সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


ড. মেসবাহ কামালের বক্তব্য মাদরাসাবিদ্বেষ বৈ কিছু নয়!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

তারেকুল ইসলাম
রাজনৈতিক বিশ্লেষক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ সম্প্রতি বলেছেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চতর মাদরাসায় পরিণত হয়েছে এবং এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”

তিনি আরো বলেছেন, “মাদরাসার ছাত্রছাত্রীদের ইংরেজির ভিত্তি এত খারাপ, মাদরাসায় যেই ইংরেজি পড়ে আসে সেটা হচ্ছে ক্লাস ফোরের সমমান। ইংরেজিতে দক্ষতাবিহীন মাদরাসার ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হয়ে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে টেনে টেনে নিচে নামিয়ে নিয়ে আসছে।”

একদম আঁষাঢ়ে বক্তব্য! সন্দেহ নেই, মাদরাসার প্রতি তার ঘৃণা ও বিদ্বেষ থেকেই তিনি এসব ভিত্তিহীন কথা বলেছেন। কিছুদিন আগে ঢাবি’র আরেক অধ্যাপক আমেনা মহসিনও ইসলামবিদ্বেষপ্রসূত বক্তব্য দিয়ে বিতর্কিত ও সমালোচিত হয়েছিলেন।

কয়েকজন অধ্যাপকের এহেন গাঁজাখুরি বক্তব্যের কারণে ইদানীং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বোধজ্ঞানের মানটাই বরং নিচে নেমে যাচ্ছে। তাদের মতো উচ্চ একাডেমিক পজিশন থেকে ইসলাম ও মাদরাসাবিদ্বেষী প্রোপাগান্ডা অত্যন্ত দুঃখজনক।

যাই হোক, মাদরাসার স্টুডেন্টরা মেধা ও যোগ্যতার বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়। এমনকি ভর্তির ক্ষেত্রে বিশেষত মাদরাসার স্টুডেন্টদের জন্য অতিরিক্ত নিয়ম-কানুনের নামে বৈষম্যসহ অনেক বাধা-বিপত্তি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। তারাও আবার অতিরিক্ত মেধা দিয়ে সেই বাধা-বিপত্তিগুলোও জয় করে ভর্তি হতে পারছে। কারো দয়ায় নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেক্যুলারদের বাপ-দাদার সম্পত্তি নয় যে, মাদরাসার শিক্ষার্থীরা পড়তে পারবে না।

ইংরেজির কথা নাহয় বাদই দিলাম, আধুনিক জেনারেল লাইনের কয়জন শিক্ষার্থী শুদ্ধ বাংলায় লিখতে পারে? এছাড়া স্কুল-কলেজে ১০ বছর ইংরেজি পড়েও এবং A+ পেয়েও বেশিরভাগেরই ‘আই এম জিপিএ ফাইভ’ অবস্থা কেন?! সেসব নিয়ে কোনো অভিযোগ শোনা যায় না সেকুলারদের মুখে। আর কিনা সব দোষ মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের? আসলেই যত দোষ নন্দ ঘোষ।

নিজেদের চেহারা আয়নায় না দেখে যারা মাদরাসার শিক্ষার্থীদের নিয়ে এসব ফালতু আজাইরা অভিযোগ করে থাকেন, তাদের উচিত আগে নিজেদের শিক্ষাব্যবস্থা ঠিক করা। তথাকথিত সৃজনশীল জেনারেল শিক্ষাব্যবস্থার আজকে যে-দুর্দশা, সেই সংকট আগে দূর করেন। অয়েল ইউর ওউন মেশিন।

ঢাবি’র ভর্তিপরীক্ষায় নকল, প্রক্সি ও জালিয়াতিতে কখনোই কোনো মাদরাসার শিক্ষার্থী ধরা পড়ার খবর আজতক শুনি নাই। যতগুলা ধরা পড়ছে, সবগুলাই জেনারেল লাইনের। এছাড়া প্রশ্নফাঁস ঢাবিতে হয়, মাদরাসায় না। বুঝেছেন মেসবাহ সাহেব? খুব হিসাব কইরা কিন্তু..!!

২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাবি ভর্তিপরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী জেনারেল লাইনের নামিদামি কলেজের হাজার হাজার মেধাবীদের টপকে আবদুর রহমান মজুমদার নামে এক মাদরাসা শিক্ষার্থী ইংরেজিতে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে ‘খ’ ইউনিটে প্রথম হয়। অথচ সে বছর হাজার হাজার জেনারেল লাইনের স্টুডেন্ট ইংরেজিতে গণহারে ফেইল করেছিল। মেধার প্রতিযোগিতায় মাত্র একজন মাদরাসার শিক্ষার্থীর কাছে হেরে গিয়েছিল হাজার হাজার জেনারেল লাইনের স্টুডেন্ট!!

অসাধারণ মেধার স্বাক্ষর রাখা সত্ত্বেও ঢাবি’র সেক্যুলার কর্তৃপক্ষ আবদুর রহমানকে ইংরেজি থেকে শুরু করে ভালো কোনো আধুনিক সাবজেক্টেই পড়ার সুযোগ দেয়নি। তার সাথে অত্যন্ত বৈষম্যমূলক আচরণ করেছিল। এই ইস্যুতে তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনা ও প্রতিবাদও হয়েছিল।

আসলে তাদের ভয়টা হলো, মাদরাসার শিক্ষার্থীরা মেধা ও যোগ্যতার গুণে ঢাবিতে টিচার ও প্রফেসর হয়ে নিয়োগ পেয়ে একদিন সেক্যুলার ডিপার্টমেন্টগুলাও দখল করে বসতে পারে!

এছাড়া ঢাবিতে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা যতদিন থাকবে ও পড়বে, ঢাবি থেকে ‘ইসলাম খেদাও’ সেক্যুলার নীতি কোনোদিনই বাস্তবায়ন করা সম্ভব না। সেক্যুলার মেসবাহ সাহেবদের ভয়টা এসব জায়গায়। মাদরাসার শিক্ষার্থীদের মেধাকেই তারা মূলত ভয় পান।

অধ্যাপক আমেনা মহসিন ও ড. মেসবাহ কামালরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইসলাম খেদাও’ সেক্যুলারনীতির বাই-প্রোডাক্ট। বাংলায় ইউরোপীয় রেনেসাঁ ও সেক্যুলারিজমের নামে ইসলাম খেদাও নীতি আজকে নতুন না, এর শিকড় প্রোথিত ঊনিশ শতকের ঔপনিবেশিক বৃটিশ পৃষ্ঠপোষিত বাংলার হিন্দু রেনেসাঁসের গর্ভে!

যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার সময় নবাব সলিমুল্লাহ ৬০০ একর জমি দান করেছিলেন এবং সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী জমিদার শ্রেণির সকল প্রতিরোধ অতিক্রম করে ঢাবি প্রতিষ্ঠায় অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিলেন, সেই নবাব সলিমুল্লাহ'র মৃত্যুবার্ষিকীর ব্যাপারে ঢাবি কর্তৃপক্ষের খবর থাকে না। কোনো স্মরণসভার আয়োজন থাকে না।

পক্ষান্তরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তীব্র বিরোধিতাকারী হিন্দুত্ববাদী শোষক জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী, স্মরণসভা, সঙ্গীতসভা ইত্যাদি জাঁকজমকভাবে সোৎসাহে আয়োজন করা হয় ঢাবিতে— যেন স্যার সলিমুল্লাহ নয়, রবীন্দ্রনাথই ঢাবির প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক নায়ক! অথচ রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ঢাবি প্রতিষ্ঠার অন্যতম বিরোধিতাকারী!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘মক্কা ইউনিভার্সিটি’ বলে ব্যঙ্গ করতেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও শ্রী আশুতোষ মুখার্জিরা। ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলিকাতার গড়ের মাঠে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করে বলা হয়, মুসলমান চাষাভূষার ছেলেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কী করবে? তখন শোষক হিন্দু জমিদারদের ছিল এমন সাম্প্রদায়িক মন-মানসিকতা! এই হিন্দুত্ববাদী মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাবের সাথে আজকের মিসবাহ কামালদের বক্তব্য মিলিয়ে নিন।

মোদ্দা কথায়, ১৯২১ সালে কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু জমিদারশ্রেণি কর্তৃক শোষিত ও নিপীড়িত বাংলাদেশের গরিব মুসলিম প্রজাদের শিক্ষার্জনের কল্যাণে ও স্বার্থে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আজকে আবারও হিন্দুত্ববাদী শোষক জমিদার প্রেতাত্মারা জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে।

এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে প্রতি বছর সাড়ম্বরে বিভিন্ন পূজা উদযাপন করা হয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো হলে কুরবানির ঈদ উদযাপন হওয়ার নিউজ বা রিপোর্ট আমরা কখনো পাইনি।

যদি কোনো হলে মুসলিম শিক্ষার্থীরা গরু জবাই করে কোরবানির ঈদ উদযাপন করতো, তাহলে আর যায় কোথায়, সাম্প্রদায়িকতার জিগির তুলে হল থেকে তাদের বহিষ্কার করার আওয়াজ তুলতো ইসলামবিদ্বেষী সেক্যুলার মিডিয়াকুল।

চারুকলায় অঘোষিতভাবে গরুর মাংস রান্না নিষিদ্ধ সেটা আমরা ইতোমধ্যেই জানি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দুদের পূজার আয়োজন হলে সমস্যা নাই; কিন্তু কুরবানির ঈদ উদযাপন হতে পারবে না। মাদরাসার স্টুডেন্টরা পড়তে পারবে না। কথিত সেক্যুলারিজমের নামে নামকরণ থেকে ‘ইসলাম’ ও ‘মুসলিম’ শব্দদ্বয় কেটে দিতে হবে। এই ইসলামবিদ্বেষী মন-মানসিকতার সাথে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কলকাতার হিন্দু সম্প্রদায়ের মুসলিমবিদ্বেষী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের ইতিহাস স্মরণ করুন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতেও মাদরাসা শিক্ষার্থীরাই প্রথম


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ