সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অভিবাসনের প্রয়োজন অনেক বেশি। কারণ এমন দেশ আছে যাদের বাড়তি এবং তরুণ শ্রমশক্তি আছে, আবার অন্য এমন কিছু দেশ আছে, যাদের এ ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে।
প্রসঙ্গত, বিশ্বের যেসব দেশ সর্বাধিক সংখ্যায় অভিবাসী শ্রমিক পাঠিয়ে থাকে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, বিভিন্ন অঞ্চলে অভিবাসীদের প্রতি ভালো আচরণ করা হয় না। অভিবাসীরা অনেক পিছিয়ে। রাষ্ট্রীয় বার্ষিক আয়ের হিসাব ছাড়া তাদের নিয়ে কেউ ভাবেন বলেই মনে হয় না।
এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই, জনশক্তি খাত আমাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। এ খাত থেকে প্রতি বছর অতি সহজে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে তা আর কোনো খাত থেকে আসে না। সরকারি হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। আমাদের রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর হিসাবে- সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্যে নারী গৃহকর্মী প্রেরণের হার বাড়িয়েছে। সেই সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করেছে জর্ডান ও সৌদি আরবের সঙ্গে। প্রশ্ন হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অবস্থানরত গৃহকর্মীদের সুরক্ষা বাড়াতে সরকার কতটা উদ্যোগী?
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কীভাবে বাংলাদেশি গৃহকর্মীদের কাজের সর্বোচ্চ সুযোগ নিশ্চিত করা যায়, তাদের সুরক্ষা দেওয়া যায় কিংবা দুর্দশার সময় সহযোগিতা প্রদান করা যায়- এসব বিষয়ে সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে? বলা যায়, উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেই।
কথা এখানেই শেষ নয়। যতদূর জানা গেছে, গৃহকর্মীদের জন্য কুয়েত ছাড়া অন্য কোনো মধ্যপ্রাচ্যীয় দেশ সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারণ করেনি। বাংলাদেশের উচিত তার গৃহকর্মীদের জন্য নির্ধারিত সর্বনিম্ন বেতন বৃদ্ধি করা এবং এমন কর্মপদ্ধতি তৈরি করা- যাতে সর্বনিম্ন বেতন এবং অন্যান্য সুবিধা তারা পায়। উদাহরণস্বরূপ, উপসাগরীয় দেশগুলিতে, ভারতীয় দূতাবাস তাদের কর্মীদের জন্য নিয়োগদাতাদের কাছ থেকে প্রায় তিন হাজার মার্কিন ডলার দাবি করে। আর এ অর্থ ব্যয় করা হয় নিরাপত্তার জন্য।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে শ্রমিকদের পাড়ি জমানোর পরিমাণ ক্রমাগত বাড়লেও এসব শ্রমিকের অর্ধেকই অদক্ষ। তবে দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কিনা দেশে ২০১১ সালে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি করা হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির তো কোনো হেরফের হয়নি। তাহলে এসব নীতি প্রণয়ন করে লাভ কী? আরো আছে, বিএমইটির আওতায় বর্তমানে সারা দেশে ৭০টি কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র থাকলেও এসব কেন্দ্রের প্রশিক্ষণের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে।
সরকারিভাবে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ খাতকে আরো বেশি গতিশীল করা দরকার। কেননা, অভিবাসন খাতকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উৎস বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এককভাবে এ খাতের অবদানই বেশি। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যে নতুন ১ কোটি ৮৭ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের কথা বলা হয়েছে সেখানেও জনশক্তি খাতকে অগ্রগণ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু প্রতিটি বাজেটে অভিবাসন খাত চরম উপেক্ষিত থাকছে।
সত্য কথা বলতে কী, বছরের পর বছর ধরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ বৃদ্ধি, গ্রামীণ অর্থনীতিকে গতিশীল রাখাসহ নানা ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলা এ খাতটি কখনোই গুরুত্ব পায়নি আমাদের জাতীয় বাজেটে।
পোশাক শিল্পে বিভিন্ন সময়ে প্রণোদনা দেওয়া হলেও অভিবাসন খাতে সে তুলনায় সরকারি সহযোগিতা খুবই সামান্য। আরও হতাশার খবর হচ্ছে, অভিবাসী শ্রমিকদের টাকায় প্রতিষ্ঠিত প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে সুদসহ লোন নিতে হয় অভিবাসনপ্রত্যাশী শ্রমিকদের। শুধু কি তাই? এ ব্যাংক গ্রামীণ জনপদের অভিবাসনপ্রত্যাশীর চাহিদা পূরণ করতে না পারায় অনেককেই চড়া সুদে গ্রাম্য মহাজন অথবা এনজিও থেকে অভিবাসন ব্যয় নির্বাহ করতে হয়।
ট্যানারি শিল্পের জন্য সরকার সাভারে বিশেষ শিল্পাঞ্চল তৈরি করে সেখানে জমি বরাদ্দ দিয়ে, পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাসের ব্যবস্থা, ব্যাংক লোন প্রদান, আধুনিক যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক হ্রাস করে ট্যানারি শিল্পের টেকসই উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছে। অথচ জনশক্তি প্রেরণ খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য কোনোরূপ সহযোগিতা দেখা যায় না। এ ধরনের বৈষম্যের যৌক্তিক কোনো কারণ আছে কি? না, থাকার কথা নয়। তাহলে কি এই ধরনের বৈষম্যকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলা যায়?
বাংলাদেশ থেকে যেসব শ্রমিক বিভিন্ন দেশে যান, তারা মূলত ঝুঁকিপূর্ণ কায়িক শ্রমের কাজগুলো করেন বলেই বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ। এর কারণ বাংলাদেশিদের দক্ষতা ও ভাষাজ্ঞানের অভাব। তা ছাড়া তাদের কোনো চুক্তিপত্র থাকে না। এসব নিয়েও যেন কারো কোনোই মাথাব্যথা নেই। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় সকল দেশের দূতাবাসগুলো নিজ নিজ কর্মীদের আশ্রয় দেয় যদি তারা অত্যাচারী নিয়োগদাতার কাছ থেকে পালিয়ে আসে, বিশেষ করে নিয়োগদাতার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করবে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশি দূতাবাসগুলো শুধু কিছু দেশে আশ্রয়ের সুবিধা দেয়। এক্ষেত্রে দূতাবাসগুলো যেন আশ্রয় সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে এবং এ ধরনের কর্মীদের সাহায্য করতে সক্ষম হয়, বাংলাদেশের অবশ্যই তা ব্যবস্থা করা উচিত।
কাতারে বাংলাদেশি ইমাম-মুয়াজ্জিনদের সফলতার গল্প
এবার আসা যাক ফিরে আসাদের স্বাস্থ্য প্রসঙ্গে। ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় বাংলাদেশি যেসব নাগরিক বিভিন্ন দেশে কাজ করে দেশে ফিরে আসেন, তাদের মধ্যে ২১ শতাংশ পেশাগত কারণে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভোগেন বলে জানা গেছে। আর মানসিক সমস্যায় ভোগেন ১৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
বাংলাদেশে ২০১৩ সালে প্রণীত হয়েছে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসন আইন। এ আইনে অভিবাসন সংক্রান্ত নানা রকমের অপরাধের দণ্ড রাখা হয়েছে। আইনটির ৩৪ ধারা মতে, কোনো ব্যক্তি বা রিক্রুটিং এজেন্ট অন্য কোনো ব্যক্তিকে বহির্গমনের জন্য নির্ধারিত স্থান ছাড়া অন্য কোনো স্থান দিয়ে বাংলাদেশ থেকে বহির্গমনের ব্যবস্থা করলে বা সহায়তা করলে সর্বোচ্চ দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন পাঁচ লাখ টাকার অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কিন্তু এ আইন যে কার্যকর নয় বলেই মনে হয়। যদি কার্যকর হতো, তাহলে বিদেশগামীদের সাগরে ডুবে মৃত্যুর খবর শুনতে হয় কেন?
বাংলাদেশের শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক। সরকারের উচিত এর বাইরে নতুন বাজার খুঁজে বের করা। সে সঙ্গে দক্ষ লোক পাঠানোর দিকে নজর দেওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, দক্ষতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আর এ কারণে সমন্বিত পরিকল্পনা করতে হবে। পাশাপাশি কর্মঘণ্টা, বেতন, সুরক্ষাসহ যে সমস্যা আছে, সেসব বিষয়েও সরকারকে নজর দিতে হবে। শ্রমিকদের অধিকার পুরোপুরি পূরণ করার বিষয়, তাঁদের ন্যায়সঙ্গত পাওনা চাওয়ার অধিকার, ইউনিয়ন সংগঠিত করা এবং দর-কষাকষির অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা স্কিম, সামাজিক বিমা যেগুলো নিচের দিকে থাকা মানুষকে ওপরে উঠতে সাহায্য করবে, তার ব্যবস্থা করতে হবে।
বিদেশগামী কর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের অবকাঠামোগত সুবিধা, দক্ষ কর্মী তৈরিতে প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপনের জন্য বিশেষ অঞ্চল, লিজের মাধ্যমে স্বল্প মূল্যে জমি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য জমি বরাদ্দ, ব্যাংকঋণ প্রদান, প্রশিক্ষণের যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক রেয়াতসহ সরকারকে অবশ্যই প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে করে দেশের লাভ হবে আরো বেশি।
লেখক : কবি, কলামিস্ট ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম
বিদেশে নারী শ্রমিক কতোটা নিরাপদ, ইসলাম কী বলে?