সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


তাবলিগ ইস্যুতে দেওবন্দ ও নিজামুদ্দীনকে মুখোমুখি দাঁড় করানো সুখকর নয়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ

হজরতজি মাওলানা সাদ কান্ধলভি আমার কাছে একজন দক্ষ মুবাল্লিগ ও যোগ্যতম ব্যক্তিত্ব এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তার ভেতর দুটি জিনিস না থাকলে আমি খুশি হতাম।

তাহলো, এক. তার কথা, কাজ, কর্মপদ্ধতি ইত্যাদি থেকে আমার ও আমার মতো অনেকের মনে হয় তিনি আহলে হক আলেমদের মতবাদ ও চিন্তার বাইরে একটি মতবাদ গ্রহণ করেছেন।

এখানে তার উচিৎ ছিলো অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে বিষয়গুলো হ্যান্ডেল করা। কিন্তু তার বিচক্ষণতার ক্ষেত্রে কমতি দেখা দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তাকে আবারও ভেবে দেখার দরকার। নতুবা সমস্যার সমাধান হবে না।

আমার মনে হয়, দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার কারণে মাওলানা সাদ নিজেকে শুধু আনাফিয়্যাতের মধ্যে আটকে না রেখে সালাফ্যিাতের সঙ্গেও যুক্ত করেছেন। কারণ, আরব বিশ্বসহ সারা পৃথিবীতে সালাফি অনুসারী অনেক লোক রয়েছে যারা তাবলিগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।

ওনার আরেকটি বিষয় আমাকে ব্যথিত করেছে, তা হলো কুরআনের শিক্ষকদের রোজগারকে তিনি বেশ্যাবৃত্তির উপার্জনের চেয়ে নিকৃষ্ট বলেছেন। এটা তার ভুল। এ ভুল তাকে ও তার অনুসারীদের মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করবে।

আমরা উৎসাহিত করি মাদরাসা শিক্ষাকে, এর সঙ্গে লেগে থাকাকে, মাদরাসায় পড়া ও পড়ানোকে। কেনো করি? করি ইসলামি শিক্ষাকে টিকিয়ে রাখতে। মাদরাসায় পড়িয়ে যদি অর্থ উপার্জন না করা যায় তাহলে দীনি শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ হারিয়ে যাবে। হুমকির মুখে পড়বে।

ফিকহি বিবেচনায়ও বিষয়টি ঠিক নয়। আমরা জানি, কোনো বিষয়ে যখন কোনো মত প্রত্যাখ্যাত হয়, তখন দ্বিতীয়বার তা টেনে আনা যায় না। যেমন, ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেছেন, ফার্সিতে কেরাত পড়লে নামাজ হবে। কিন্তু আহনাফ মতটি প্রত্যাখ্যান করেছে।

রাসুল সা. এর যুগে নামাজে কথা বলা বৈধ ছিলো পড়ে তা পরিহার করার নির্দেশ এসেছে। ইমাম আবু হানিফা বাদে বাকি অন্য তিন ইমাম (শাফেয়ি, মালেক ও আহমদ রহ.) কুরআন শিক্ষকের উপার্জনকে উত্তম হালাল বলেছেন। ইমাম আবু হানিফা রহ. বিষয়টি মাকরুহ বলেছেন। কিন্তু আহনাফের ফতোয়া তার মতের উপর দেন নি।

এখন একটি মাতরুক (প্রত্যাখ্যাত) মত গ্রহণ করে আলেম-উলামা উপার্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা কি ঠিক হলো?

হজরতজি সাদ কান্ধলভি রহ. এর রুজু ও দারুল উলুমের ভূমিকা নিয়ে আমি দুটি কথা বলবো।

এক. রুজুর ব্যাপারে মাওলানা সাদ কান্ধলভির যে ভূমিকা গ্রহণ করা দরকার ছিলো তা তিনি করেন নি। তিনি পারতেন দারুল উলুম দেওবন্দ যেতে। তিনি সেখানের ছাত্র-শিক্ষকদের সামনে নিজের ভুল স্বীকার করলে তার কি এমন ক্ষতি হতো? দারুল উলুম দেওবন্দ তো তার পরজন কেউ নন। তিনি কখনো দেওবন্দ যান না। এটা দৃষ্টিকটূ।

কেনো তাকে বার বার আলেমদের বলতে হবে প্রকাশ্যে রুজু করুন? শরিয়তের মূলনীতি হলো, প্রকাশ্য ভুলের তওবা প্রকাশ্যে এবং গোপন ভুলের তওবা গোপনে হবে। নতুবা তা খেয়ানত হিসেবে গণ্য হবে। এটা আলেম হিসেবে তার অজানা থাকার কথা নয়।

দুই. মাওলানা সাদের রুজুর বিষয়ে দেওবন্দের বক্তব্যের পর বিষয়টি নিয়ে লোকেরা যেভাবে টানাটানি শুরু করেছে তা আমার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে। তাদের অবস্থা দেখে মনে হয়, দেওবন্দই সবকিছু। দেওবন্দের কথা না বললে সব আটকা পড়ে যাবে। কিন্তু দেওবন্দ তো কুরআন-হাদিস নয়। দলিল হলো কুরআন-সুন্নাহ।

দেওবন্দের উপর আমাদের আলেমদের আস্থা এবং দেওবন্দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ভিন্ন বিষয়। কিন্তু দেওবন্দ তাকে না মানলে আমরা মানবো না, বিষয়টি এভাবে ভাবলে চলবে না।

কুরআন-সুন্নাহর তার পক্ষে থাকলেই হবে। তার মতের পক্ষে কুরআন-সুন্নাহর দলিল থাকলে তিনি একটি গণমাধ্যমে তা তুলে ধরতে পারেন। আর না থাকলে গণমাধ্যমে তওবার ঘোষণা দিক। কোনো সমস্যা নেই।

মাওলানা সাদ কান্ধলভির বিষয়টি উপলক্ষ্য করে মানুষের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করা হচ্ছে। এটা অনেক ভয়ের। আমাদের দুটি মারকাজ ছিলো দেওবন্দ ও নিজামুদ্দিন। এখন দুটিকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর একটি পায়তারা দেখা যাচ্ছে। এটা সুখকর নয়। এতে উভয়টিই ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

তাহলে প্রশ্ন থাকে আমাদের দেশের উলামায়ে কেরাম কেনো দেওবন্দের উপর নির্ভর করছেন? উত্তর সম্ভবত এটাই, পূর্ব থেকে চলে আসা সম্মানপ্রদর্শনের ধারাবাহিকতায় তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং অধিকতর নির্ভরতা। নতুবা শরয়ি সিদ্ধান্ত দেয়ার মতো আলেম আমাদের দেশেও অনেক রয়েছে।

আরেকটি বিষয় আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, তাবলিগের কাজ পরিচালিত হবে যোগ্য অভিজ্ঞ আলেমদের তত্ত্বাবধানে। দিকনির্দেশনা উলামারা দেবে। হজরতজি ইলিয়াস রহ. এর শতভাগ খেয়াল দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এটিই।

এ ক্ষেত্রে আমার জোর দাবি থাকবে, যেসব আলেমকে উপদেষ্টা মনোনীত করা হয়েছে তাদের পুতুল বানিয়ে না রেখে নির্দেশনা অনুসরণ করা হোক। নতুবা এসব আলেমের অবমাননা হবে। আলেম উলামাকে পাশ কাটিয়ে কাকরাইল যদি অন্য পথে সমাধান খুঁজে তবে দিনে দিনে তা বাতিল সম্প্রদায়ে পরিণত হবে।

আমি মনে করি, তাবলিগে মাওলানা সাদ কান্ধলভির প্রয়োজন আছে। তিনি একজন যোগ্য ও দক্ষ মানুষ। তিনি হজরতজি ইলিয়াস রহ. এর নিসবতের মানুষ। তাবলিগ জামাতের জন্য তার নেতৃত্বের প্রয়োজন আছে।

তবে তাকে অবশ্যই হক্কানি-রব্বানি আলেমদের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে, তাসাওফের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা যাবে না, দীনি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ও তার ধারকদের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা যাবে না। আর যদি তিনি তার পিতৃপুরুষদের পথ পরিহার করে এসব বিষয়ের প্রতি অবজ্ঞা অবহেলা প্রদর্শন করেন তাহলে হোঁচট খাবেন। চলতে পারবেন না।

দেশে এই প্রথম আধুনিক চিকিৎসার সমন্বয়ে নববি চিকিৎসা হিজামা

এসব বিষয়ের প্রতি খেয়াল করলে গোটা দুনিয়ার তাবলিগি কাজের নেতৃত্বের জন্য মাওলানা সাদ কান্ধলভির ব্যক্তিত্বের কোনো বিকল্প নেই।

তাকে কেনো এসব বিষয় মানতে হবে? কারণ, তার একটি ভুলের কারণে বিপুল সংখ্যক মানুষ ভুলে পতিত হবে। তার ভুল ব্যক্তির ভুল না; জাতির বৃহৎ অংশের ভুল। সুতরাং তাকে সতর্ক হতেই হবে। মনে রাখতে হবে, আল্লাহর রাসুল আলেমদের তার উত্তরসুরি ঘোষণা করেছেন। কোনো মুবাল্লিগকে নয়। আল্লাহও দীনের কথা বলার দায়িত্ব উলামায়ে কেরামকে দিয়েছেন।

আল্লাহ বলেছেন, ‘কেনো তাদের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র দল বের হয় না যারা দীনি শিক্ষা অর্জন করবে এবং ফিরে এসে স্বজাতিকে সতর্ক করবে।’

কুরআন হলো এমন একটি সংবিধান যা প্রয়োগ করার জন্য বিজ্ঞ আইনবিদের প্রয়োজন। সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দিলে সংবিধান তারা কচুকাটা করে ছাড়বে।

লেখক: বিশিষ্ট আলেম, লেখক, গবেষক ও মুহাদ্দিস

‘রিসালায়ে নুরের শিক্ষা সমাজে ছড়িয়ে দেয়া গেলে হতাশা ও অশান্তি দূর হবে’


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ