিত নৈতিক পত্রিকা প্রকাশের একটা জোয়ারের সূচনা হয় এ দেশের ধর্মীয় অঙ্গনে ৷
কাজেই এটা অনস্বীকার্য যে এ দেশের মানুষের আত্নচেতন তৈরিতে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টিতে, স্বকীয় সংস্কৃতির চর্চায় ঐতিহ্যিক অনুজাগৃতি ঘটাতে এবং সর্বশেষে মাতৃভাষায় ধর্মের রূপায়নে একুশ চির অনির্বাণ ৷ ৫২ চির মহীয়ান ৷
রাষ্ট্রভাষা আলোচনার সূত্রপাত
১৯৪৭সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করলে মুসলিম মনীষী বরেন্য ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ জ্ঞানগর্ভ যুক্তি দিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পাল্টা প্রস্তাব করেন।
৪৭ সালেই বুদ্ধিজিবী, শিক্ষক, ছাত্রসমাজে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আলোচনা ও সচেতনতা সৃষ্টি হয়।
তমদ্দুন মজলিশ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেমের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর এ সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা- বাংলা না উর্দু?’ শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশ ও বিভিন্ন সাহিত্যসভা আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাংলার পক্ষে এ সংগঠন ব্যাপক জনমত গঠনে ভূমিকা রাখে।
গণপরিষদে ভাষা বিতর্ক
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইরেজির সাথে বাংলাকেও গণপরিষদের সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব দেন। ২৫ তারিখ এ বিষয়ে বিতর্কের পর প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়।
শাসকগোষ্ঠীর গোঁড়া যুক্তি
গণপরিষদ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান মন্তব্য করেন, ‘একটি সাধারণ ভাষার মাধ্যমে পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যবন্ধনের যে প্রয়াস চালানো হচ্ছে তা বানচাল করার জন্যই বাংলা ভাষার প্রস্তাব করা হচ্ছে। অতএব, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র সরকারি ভাষা। অন্য কোন ভাষা নয়’।
শাসকগোষ্ঠী এ দাবিকে সাম্প্রদায়িক, রাষ্ট্রদ্রোহী ষড়যন্ত্র এবং ঐক্য বিনাশের প্রচেষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করে।
শুরু হলো আন্দোলন
গণপরিষদে প্রস্তাব নাকচের পর ছাত্র, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবিমহল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করেন। তমদ্দুন মজলিশের সম্পাদক আবুল কাশেমের সভাপতিত্ত্বে ১৯৪৮ সালের ২৬ই ফেব্রুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ
আন্দোলনের গতি সঞ্চারের লক্ষ্যে ১৯৪৮সালের ২ মার্চ ঢাকার ফজলুল হক হলে তমদ্দুন মজলিশ, গণ-আজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ইত্যাদি সংগঠনের দুইজন করে প্রতিনিধি নিয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১১মার্চ ১৯৪৮ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট আহবান করেন। ঐ দিন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে পুলিশের লাঠিচার্জে ৫০জন ছাত্র গুরুতর আহত হয়।
মুখ্যমন্ত্রীর সাথে বৈঠক
আন্দোলনের তীব্রতায় মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন ১৫মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সাথে বৈঠক করে ৮দফা চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যুক্তি
পাকিস্তানের ৫৬.৪০% লোকের ভাষা বাংলা। পক্ষান্তরে উর্দূভাষী লোক মাত্র ৩.২৭%। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে এ ভাষা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হওয়ার দাবিদার। তাছাড়া পৃথিবীর বহুদেশে ২টি, ৩টি এমনকি ১৭টি পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা রয়েছে।
এ ভাষার ৫০ভাগ শব্দ আরবি ও ফার্সী থেকে গৃহিত। নজরুল, ফররুখ, আলাওল, ওয়াজেদ আলী ও জসীম উদ্দীনসহ বহু মুসলিম লেখক এ ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন। তাই একে হিন্দুদের ভাষা বলা হাস্যকর।
উর্দূকে রাষ্ট্রভাষা করার স্বার্থবাদী রহস্য
পাকিস্তান সৃষ্টির পর নতুন রাষ্ট্রের শাসনভার যে রাজনীতিবিদ ও আমলাদের হাতে যায়, তারা অধিকাংশই ছিলেন উত্তর ভারতের উর্দূভাষী লোক।
নতুন রাষ্ট্রের ব্যবসা, ব্যাংকিং, উচ্ছ চাকরি ও প্রশাসনিক ক্ষমতা যেন এই স্বার্থবাদী এলিট শ্রেণির হাত ফসকে বাংলাভাষী সাধারণ পশ্চাদপদ মুসলিম জনতার হাতে চলে না যায় এ স্বার্থবাদী চিন্তাই ছিলো মাত্র ৩.২৭ভাগ লোকের ভাষাকে সরকারি ভাষা করার গূঢ় রহস্য।
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
ধীরে ধীরে শাসকগোষ্ঠীর ছল-চাতুরির সাথে চলছিলো আন্দোলন। ৫২তে জিন্নাহ ও নাজিমুদ্দীনের ঘোষণা ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ এর সাথে সাথে জ্বলে উঠলো আগুনের ফুলকি।
বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বয়ে মাওলানা ভাসানীকে সভাপতি করে গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল, বিক্ষোভ মিছিল ও সভা কর্মসূচি ঘোষণা করে।
ইফোর্ট: টি শার্টে আধুনিকতা ও শালীনতার সমন্বয়
প্রশাসনের ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে রাজপথে নেমে আসে বাংলার চির সংগ্রামী, অকুতোভয় ছাত্র সমাজ। বেলা দু’টা পর্যন্ত ছাত্ররা অকাতরে পুলিশি নির্যাতন ও গ্রেফতারি বরণ করেন। বেলা সোয়া ৩টায় উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে পুলিশ নির্বিচারে গুলি ছুড়ে।
মুহুর্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আমাদের গৌরবদীপ্ত চেতনার অবিনাশি মিনার আব্দুল জাব্বার ও রফিক উদ্দিন আহমদ। আহত হন ১৭জন।
আন্দোলনের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে দু’জন মাওলানা
এ সময় আন্দোলনরত ছাত্রদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন বরেণ্য দুই আলেম রাজনীতিবিদ মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ৷
একুশের অমর শহীদান
ঘটনার পর নেতৃবৃন্দের আত্ম-গোপনের কারণে ঐ দিনের শহীদ তালিকার সঠিক তথ্য আজও অজানা। ২১ তারিখ ও তার পরে অন্তত ৬জন শহীদের পরিচয় পাওয়া যায়।
তারা হলেন, ১।একুশের প্রথম শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ। মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজের ছাত্র ছিলেন।
২।শহীদ আবুল বরকত। গ্রামের বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন।
০৩।শহীদ শফিউর রহমান। হাইকোর্টের কর্মচারী ছিলেন।
০৪। শহীদ আব্দুল জব্বার। পেশায় একজন দর্জি। বাড়ি গফরগাঁওয়ে।
০৫। শহীদ অহি উল্লাহ। বয়স ৮ কি ৯ বছর। রাজমিস্ত্রি হাবিবুর রহমানের ছেলে। তিনি নবাবপুর রোডে খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে হঠাৎ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
০৬। শহীদ আবদুস সালাম। ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবিদ্ধ হয়ে ৭ এপ্রিল মারা যান। তিনি একজন সরকারি পিওন ছিলেন। বাড়ি ফেনী জেলার লক্ষণপুর গ্রামে। তার মৃত দেহের সন্ধ্যান পাওয়া যায়নি।
যবনিকা
ভাষা আন্দোলন আমাদের যে কোন জাতীয় সংগ্রামের এক চির উজ্জ্বল, প্রোজ্জ্বল ,অবিনাশি ভাষ্কর চেতনা। ৫২’র জানা অজানা শহীদদের আত্ম-ত্যাগের বিনিময়ে ৫৬ তে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়া হয়।
ভাষা আন্দোলনের সূচনা ও শেষ বা পরিপূর্ণতা ৫২ তে না হলেও মাতৃভাষার রাষ্ট্রিক স্বীকৃতি আদায়ে এবং বাংলা ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ও বাঙলা কেন্দ্রিক নব সাংস্কৃতিক বিকাশ ধারায় এবং ৫২ পরবর্তিতে উন্মোচিত ভাষা প্রভাবিত রাজনীতির নতুন আদর্শিক মানদণ্ড তৈরিতে সর্বপরী আমাদের শিক্ষা ও সমাজ ব্যাবস্থায় এমনকি ধর্মের নানা অনুষঙ্গে বাংলা ভাষার যে জয়যাত্রা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের সীমান্তে আছড়ে পড়েছে তার কৃতিত্ব বিশেষত একুশের ভাষা শহীদ ও ভাষা সৈনিকদের ৷
লেখক: স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সম্পাদক, ইশা ছাত্র আন্দোলন, পরিচালক,ইসলামী সাহিত্য বিকাশ সংসদ
তথ্যসূত্র
০১। বাংলাদেশের ইতিহাস (১৯৪৭-৭১। ড.মাহবুবুর রহমান।
(অধ্যাপক- ইতিহাস বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)
০২। বাংলাদেশের ইতিহাস (১৯০৫-৭১)। ড. আবু মোঃ দেলোওয়ার হোসেন।
(অধ্যাপক- ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল)