সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ে আদালত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। তবে তার আইনজীবীরা বলেছেন, তারা আপিল করবেন।
তার দল বিএনপি বলেছে, এ রায়কে তারা আইনি ও রাজনৈতিক উভয়ভাবেই মোকাবিলা করবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, আদালতে দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হওয়ার পর খালেদা জিয়া কি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন?
পাঁচ বছরের দণ্ড হওয়ায় কেউ কেউ যখন খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে অযোগ্য করার পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন, তখন তার ভিন্ন নজিরও চোখের সামনে আছে। নির্বাচন কমিশনের কয়েকজন সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রায়ের পর এ নিয়ে বিবিসির সাথে কথা বলেছেন।
তারা বলছেন, নির্বাচনে অংশ নেবার যোগ্যতা নির্ধারিত হয় বাংলাদেশের জন প্রতিনিধিত্ব আইনে। এতে বলা হয়েছে, কেউ যদি কোনো ‘নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে’ দোষী সাব্যস্ত হয়ে দু’বছরের বেশি মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত হন তাহলে তিনি নির্বাচনে অংশ নেবার যোগ্যতা হারাবেন।
তবে মূল দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে দণ্ডিত ব্যক্তি যদি উচ্চ আদালতে আবেদন বা আপিল করেন এবং সেই আপিল বিচারাধীন থাকে তখনও নির্বাচনে লড়ার ওপর সেই নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে কি না এ বিষয়ে আইনে কিছুটা অস্পষ্টতা আছে।
কর্মকর্তারা আরও বলছেন, কোনো দণ্ডিত ব্যক্তি যখন নির্বাচনে প্রার্থী হবার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেন, তখনই রিটার্নিং অফিসারের ক্ষমতা থাকে আইনি ব্যাখ্যা সাপেক্ষে এই মনোনয়নপত্র গ্রহণ বা খারিজ করার।
বইমেলার সব বই ঘরে বসে পেতে অর্ডার করুন রকমারিতে
মনোনয়নপত্র যদি কোনো কারণে খারিজ হয়ে যায়, তাহলে সেই ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনের কাছে আপিল করতে পারেন। কিন্তু সে আবেদন নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া সময় সাপেক্ষ। এর নিষ্পত্তি হতে হতে নির্বাচন শেষ হয়েও যেতে পারে!
এদিকে, রায়ের সত্যায়িত কপি হাতে পাবার পরই কেবল খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা আপিলের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবেন এবং ততদিন পর্যন্ত খালেদা জিয়া বন্দি থাকবেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এই রায়ের কপি পাবার কি কোনো সময়সীমা আছে?
জবাবে বলা যায়, না। কোনো সময়সীমা বাঁধা নেই। তবে সার্টিফায়েড কপির আগে টাইপ করা কপি (যাকে বলা হয় ট্রু কপি) হয়ত আইনজীবীরা দু’চার দিনের মধ্যেই পেয়ে যেতে পারেন। তাহলে তারা হয়ত চলতি সপ্তাহের মাঝামাঝি সময়েই আপিল দায়ের এবং আপিলের সাথেই জামিনের আবেদনও করবেন।
প্রসঙ্গত, দুর্নীতির দায়ে দণ্ডের কারণে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা-অযোগ্যতার প্রশ্নে সাম্প্রতিক কালে সংবিধান ও আইনের ব্যাখ্যায় নতুন ব্যাখ্যা এসেছে। আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হক সম্প্রতি বলেছেন, রায় আছে দুটি। আপিল চূড়ান্ত পর্যায়ে না যাওয়া পর্যন্ত একটি রায় বলছে নির্বাচনে অংশ নেওয়া যাবে, অন্যটি বলেছে যাবে না।
এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে-সংবিধানের ৬৬ (২ গ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, নৈতিক স্খলনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে নূন্যতম দুই বছর কারাবাস থেকে মুক্তির পর পাঁচ বছর পার না হলে কেউ নির্বাচনে যোগ্য হবেন না। কিন্তু বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বলছে, দুর্নীতির মামলায় শাস্তিলাভের পর রাজনীতিকদের সংসদে রাখা না-রাখার ক্ষেত্রে আইনের চেয়ে রাজনীতিই বড় বিবেচ্য হয়ে ওঠে।
বিএনপি আমলে জনতা টাওয়ার দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হওয়ার সাত বছর পর ২০০০ সালে এরশাদ সংসদে অযোগ্য হন।
আইনমন্ত্রীর বরাত দেওয়া রায় দুটির একটি আপিল বিভাগের, আরেকটি হাইকোর্টের। ১৯৯৬ সালে আপিল বিভাগের রায়ে বিচারপতি মোস্তফা কামাল বলেছিলেন, এ ধরনের অযোগ্যতার প্রশ্ন ঠিক হবে ভোটের পরে, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে। রিটার্নিং অফিসার মনোনয়ন বাতিল করলেও রিট চলবে না।
হাইকোর্ট রায় দিয়েছিলেন, বিচারিক আদালতে কেউ দণ্ডিত হওয়ামাত্রই নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। তার দোষী সাব্যস্ত হওয়ার (কনভিকশন) বিষয়টি স্থগিত করার কোনো ক্ষমতা আপিল আদালতের হাতে নেই। বাংলাদেশে রাজনৈতিক বাস্তবতায় ব্যক্তিভেদে এর বিচিত্র প্রয়োগ ঘটেছে।
বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, প্রথমে আমরা জামিন চাইব। আপিলে দণ্ড স্থগিত চাইব কি না, সে কৌশল ঠিক করব তার মুক্তির পর। কারণ, উচ্চ আদালতের রায়গুলোতে অস্পষ্টতা আছে।
তিনি বলেন, ফরিয়াদির জন্য জামিন পেলে দণ্ড স্থগিত চাওয়া লাভজনক, না পেলে দণ্ড স্থগিত চাওয়া ক্ষতিকর। কারণ, তখন তা মঞ্জুর হলে দণ্ডিতের সম্ভাব্য কারাবাসের দিনগুলোর পরে তার সাজা খাটা দিন হিসেবে গণ্য হওয়ার পথ রোধ করতে পারে। আবার শুধু আপিল আবেদন গৃহীত হয়ে দণ্ড বহাল থাকলে নির্বাচনে তার অযোগ্যতার প্রশ্ন উঠতে পারে।
ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী এবং ‘ইয়াবা সম্রাট’ হিসেবে পরিচিত আবদুর রহমান বদি দণ্ড মাথায় নিয়ে মন্ত্রিত্ব ও সাংসদ পদ ধরে রেখেছেন। মায়া অবৈধভাবে ৬ কোটি টাকা অর্জনের মামলায় ১৩ বছর দণ্ডিত হয়েছিলেন। আপিল বিভাগের রায় অনুসারে ২০১৫ সালের ১৪ জুন থেকে তার সাংসদ ও মন্ত্রী পদ শূন্য হওয়ার কথা। কিন্তু মায়া পদ দুটিতে বহাল আছেন।
তবে এক্ষেত্রে আপিল আবেদন গ্রহণই বড় বিষয়। যতক্ষণ সেটি চলবে, ততক্ষণ শাস্তি বা দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ব্যাপরটি চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে না। আর এই যুক্তিতে মায়ার মন্ত্রিত্ব বৈধ এবং খালেদা জিয়াও আপিল করে নির্বাচন করতে পারবেন বলে ধরে নেওয়া যায়।
২০১৭ সালের ৯ মে মো. মামুন বনাম রাষ্ট্র মামলায় বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি মো. খুরশিদ আলম সরকার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ ‘দোষী সাব্যস্ত’, ‘দণ্ড স্থগিত’ এবং ‘দণ্ড কার্যকরণ স্থগিত’ হওয়ার মধ্যে প্রভেদ সুনির্দিষ্ট করে একটি রায় দেন। তাতে স্থির করা দিকনির্দেশনায় বলা হয়, ‘নিম্ন আপিলাত আদালত’-এর এখতিয়ার কেবল দণ্ড স্থগিত করার। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার কার্যকারিতা স্থগিত করার ক্ষমতা তার নেই।
মামলাটির অন্যতম অ্যামিকাস কিউরি প্রবীর নিয়োগী এ মত দিয়েছিলেন। ওই দিকনির্দেশনায় ‘নিম্ন আপিলাত আদালত’ বলতে হাইকোর্টকে বোঝাচ্ছে। এর তাৎপর্য, আপিল আবেদন গ্রহণ করার মাধ্যমে খালেদা জিয়ার ‘দোষী সাব্যস্ত’ হওয়া স্থগিত করার এখতিয়ার হাইকোর্টের থাকবে না।
জিয়াউর রহমানের ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী (বর্তমানে জাতীয় পার্টির স্থায়ী কমিটির সদস্য) এ কে এম মাইদুল ইসলাম ১৯৯৬ সালে সপ্তম সংসদে বিএনপির পক্ষে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, সে সময়ে দণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও রিটার্নিং অফিসার এরশাদের মনোনয়নপত্র গ্রহণ করায় হাইকোর্টে আমি তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেছিলাম। হাইকোর্ট বলেছিলেন, তার আপিল বিচারাধীন বলে তার মনোনয়নপত্র বৈধ।
স্বাধীনতার আগের ও পরের বাংলাদেশের ইতিহাস রাজনীতি ও আইন পরস্পরের ওপরে নানা সময়ে নানা ছায়া ফেলেছে। বিশেষ করে এক-এগারো সবার স্মৃতিতেই আজও অমলিন। তবে মনে পড়ে-সেই সরকারের আমলে দুদকের মামলাগুলো ‘মিথ্যা’ বিবেচনায় নিয়ে সরকারি দলের নেতারা নির্বিচারে দায়মুক্তি নিতে পেরেছেন। তাই বলতে হচ্ছে, রাজনীতিই শেষ কথা। রাজনীতিই তার পথ বাতলাবে-কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক।
লেখক : কবি, কলামিস্ট ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম