সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


মাদক ব্যবসা কি ছাত্রলীগ নেতাদের কাজ হতে পারে?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন

৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে দৈনিক প্রথম আলো রোজিনা ইসলাম ও আহমেদ জায়িফ এর লেখা একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। যা পাঠে রীতিমতো হতবাক হয়েছি। রিপোর্টটিতে প্রকাশ- “রাজধানীর পল্টনের নাইটিঙ্গেল মোড়ে গত ১৪ ডিসেম্বর পুলিশ ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি নূরে মোজাচ্ছেম ওরফে রঙ্গনসহ তিনজনকে।

মামলার এজাহারে বলা হয়, এই তিনজন দীর্ঘদিন ধরে পল্টনসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবা বিক্রি করে আসছেন।”

রিপোর্টটিতে আরও দাবি করা হয়েছে- “শুধু নূরে মোজাচ্ছেম নন, ঢাকায় বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক মাদক বেচাকেনায় জড়িত রয়েছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন শাখার নেতাদের অনেকেই। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের আবাসিক হলগুলোকে তারা ব্যবহার করছেন মাদক কেনাবেচার নিরাপদ স্থান হিসেবে।

সম্প্রতি ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক মাদক ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকা কলেজসহ রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ৩৮ জনের নাম রয়েছে। তাদের মধ্যে ২০ জন হলেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। যুবলীগের দুজন নেতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন সদস্যের নামও রয়েছে তালিকায়। বাকি ১৫ জনের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা নেই।

এই তালিকা ধরে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাদক ব্যবসায় জড়িত ছাত্রলীগের নেতাদের মধ্যে আটজন ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা, দুজন সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা, তিনজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক নেতা, পাঁচজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কর্মী এবং দুজন ধানমন্ডি থানা ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক শীর্ষস্থানীয় নেতা।

তাদের মধ্যে রয়েছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির তিন সহসভাপতি আনোয়ার হোসেন ওরফে আনু, নাজমুল হক ও নিশীতা ইকবাল এবং সাংগঠনিক সম্পাদক আশিকুল পাঠান ওরফে সেতু ও দারুস সালাম ওরফে শাকিল, আপ্যায়ন সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম ওরফে রাশেদ, উপপরিবেশবিষয়ক সম্পাদক মোজাহিদুল ইসলাম ওরফে সোহাগ ও উপ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক মাহাবুবুল ইসলাম ওরফে প্রিন্স।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্রলীগের যেসব নেতা ও কর্মী মাদক ব্যবসায় যুক্ত রয়েছেন, তাদের অধিকাংশই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এর আশপাশের এলাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে মাদক সরবরাহ করেন। ইয়াবার মূল প্রবেশপথ কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে ঢাকা পর্যন্ত প্রতিটি এলাকায় ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীকে ইয়াবা আনার ক্ষেত্রে কাজে লাগানো হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মাদক বিক্রির বর্তমান পরিস্থিতির খোঁজ করতে গিয়ে জানা যায়, শহীদ মিনার, শিববাড়ী কোয়ার্টার, টিএসসি থেকে বুয়েটগামী সড়কের অন্ধকার জায়গা, এফ রহমান হল-সংলগ্ন এলাকা, চারুকলা ইনস্টিটিউটের উল্টো দিকে শাহবাগ থানার পার্শ্ববর্তী এলাকা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, তিন নেতার মাজারসংলগ্ন এলাকায় মাদক কেনাবেচা হয় সবচেয়ে বেশি।

এসব এলাকায় কিছু বহিরাগতও মাদক বিক্রি করে থাকেন। তবে সবই ছাত্রলীগের কোনো না কোনো নেতার গোচরেই হয়। ছাত্রলীগের একক আধিপত্য থাকায় তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছেন।”

রিপোর্টটি পাঠ শেষে মনে হলো- এসব যে ছাত্রলীগের কাজ হতে পারে না। ছাত্রলীগের কাজ হবে সকল মানুষের মন জয় করা, দেশের সেবা করা।ইতিহাস অন্তত তা-ই বলে।

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বাংলা এবং বাঙালির প্রায় সাত দশকের সংগ্রাম স্বপ্ন এবং সাহসের সারথী। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। তার নেতৃত্বেই সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে আনুষ্ঠানিকভাবে এর যাত্রা শুরু হয়।

গত ৭০ বছরে ছাত্রলীগের ইতিহাস হচ্ছে জাতির ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা, মুক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়ন, স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনা, গণতন্ত্র ও প্রগতির সংগ্রামকে বাস্তবে রূপদানের ইতিহাস।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সংগ্রামে ছাত্রলীগ নেতৃত্ব দিয়েছে এবং চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়া এ সংগঠনের নেতাকর্মীরা পরে জাতীয় রাজনীতিতেও নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এখনও দিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমান জাতীয় রাজনীতির অনেক শীর্ষনেতার রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছে ছাত্রলীগ থেকেই।

ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার এক বছর পর ১৯৪৯ সালে এ ছাত্র সংগঠনটির হাত ধরেই তৎকালীন পাকিস্থানের প্রথম বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে আওয়ামী মুসলিম লীগের। যা পরে আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে এদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়।

তৎকালীন পাকিস্থান সরকারের শাসন-শোষণ আর বঞ্চনার প্রেক্ষাপটে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের হাজার হাজার নেতা কর্মী যুদ্ধের ময়দানে জীবন উৎসর্গ করেছেন।

১৯৪৮ সালেই মাতৃভাষার পক্ষে ছাত্রলীগ আপোসহীন অবস্থান তৈরি করে। ১১ মার্চ ছাত্রলীগ উর্দুর বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ধর্মঘট পালন করে। ওই ধর্মঘটের পিকেটিং থেকেই গ্রেফতার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের মেধাবী ছাত্র, বাঙালির রাজনীতির রাখাল রাজা, ছাত্রনেতা শেখ মুজিব ও তার সহযোগীরা।

ছাত্রলীগই প্রথম বাংলাভাষার জন্য ১০ দফা দাবিনামা পেশ করে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ ও আন্দোলন জোরালো করার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় নিশান উড়ানোর নেপথ্যের কারিগরও ছিলেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। ১৯৫৬ সালের বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়, ১৯৫৭ সালের শিক্ষক ধর্মঘট এবং ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের পালে হাওয়া দিয়েছিল ছাত্রলীগ।

বাঙালির মুক্তির ছয় দফা হিসেবে পরিচিত ঐতিহাসিক ‘ছয় দফা’ আন্দোলনে রাজপথের প্রথম সারিতে অবস্থান ছিল ছাত্রলীগের। এ সময় নিজেদের ১১ দফার মাধ্যমে ছাত্রসমাজের রক্তে প্রবাহ সঞ্চার করে ছাত্রলীগ।

ইসলামি কিতাব, বয়ান ও মালফূযাতের অন্যন্য অ্যাপ

ছাত্রলীগের নেতৃত্বেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছাত্র-গণআন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। গণজাগরণের ১৯৭০ সালের নির্বাচনে মুক্তির সনদ ছয় দফাকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এক দফার গণভোটে রূপ দেয়।

এরপর ১৯৭১ সালের ত্রিশ লাখ মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলার আকাশে যে রক্তস্নাত লাল সূর্যোদয় হয় তাতে পরিসংখ্যানের হিসেবে বিশ্বের বৃহৎ ও সংগ্রামী সংগঠন ছাত্রলীগের আত্মত্যাগী নেতাকর্মীদের সংখ্যা ছিল ১৭ হাজার।

১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ কালপূর্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনের সংগ্রাম ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। সামরিক শাসনের মধ্যেও ১৯৮৩ সালে শিক্ষা আন্দোলন ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের দশ দফা তৈরিতে নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। শিক্ষার অধিকার প্রসারে শামসুল হক ও অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর কমিশনে রিপোর্ট তৈরিতে ছাত্রসমাজের পক্ষে জোড়াল অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ।

এরপর একটি সফল গণঅভ্যূত্থান পরবর্তী নির্বাচনে দীর্ঘ একুশ বছর পর সরকার গঠন পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ছাত্রলীগ গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক নির্দেশ প্রতিপালন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার প্রতিবাদেও রাজপথে ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের বিজয় নিশ্চত করতে নিরলসভাবে কাজ করেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিটি সদস্য।

২০১১ সালের ১১ জুলাই শেখ হাসিনার নির্দেশে ডিজিটাল বাংলাদেশ বির্নিমাণের জন্য মেধাবী ও দূরদর্শিতাসম্পন্ন ছাত্রনেতাদের হাতে ছাত্ররাজনীতি তুলে দিতে ছাত্রলীগের নেতা নির্বাচন করা হয় প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে।

সেবার দেশের ৮৭টি সাংগঠনিক জেলার কাউন্সিলররা তাদের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করেন।

তাহলে ৭০ বছরের পুরানো ছাত্রলীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার নাম মাদক ব্যবসায় আসছে কেন?

অবশ্য এ বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এম সাইফুর রহমান সোহাগ গণমাধ্যমকে বলেছেন, মাদকের বিষয়ে কোনো ছাড় কখনোই দেয়নি ছাত্রলীগ। অভিযোগ এলেই আগে এ্যাকশন নিয়ে বহিষ্কার করা হয়েছে। অভিযোগ অনেকেই করতে পারেন, কিন্তু সব অভিযোগ প্রমাণ হয় না। এবার যাদের বিরুদ্ধে ব্যবসার নাম এসেছে তাদের সবাইকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তারা এমন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নয় এটা আমি হলফ করে বলতে পারি।

তারপরও যদি কেউ প্রমাণ করতে পারেন ছাত্রলীগ অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিবে। আর যদি প্রমাণ না করতে পারেন তবে সংগঠন তাদের পাশে থাকবে।

যে ছাত্রলীগের ইতিহাস জাতির ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা, মুক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়ন, স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনা, গণতন্ত্র ও প্রগতির সংগ্রামকে বাস্তবে রূপদানের ইতিহাস-সেই ছাত্রলীগ নেতাদের মুখে মাদকের দুর্গন্ধ কিংবা মাদক ব্যবসার তকমা শুনতে চাই না। একই সাথে, দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা প্রকৃত সত্য জানতে চাই।

লেখক : কবি, কলামিস্ট ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ