সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পূর্ণ হলো এমন এক সময় যখন জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
হামাস বায়তুল মুকাদ্দাসকে মুক্ত করার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বায়তুল মুকাদ্দাসের মর্যাদা রক্ষা করার জন্য সংগঠনটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি নতুন করে আহ্বান জানিয়েছে।
এছাড়া, বায়তুল মুকাদ্দাস ও আল-আকসা মসজিদের বিষয়ে কোনো রকমের ভুল পদক্ষেপ নিলে ইসরাইলকে তার মূল্য দিতে হবে বলেও হামাস উল্লেখ করেছে।
এদিকে, হামাস ও ফাতাহর মধ্যে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে ওঠেছে। গাজার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ মাহমুদ আব্বাসের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। অবশ্য এক্ষেত্রে হামাসের সশস্ত্র লড়াইয়ের স্বাধীনতা থাকছে।
এমন পরিস্থিতিতে গাজায় বেসামরিক লোকজনের ওপর ইসরাইলের বর্বরোচিত হামলা অব্যাহত রয়েছে। আরেকটি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরাইল।
উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট, যতটা সংখ্যক ফিলিস্তিনির সংখ্যা কমিয়ে আনা যায়। বেসমারিক হোক বা প্রতিরোধ যোদ্ধা, ফিলিস্তিনি নাগরিকদের যেকোনো উপায়ে হত্যা ইসরাইলের অঘোষিত কোনো নীতি নয়। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে কিছুদিন পরপর এভাবে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। ফলে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড আজ আর নতুন কিছু নয়।
জাতিসঙ্ঘের ১৯৪৭ সালের পৃথকীকরণ বা বিভাজন আইন অনুসারে, অধিকৃত জেরুজালেম কখনো কোনো দেশের রাজধানী হতে পারে না। আন্তর্জাতিক সরকারের অধীনে একটি বিভক্ত শহরের সার্বভৌমত্ব ইসরাইল বা ফিলিস্তিন কারও হতে পারে না।
১৯৪৮ সালে যখন ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং ইসরাইলি সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনের ৭৮ শতাংশ ভূখণ্ড দখল করার জন্য অগ্রসর হয়েছিলেন, তখন তারা পশ্চিম জেরুজালেমের অর্ধেকেরও বেশি এলাকা দখল করে নেয়।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল পশ্চিম তীর ও গাজা ভূখণ্ডের অবশিষ্টাংশ দখল করে নিলে জেরুজালেমের পূর্বাঞ্চলও ইসরাইলের সামরিক শাসনের আওতায় চলে যায়।
১৯৪৮ সাল থেকে ইসরাইল অনেকবার অধিকৃত জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী ঘোষণার উদ্যোগ নিলেও বিশ্বের একটি দেশও তাদের এই উদ্যোগের প্রতি সমর্থন দেয়নি। তাদের দাবিকে কেউ মেনে নেয়নি। এর একটি মাত্র কারণ হলো- জোরপূর্বক কোনো ভূখণ্ড দখল করা আন্তর্জাতিক আইনে বেআইনি বা অবৈধ।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, তার প্রশাসন অধিকৃত জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তিনি দাবি করেন, ‘এতে শান্তিপ্রক্রিয়া এগিয়ে যাবে এবং একটি স্থায়ী চুক্তি স্বাক্ষর করার লক্ষ্যে এই ঘোষণা কাজ করবে।’
বলা যায়, এক্ষেত্রে প্রায় ৭০ বছরের মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে বাতিল করে দিয়ে ট্রাম্প ওই ঘোষণা দিলেন। এটা কেবল ট্রাম্পের ভুলই নয়, বরং তার এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে আইনের শাসনের পরিবর্তে আগ্রাসনের ভিত্তিতে হুমকি প্রদানের নজির স্থাপন করে একটি নতুন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হলো।
ডেমোক্র্যাটিক এবং রিপাবলিকান উভয় দলের প্রেসিডেন্টদের বেশ কয়েক বছরের নিষ্ক্রিয়তার পর ট্রাম্পের জেরুজালেম ও মধ্যপ্রাচ্য শান্তিপ্রক্রিয়া নিয়ে এই বক্তব্য এলো।
ট্রাম্প যে ‘শান্তিপ্রক্রিয়া’ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাবি করেছেন, প্রকৃতপক্ষে তাতে কেবল ইসরাইলকে অব্যাহতভাবে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড চুরি করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন ট্রাম্প ইসরাইলকে যে বার্তা দিয়েছেন, তাতে স্পষ্টত আমেরিকা ইসরাইলের অবৈধ কর্মকাণ্ড মেনে নিয়েছে এবং ইসরাইলের ব্যাপারে কাউকে পরোয়া করবে না যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ তাদের প্রতি অন্ধ সমর্থন অব্যাহত রাখবে।
১৯৯৩ সালে শান্তি আলোচনা শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত পশ্চিম তীরের অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড এবং অধিকৃত পূর্ব জেরুসালেমে অবৈধ ইসরাইলি কলোনির সংখ্যা তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯৩ সালে এই অবৈধ ইহুদি কলোনি ছিল দুই লাখ আর এখন তা ছয় লাখেরও বেশি।
বিশ্ব জেরুজালেমকে যে আন্তর্জাতিক নগরী করার আহ্বান জানিয়েছিল, তা দূরের কথা- এখন ইসরাইলের অধিকৃত জেরুজালেমকে ইহুদিদের শহর তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে পরিকল্পিতভাবে এমনসব নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে, যাতে অধিকৃত জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিদের জীবনযাপন করা অসম্ভব হয়ে ওঠে।
পার্শ্ববর্তী, অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজায় যেসব ফিলিস্তিনি মুসলমান ও খ্রিষ্টান বসবাস করেন, তাদের নগরীতে পবিত্র স্থানগুলোতে গিয়ে প্রার্থনা করার জন্য ইসরাইলের অনুমতি নিতে হয়। অধিকৃত জেরুজালেমকে যারা ফিলিস্তিনিমুক্ত করতে চায়, ট্রাম্পের ঘোষণা কেবল তাদের উৎসাহিত করবে।
মধ্যপ্রাচ্য শান্তির নামে একাধিক চুক্তি হয়েছে। এর বিনিময়ে ফিলিস্তিনিরা হারিয়েছে স্বজন আর ভূখণ্ড। ১৯৯৩ ও ১৯৯৫ সালে অসলোতে চুক্তি হয়েছে। এই চুক্তি বাস্তবায়নে ২০০০ সালে ক্যাম্প ডেভিডে, ২০০৩ সালে তাবায়, ২০০৭ সালে আনাপোলিসে এবং ২০১০ সালে ওয়াশিংটনে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু ফলাফল শূন্য। এখন জেরুজালেমকে রাজধানী ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
বাস্তবতা যখন এই- নিরিহ ফিলিস্তিনীদের উপর হামলা, মুসলমান হত্যা এবং ইসরইলের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে এ মুহূর্তে বিশ্ব মুসলিমকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ইহুদীদের সকল পণ্য রাষ্ট্রীয়ভাবে বয়কট করতে হবে। অতি দ্রুত মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের জরুরি ভিত্তিতে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। এককথায়, ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিশ্ব মুসলিমকে গর্জে উঠতে হবে।
লেখক : কবি, গবেষক ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম