সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
বহুল আলোচিত নিপীড়নমূলক আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭সহ ৫টি ধারা বিলুপ্ত করে ২৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রস্তাবিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’র খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। তবে বিলুপ্ত করা আইসিটি অ্যাক্টের এই ধারাগুলো প্রস্তাবিত নতুন আইনে বিভিন্নভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ।
এছাড়া অনুমোদন পাওয়া আইনের খসড়ায় কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ সংক্রান্ত ৩২ ধারায় সাংবাদিকরা হয়রানির শিকার হতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
আইনটি সংসদে পাস হলে আইসিটি অ্যাক্টের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারাগুলো বিলুপ্ত হবে। অপরদিকে, অনুমোদন পাওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ‘কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ’ সংক্রান্ত ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার কোনো ধরনের গোপনীয় বা অতি গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা সংরক্ষণে সহায়তা করেন তাহলে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ বলে গণ্য হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শাস্তি অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। আর এই অপরাধ
যদি একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার করেন বা বারবার করেন তাহলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’ সংবাদকর্মীসহ সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এ ধারার আওতায় গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে নতুন করে নিপীড়ন ও হয়রানির শিকার হতে পারেন।
এ বিষয়ে সাংবাদিক নেতারা বলেছেন, আইনটি সংসদে পাস করার আগে বিস্তারিত আলোচনার দরকার আছে। গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের মতামত নিয়ে আইনটি সংসদে পাস করা উচিত। অন্যদিকে আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ আইনে বাকস্বাধীনতাকে অপরাধে পরিণত করা হয়েছে। ফিরে যাওয়া হয়েছে মধ্যযুগে।
প্রস্তাবিত আইনের ২৯ ধারায় মানহানির শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। যা আগে ছিল আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারায়। ওই আইনে শাস্তি ছিল ১৪ বছর এবং ধারাটি ছিল জামিন অযোগ্য। কিন্তু নতুন আইনে সাজা কমানো হয়েছে এবং ধারাটি জামিনযোগ্য করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, ‘কেউ মানহানিকর কোনো তথ্য দিলে তাকে তিন বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।
প্রস্তাবিত আইনের সংজ্ঞায় ডিজিটাল উপাত্ত ভাণ্ডার বলতে টেক্সট, ইমেজ, ভিডিও বা অডিও আকারে উপস্থাপিত তথ্য, জ্ঞান, ঘটনা, মৌলিক ধারণা বা নির্দেশাবলী বোঝাবে। কোনো বাহ্যিক তথ্য পরিকাঠামো যা কোনো তথ্য-উপাত্ত বা ইলেকট্রনিক তথ্য যদি সরকার নিয়ন্ত্রণ, প্রক্রিয়াকরণ, সঞ্চারণ বা সংরক্ষণকরণ করে, যা ক্ষতিগ্রস্ত বা সঙ্কটাপন্ন হলে জননিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক
নিরাপত্তা বা জনস্বাস্থ্য, জাতীয় নিরাপত্তা বা রাষ্ট্রীয় অখ-তা বা সার্বভৌমত্বের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে- তাকে এ আইনে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। বাইনারি বা ডিজিটভিত্তিক প্রযুক্তি পদ্ধতিতে কাজ করে- এমন সব কিছুই এ আইনে ‘ডিজিটাল’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। ইলেকট্রিক্যাল, ডিজিটাল, ম্যাগনেটিক, অপটিক্যাল, বায়োমেট্রিক, ইলেকট্রোকেমিকেল, ইলেকট্রোমেকানিকাল, ওয়্যারলেস, ইলেকট্রোম্যাগনেটিক টেকনোলিজিও এর অন্তর্ভুক্ত হবে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৫৪(ক) ধারা অনুযায়ী আইনটির ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২ ও ৩৪ ধারার অপরাধ জামিন অযোগ্য।
আর ৫৪(খ) ধারা অনুযায়ী আইনের ২০, ২৫, ২৯ এবং ৪৮ ধারার অপরাধ জামিনযোগ্য। ইতিমধ্যে ৫৭ ধারার করা চলমান মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অতীতের মামলাগুলো যথারীতি চলবে। তবে আদালতকে মনে করতে হবে এ সংক্রান্ত কোনো আইন নেই। তিনি যে রায় দেবেন সেটাই চূড়ান্ত।’
বলা যায়, ৫৭ ধারাকে ভেঙে চারটি ধারা করা হয়েছে। এখানে বিভিন্ন ধরনের বাকস্বাধীনতাকে অপরাধে পরিণত করা হয়েছে। এ সম্পর্কে কোনো রিরূপ মন্তব্য করা যাবে না, প্রশ্ন করা যাবে না, সমালোচনা করলে সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদ- হবে। স্বাধীন দেশে এসব আইন শুনে কার না দুঃখ লাগে! নতুন আইন অনুযায়ী ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ন করলে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টি করলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তা ব্লক বা অপসারণের জন্য টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে।
খসড়া আইনে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালনের জন্য জাতীয় কম্পিউটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম গঠন এবং প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের কথা বলা হয়েছে।
সম্পাদক পরিষদ খুব শিগগিরই প্রস্তাবিত এই খসড়া আইন নিয়ে পর্যালোচনা বৈঠক করবেন বলে জানা গেছে। আশা করি সরকারও গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের মতামত নিয়ে প্রস্তাবিত আইনটি সংসদে পাস করানোর উদ্যোগ নিবেন।
লেখক: কবি, কলাম লেখক ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম
এসএস/