আতাউর রহমান খসরু : ৬১৭ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক জোসনা রাত। চণ্ডীগড়ের রাজা চেরমন পরিমল রামা ভরমা রা ছাদে বসে চাঁদের আলোয় অবগাহন করছেন। সঙ্গে বসা রাণী। দূরে অপেক্ষা করছে দাসি-বাদিরা। হঠাৎ রাজা এক আশ্চর্য ঘটনা দেখলেন। তার চোখের সামনে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেলো চাঁদ। আবার একত্র হলো তা। হিন্দু ধর্মমতে বিশ্বাসী রাজার কাছে চন্দ্র দেবতা। দেবতার এমন বেহাল দশা দেখে সেজদায় লুটিয়ে পড়লো সে। না জানি কোনো মহাদেবতার খপ্পরে পড়েছে চন্দ্র দেব!
রাজা ছাদ থেকে নেমে আসলেন। কিন্তু তার দুর্ভাবনা গেলো না। খবর দিলেন রাজ জ্যোতিষীকে। সেও সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারলো না। এদিকে রাজার দুর্ভাবনা বাড়তে লাগলো প্রতিদিন। তার রাজ্যের জন্য কোনো অশনি সংকেত নয় তো? এরপর রাজা জ্ঞানী-গুণী কাউকে কাছে পেলেই তার কাছ থেকে এ ঘটনার ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করতেন।
ঘটনাক্রমে কয়েক বছর পর রামা ভরমার রাজ্য কডুঙ্গুলুর উপস্থিত হন একদল আরব ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ী দল যথা নিয়মে রাজার সঙ্গে দেখা করে তার রাজ্য পরিদর্শন ও ব্যবসার অনুমতি চান।
রাজার সঙ্গে আরব ব্যবসায়ীদের আগ থেকেই সুসম্পর্ক ছিলো। তাদের কাছ থেকে তিনি ইসলাম ও ইসলামের নবি মুহাম্মদ সা. অল্প-বিস্তর জেনেছিলেন। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তিনি সুধারণা পোষণ করতেন। রাজা তাদের নিকটও সেদিন রাতের বিস্ময়কর ঘটনা উত্থাপন করলেন। তারা রাজাকে মুহাম্মদ সা. এর সঙ্গে ঘটে যাওয়া আরবের ঘটনার বিবরণ দিলেন। কিভাবে সেখানে অসংখ্য মানুষের সামনে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত করেন এবং তা আবার জোড়া লাগিয়ে দেন।
তাদের বিবরণ রাজা আরও বিস্মিত হলেন। ইসলাম ও তার নবী মুহাম্মদ সা. এর ব্যাপারে তার আগ্রহ আরও বেড়ে গেলো। কারণ, জ্যোতিষ শাস্ত্র অধ্যয়ন করে জানতে পেরেছিলেন আরবে একজন নবীর আগমন ঘটবে।
তিনি ব্যবসায়ীদের ইসলাম, মুহাম্মদ সা., মদিনার ইসলামি রাষ্ট্র ও তার ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরার অনুরোধ করেন। ব্যবসায়ী কাফেলা তাদের জ্ঞানানুযায়ী তার প্রশ্নের উত্তর দেন।
এ কাফেলায় ছিলেন শায়খ সাহিরুদ্দিন বিন বাকিউদ্দিন আল মাদানি। তিনি বলেন, আমরা রাজাকে বললাম আমরা আরব। আমরা মুসলিম। আমরা সিলন যেতে চাই। রাজা আমাদের নিকট ইসলাম, ইসলামের নবি, মদিনাবাসী ও মদিনার ইসলামি রাষ্ট্র সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলেন।
সাহিরুদ্দিন বলেন, আমাদের বিবরণ শুনে রাজা চেরমান রামা ভরমা ইসলামগ্রহণ ও তাদের সঙ্গে মুহাম্মদ সা. এর সঙ্গে দেখার করার আগ্রহ প্রকাশ করে।
[এ ঘটনার বিবরণ রয়েছে এম হামিদুল্লাহ-এর ‘মুহাম্মদ রাসুলুল্লাহ’, উইলিয়াম লগন-এর মালাবর মেন্যুয়াল, আহমদ জিয়াউদ্দিন মাখতুম-এর তাহাফাতুল মুজাহিদিন ইত্যাদি গ্রন্থে।]
মক্কা যাওয়ার আগে রাজা তার রাজ্যকে তিনভাগে ভাগ করে তার ছেলে ও নাতিদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। তিনি তার আত্মীয়-স্বজন ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরবর্তীতে রাজ্য পরিচালনার বিষয়ে নির্দেশনা দিলেন।
এরপর তিনি তার মেয়ে শ্রীদেবীকে দেখতে কালাঙ্কারা গেলেন এবং তার মক্কা সফর ও ইসলামগ্রহণের সিদ্ধান্তের কথা জানালেন। শ্রীদেবীর ছেলেকে তিনি বর্তমান কনৌর জেলার শাসনভার অর্পণ করেন। সে পরবর্তীতে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন। ইসলামগ্রহণের পর তার নাম হয় মুহাম্মদ আলী। তিনি কনৌর আরাক্কাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা।
সিহারুদ্দিনদের প্রতিনিধি দলের গন্তব্য ছিলো সিলন। তারা সেখানে গিলেছিলেন ব্যবসার পাশাপাশি হজরত আদম আ. এর আগমনের স্থান দেখতে। যা বর্তমান শ্রীলঙ্কায় অবস্থিত। রাজা তাদের অপেক্ষা করেন এবং নিজের রাজ্য ভাগসহ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন।
কাফেলা ফিরে আসার পর তিনি তাদের সঙ্গে আরবের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। রাজা তাদের সঙ্গে ‘মুকাল্লা’ উপকূলে মিলিত হন।
[বালা কৃষ্ণ পিল্লাই তার ‘হিস্টোরি অব কেরেলা : এন ইন্ট্রুডাকশন’ বইতে এ ঘটনার বিবরণ দিয়ে দাবি করেছেন রাসুল সা. এর সঙ্গে রাজার সাক্ষাৎ হয়।]
সাগর পথে সফর করে রাজা চেরমান রামা ভরমা রাসুল সা. এর দরবারে উপস্থিত হন এবং ইসলামগ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণ করার পর রাসুল সা. তার নাম রাখেন তাজুদ্দিন। ইসলামগ্রহণের পর তাজুদ্দিন রা. হজপালন করেন।
সহি বুখারিতে এ ঘটনার সমর্থনে একটি হাদিস পাওয়া যায়। হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একজন ভারতীয় রাজা রাসুলুল্লাহ সা. কে এক বোতল আচার উপহার দেন। যাতে ছিলো আদা। রাসুল সা. তা সাহাবিদের মাঝে বণ্টন করেন এবং নিজেও এক টুকরো খাওয়ার জন্য নেন।
মুস্তাদরেকে হাকিমের বর্ণনায় এসেছে রাসুল সা. আমাকেও এক টুকরো দেন।
রাসুল সা. এর নির্দেশে হজরত মালেক ইবনে দিনার রা. এর নেতৃত্বে একদল সাহাবি তাজুদ্দিনের সঙ্গে ভারতে ইসলাম প্রচারের জন্য যাত্রা করেন।
কিন্তু নিজ দেশে ফেরার পূর্বেই রাস্তায় রাজা অসুস্থ্য হয়ে পড়েন এবং মারা যান।
বর্তমান ওমানের সালালাহ (পূর্ব নাম জাফর) নামক স্থানে রাজাকে দাফন করা হয়। এখনও সেখানে তাজুদ্দিন রা. এর কবর সংরক্ষিত আছে। বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ তার কবর জিয়ারত করেন।
রাজা মারা যাওয়ার পূর্বে তার সন্তানের উদ্দেশে চিঠি লিখে মালিক ইবনে দিনার রা. সর্বাত্মক সহযোগিতার নির্দেশ দেন।
কডুঙ্গুলুর (বর্তমান মুসরিস) এ পৌঁছানোর পর মালিক ইবনে দিনার রাজার ছেলে সঙ্গে দেখা করেন এবং চিঠি হস্তান্তর করেন। রাজার ছেলে ইসলাম প্রচারের কাজে তাকে সহযোগিতা করেন। মালিক ইবনে দিনার ও তার সহকর্মীরা কেরেলায় ১২টি মসজিদ নির্মাণ করেন। প্রথম নির্মাণ করেন চেরমান মসজিদ। চেরমান রাজার প্রতি সম্মান দেখিয়ে মসজিদের নাম চেরমান মসজিদ রাখা হয়।
যদিও বিষয়টিকে বিতর্কিত করতে কোনো ঐতিহাসিক বলেন আরাথলি মন্দিরকে মসজিদে রূপান্ত করা হয়।
ভারতের কর্ণকটের বুতকালে মালিক বিন দিনার রা. এর মৃত্যু হয়। মজার বিষয় হলো বুতকাল ও সালালাহ (তাজুদ্দিন রা. কে যেখানে) উভয়টি আরব সাগরের দুটি দ্বীপ।
ধারণা করা হয়, রাজা তাজুদ্দিন রা. প্রথম শাসক যিনি রাসুল সা. এর হাতে ইসলামগ্রহণ করেন।
সংক্ষিপ্ত সময় রাসুল সা. এর সঙ্গে অতিবাহিত করলেও তাজুদ্দিন রা. ছিলেন এখন পর্যন্ত আবিস্কৃত ভারতের একমাত্র সাহাবি। আল্লাহ তায়ালা তাকে উত্তম প্রতিদান দিন। আমিন।