সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
বেড়েই চলেছে চালের দর। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৬০ টাকার মিনিকেটের দাম বেড়েছে কেজিতে দুই টাকা। মোটা চালের দামও বাড়তির দিকে। এরই মধ্যে বাণিজ্যমন্ত্রীর এমন বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে যে, চালের দাম ৪০ টাকার নিচে নেমে আসাটা ‘বাস্তবসম্মত’ নয়। তিনি সম্ভবত মোটা চালের দাম বোঝাতে গিয়েই করেছেন উক্তিটা। এর দাম এখন কেজিপ্রতি ৪০ টাকার বেশি; ৫০-এর কম।
মনে পড়ে গেল-অর্থমন্ত্রী একসময় সোনালী ব্যাংকের ৪ হাজার কোটি টাকা অর্থ আত্মসাৎকে ‘পিনাট’ অর্থাৎ চীনাবাজারের মতোই তুচ্ছ ব্যাপার বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। সে কারণেই হয়তো ঘটনার পর বেশ কয়েক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও অদ্যাবধি ওই লুটেরা চক্র স্বাচ্ছন্দ্যে বিলাসী জীবন যাপন করছে। আর দরিদ্ররা চড়া দামে চাল কিনতে না পেরে নীরবে কাঁদে।
গত ১০ বছরে পাঁচ ধরনের চালের দাম নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়। সেখানে দেখা যায়, সব ধরনের চালের দাম ১০ বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয়েছে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই বিশ্লেষণ করা হয়।
গত ১০ বছরে বাংলাদেশে তিনটি সরকার ছিল। ২০০৬ সালের শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। ওই সময় চালের দাম যা ছিল গত ১০ বছরে তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
২০০৭ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে ফখরুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দুই বছর ওই সরকার দেশ পরিচালনা করে। ওই সময় থেকে চালের দাম বাড়তে থাকে। পরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দেশ পরিচালনা করেন। ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে ওই পাঁচ ধরনের চালের দাম কিছুটা কমেও যায়। কিন্তু পরে দ্রুত বাড়তে থাকে। ২০১৪ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে দেশ পরিচালনা শুরু করে শেখ হাসিনার সরকার। গত তিন বছর শেষে বেড়েছে সব ধরনের চালের দাম। কিন্তু কেন?
ক্যাবের দেওয়া তালিকায় দেখা যায়, মিনিকেট চালের দাম ২০০৬ সালে ছিল প্রতি কেজি ২৭ টাকা ৯৫ পয়সা। ২০১৬ সালে ওই চালের দাম হয় ৪৮ টাকা ৩৪ পয়সা। ২০০৬ সালে নাজিরশাইলের দাম ছিল ২৫ টাকা ৫৪ পয়সা। ২০১৬ সালে ওই চালের দাম হয় ৫৫ টাকা ৭৮ পয়সা। ২০০৬ সালে পাইজাম চালের দাম ছিল ২৩ টাকা। গত বছর ওই চালের দাম ছিল ৪০ টাকা ৩৭ পয়সা। ২০০৬ সালে পারিজা / স্বর্ণার দাম ছিল ১৯ টাকা ২৫ পয়সা। গত বছর ওই চালের দাম ছিল ৩৭ টাকা ১৯ পয়সা। ২০০৬ সালে বিআর এগারো / আটের দাম ছিল ১৮ টাকা ২৫ পয়সা। গত বছর ওই চালের দাম ছিল ৩৫ টাকা ৪১ পয়সা।
আমনের এই ভরা মৌসুমে প্রতি বছর চালের দাম কমলেও এবার তার উল্টো চিত্র। গত দুই সপ্তাহে প্রতি কেজি চালে ৩ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। আমদানি শুল্ক কমানো, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে খাদ্য আমদানি বৃদ্ধি, আমনের ভরা মৌসুম সবকিছু মিলিয়ে যখন দাম আরও কমার কথা তখন দাম বৃদ্ধিতে স্বল্প আয়ের মানুষ বিপাকে পড়েছে। এ নিয়ে সরকার কি কিছু ভাবছে?
চলতি বছরে চালের দাম বৃদ্ধির কারণে ৫ লাখ ২০ হাজার মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। আগামীতে চাল উৎপাদন, আমদানি ও সরবরাহ ঠিক রাখতে একটি কার্যকর চাল নীতিরও প্রস্তাব করছে ওই প্রতিষ্ঠানটি।
সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)’র একটি অনুশীলনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ধনবানদের শীর্ষে ৫%-এর আয়-রোজগার সর্বনিম্নের ৫%-এর চেয়ে ১২১ গুণ বেশি। ২০১০ সালে এটা ৩১.৫ গুণ ছিল। ২০১০ সালে এই শীর্ষ ৫% বিত্তশালীর সম্পদ ছিল গরিব ৫%-এর সম্পদের ১১৭৬ গুণ। এখন তারা গরির ৫%-এর চেয়ে ২৫০০ গুণ বেশি সম্পদশালী। এ দেশের শতকরা ৯৭ ভাগ মানুষ বিপৎসংকুল পরিস্থিতিতে জীবনযাপন করে। এর মধ্যে গ্রামের মানুষ সবচেয়ে বেশি অবহেলিত, নিগৃহীত। আর এর মাশুল দিচ্ছে এ দেশের ৯০ ভাগ সাধারণ মানুষ। যারা ভ্যাট, কাস্টমস, একসাইজ এবং এআইটি দিয়ে বাংলাদেশের রাজস্ব সম্ভার পূর্ণ করছে। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের বার্তাটি আজ খুব মনে পড়ে : ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় / কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি / পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’
বাস্তবতা পর্যালোচনায় বলা যায়-সরকারই চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ান-কমান। যে কারণে অন্তত এক বছর জনগণকে ‘গিনিপিগ’ করে কৃত্রিম দাম বাড়িয়ে এর ফলাফল না দেখে কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তাৎক্ষণিক রিপোর্টের তোয়াক্কা করে না সরকার। জনগণের দুঃখ-দুর্দশা বাড়ছে, না কমছে তা নিরূপণ করতে প্রয়োজন হয় এক বছরের সময়।
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ যে ইশতেহার দিয়েছিল তাতে দিনবদলের ওয়াদা ছিল। রাজনৈতিক আচার-আচরণে সংস্কারের সদিচ্ছা ছিল। আরও ছিল অর্থনৈতিক সংকট মোচনের প্রতিশ্রুতি। ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনার প্রতিজ্ঞা। এরপর দীর্ঘ নয় বছর কেটে গেছে কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি আজও পূরণ হয়নি। ভবিষ্যতে হবে কি?
সবশেষে বলছি, মূল্যস্ফীতি যে বাড়তির দিকে, তার একটা বড় কারণ চালের বাজার। এখনও চাল আমাদের প্রধান খাদ্যপণ্য। তাই ‘খাদ্য নিরাপত্তা’ বলতে আমরা বুঝে থাকি চালের বাজার শুধুই স্থতিশীল থাকা নয়, একই সাথে এর দাম কম থাকাটাও।
লেখক : কবি, গবেষক ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম