সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


ছিহঃ অভিভাবকরাই এখন ফাঁস হওয়া প্রশ্ন খোঁজে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন

‘পরীক্ষা’ ও ‘প্রশ্ন ফাঁস’ যেন আজ দেশে জোট বেঁধেছে। যেখানেই পরীক্ষা সেখানেই প্রশ্ন ফাঁস! প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষা, এখন প্রতিটি স্তরেই প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটছে। শুধু পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায়ও।

এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস এখন নতুন কিছু নয়। প্রশ্ন ফাঁস বন্ধে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর ব্যর্থতাকেও দায়ী করছেন অনেকে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের বক্তব্য জাতিকে আরও উদ্বিগ্ন ও হতাশ করছে।

দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি আলোচনায় এলেও এটি বন্ধে সরকার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় দেশবাসী ক্ষুব্ধ। বলা যায়, প্রশ্ন ফাঁস যেহেতু ঠেকানো যাচ্ছে না, তাহলে এত আয়োজন করে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে কেন?

ভাবতে অবাক লাগে, দেশে মুড়ি মুড়কির মতো ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রশ্ন কেনা-বেচা হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশ, দেশব্যাপী প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ফেসবুক গ্রুপ ও পেজ ব্যবহার করা হচ্ছে। ইনবক্সে কেনাবেচা হচ্ছে।

এক্ষেত্রে কি না প্রথমে অস্পষ্টভাবে প্রশ্নটি আপলোড করা হয় এবং বলা হয়, পুরো ও স্পষ্ট প্রশ্ন পেতে হলে ইনবক্সে যোগাযোগ করুন। পিএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ২০১৭, ‘পিএসসি জেএসসি এসএসসি এইচএসসি অল ঢাকা বোর্ড কোয়েশ্চেনস ২০১৭’ ‘পিএসসি জেএসসি এসএসসি এইচএসসি কোয়েশ্চেনস সাজেশন অল বোর্ড এক্সামিন ২০১৭ + ২০১৯ + ২০ + ২১ বিডি, ফাঁস হওয়া প্রকৃত প্রশ্নপত্র ব্যাংক, প্রশ্ন ফাঁস, ‘পিএসসি জেএসসি এসএসসি এইচএসসি সাজেশন + কোয়েশ্চেনস ২০১৭-১৮ ইত্যাদি নামে একাধিক ফেসবুক পেজ এবং গ্রুপ রয়েছে।

এসব পেজ এবং গ্রুপে পরীক্ষার আগেই সাজেশন এবং প্রশ্ন তুলে দেওয়া হয়। প্রশ্ন হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ফেসবুক পেজ ও গ্রুপগুলো কে বা কারা চালায় তা বের করা যাচ্ছে না কেন?

বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা প্রমাণিত হলেও বাতিল করার উদাহরণ আছে মাত্র দু’একটি। চলতি বছর অনুষ্ঠিত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি), এইচএসসি এবং চলমান এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠে।

অনেক অভিভাবক প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণও দেখিয়েছেন। ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে মূল প্রশ্নের হুবহু মিল পাওয়া গেলেও অনেক সময় কর্তৃপক্ষ প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। কখনো কখনো সাজেশন বলেও বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। অনেককে গ্রেফতার করা হলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির তেমন কোনো উদাহরণ নেই কেন?

বাস্তবতা পর্যালোচনায় বলা যায়, এখন অভিভাবক পরীক্ষার্থী পরীক্ষার আগে প্রশ্ন খোঁজে! এসব অভিভাবকদের যুক্তি হতে পারে-যারা প্রশ্ন আগে পায় তারা শুধু সেগুলোই প্রাকটিস করে পরীক্ষা হলে যায়। ফলে শতভাগ প্রশ্নের উত্তর নির্ভুল দেয়। আর তার সন্তান কষ্ট করে লেখাপড়া করে পরীক্ষা দেবে। এই দুয়ের মূল্যায়ন কি এক হবে?

এক্ষেত্রে অভিভাবকরা আরও বলতে পারেন-আমরা চাই আমার সন্তান পরীক্ষায় ভালো করুক। এজন্য লেখাপড়া করিয়েছি। নিয়মিত নজরদারিতে রেখেছি। কিন্তু যখন শুনি অন্য কেউ পরীক্ষার আগে প্রশ্ন পেয়েছে, তখন খারাপ লাগে। মনে ক্ষোভ জাগে। শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি বিরক্তি আসে!

এদিকে, দেশের শিক্ষক সংগঠনগুলোর মতে, কোচিং সেন্টারগুলো শিক্ষার্থী টানতে সংক্ষিপ্ত সাজেশন আকারে প্রশ্ন ফাঁস করছে। প্রশ্ন ফাঁসে শুধু শিক্ষকদের দায়ী না করে বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারগুলোকে বন্ধ করলে প্রশ্ন ফাঁস অনেকাংশে বন্ধ হবে। বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারগুলোকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য দায়ী করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশও (টিআইবি)।

টিআইবি জানিয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২ অনুসারে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এ নীতিমালা লঙ্ঘন করে শিক্ষকদের একাংশ কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন। এ ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে অনেকেই কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও তা নিয়ন্ত্রণে কোনো আইন বা নীতিমালা প্রণীত হয়নি।

অন্যদিকে ‘পাবলিক পরীক্ষাসমূহ (অপরাধ) আইন, ১৯৮০’র ৪ ধারা অনুসারে প্রশ্ন ফাঁসের ন্যায় অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ দশ বছরের কারাদণ্ডের বিধান ছিল। ১৯৯২ সালে আইন সংশোধনের মাধ্যমে এ শাস্তি কমিয়ে চার বছর করা হয়। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সংশোধিত আইনের আওতায় কোনো অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার উদাহরণ দেখা যায় না।

এ বিবেচনায় অবিলম্বে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত সব ধরনের কোচিং সেন্টার বন্ধ করার সুপারিশ করেছিল টিআইবি। কিন্তু টিআইবির ওই সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগই নেয়নি সরকার।

প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে শিশু শিক্ষার্থীদের মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মেধাহীন হয়ে পড়বে। এসব ফেসবুক পেজ ও গ্রুপে ভুয়া প্রশ্ন দিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গেও এক ধরনের তামাশাও করা হচ্ছে।

গুরুতর এই অপরাধ শিক্ষার্থীর নৈতিক বিপর্যয়, মেধাবীর স্বপ্ন ও সংগ্রাম এবং অভিভাবকদের স্বস্তি বিনষ্টের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করছে। এতে মেধাবী ছাত্র অনীহ হয়ে পড়ে পরবর্তী পাঠ প্রস্তুতে। অবমূল্যায়িত হয় ফাঁসকৃত প্রশ্নে এগিয়ে যাওয়া ছাত্রের বিপরীতে।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা প্রতিরোধে সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি। সোচ্চার হতে হবে সবাইকেই। তদন্ত করে প্রশ্নপত্র ফাঁসের রহস্য উদ্ধার করা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং বিশেষ পর্যায়ের লোকদের দায়িত্ব। তা না হলে তারাও অভিযোগ এবং অপরাধের দায় এড়াতে পারেন না। এ ধরনের জঘন্য অপরাধ থেকে মুক্তির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং পরীক্ষকসহ সবাইকেই সোচ্চার হতে হবে।

মনে রাখা চাই, অপরাধ আড়াল করে কিংবা এড়িয়ে অপরাধ দূর করা যায় না। অপরাধকে চিহ্নিত করা এবং শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি স্বচ্ছ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করাই কাম্য। কোনোভাবেই যেন প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে না পারে, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রযুক্তির সহায়তায় যাতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা না ঘটে, সেজন্য নিতে হবে সুচিন্তিত ও যথাযথ ব্যবস্থা।

লেখক : কবি, কলামিস্ট ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ