সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
গত কয়েকমাস ধরেই দেশে অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে ডলারের দাম। আন্তর্জাতিকভাবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গত কোনো কারণ না থাকলেও দেশ থেকে টাকা পাচার বেড়ে যাওয়ার কারণেই এভাবে ডলারের চাহিদা ও মূল্য বেড়ে চলেছে বলে ধরে নেওয়া যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এক বছরে ডলারের দাম বেড়েছে ৪ টাকা। গত বছর ১৭ জানুয়ারি এক ডলারের দাম ছিল ৭৮ দশমিক ৯০ টাকা আর চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি তা বিক্রি হয়েছে ৮২ দশমিক ৮৪ টাকায়।
আন্তর্জাতিক এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বিগত এক দশকে দেশ থেকে ৬ লাখ কোটি টাকার বেশি বিদেশে পাচার হয়েছে। প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নির্বাচনের বছরগুলোতে দেশ থেকে টাকা পাচারের হার অন্য সময় থেকে অনেক বেশি।
চলতি বছরের শেষদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনার মধ্যে এ বছরেও টাকা পাচার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। তাহলে কি বলা যায়, ডলারের মূল্য বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে টাকা পাচারের প্রভাবই পরিলক্ষিত হচ্ছে?
অভিযোগ রয়েছে, কয়েকটি ব্যাংক কারসাজি করে ডলারের দাম বাড়াচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে চড়া দামে ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংককে কম রেট দেখাচ্ছে কয়েকটি।
এর আগে নভেম্বরের শেষ দিকে ডলার নিয়ে কারসাজির অভিযোগে তিনটি বিদেশি ও ১৭টি দেশীয় ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্ক করে নোটিসও প্রদান করেছিল। কিন্তু সে সময় ব্যাংকগুলো সন্তোষজনক কোনো জবাব দেয়নি, বরং এক মাসের ব্যবধানে ডলার নিয়ে নতুন করে কারসাজিতে মেতেছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ।
একাধিক গণমাধ্যমে প্রকাশ, বিশেষ একটি গোষ্ঠী অর্থ সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডায় হুন্ডির মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের টাকা পাঠিয়ে এসব দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রাসাদ গড়ে তুলছে। অনেকে বাণিজ্যিক ভবনও ক্রয় করছেন। অর্থ পাচারের সাথে মূলত যারা জড়িত তারা হচ্ছে গডফাদার, চোরাচালানকারী, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী, মাদক কারবারিসহ একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী, যারা মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে পণ্য আমদানি ও রফতানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েজিং ও ওভার ইনভয়েজিং করে অর্থ পাচারে লিপ্ত থাকে।
এ ছাড়া একশ্রেণীর জনগোষ্ঠী দেশের বাইরে বা উন্নত দেশে স্থায়ীভাবে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাসের জন্য অবৈধভাবে এই অর্থ পাচারে লিপ্ত থাকে। অনেক ঋণখেলাপিও অর্থ পাচারের সাথে জড়িত থাকতে পারে বলে ধারণা করা যায়।
আমার ধারণার সমর্থনে উল্লেখ করা যায়, ২০১৬ সাল শেষে জনতা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকÑএই চারটি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। বিপুল ঋণের এই পরিসংখ্যান কি মুদ্রা পাচারের ইঙ্গিত হতে পারে না?
প্রসঙ্গত, অব্যাহতভাবে ডলারের দাম বাড়ায় সংকটে পড়েছেন আমদানিকারকরা। সা¤প্রতিক সময়ে আমদানী ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেলেও সে অনুপাতে রফতানি আয় বাড়ছে না। আমদানী অনুপাতে রফতানী না বাড়ার পেছনে টাকা পাচারের কারসাজিকেই দায়ী করা যায়। আমদানী পণ্যে ওভার ইনভয়েসিং দেখিয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাচার করা হচ্ছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থান থেকে রেমিটেন্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রির্জাভেও নেতিবাচক টান পড়েছে বলে জানা যায়। সেই সাথে বাণিজ্য ঘাটতিও বেড়ে চলেছে।
বৈদেশিক বাণিজ্য ডলারের মাধ্যমে হয়ে থাকে বলেই ঘাটতি বাণিজ্যের প্রভাব পড়ছে ডলারের বাজারে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি টাকা পাচারকারিদের জন্য তেমন কোনো সমস্যা না হলেও দেশের বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছে। এর ফলে আমদানী পণ্যের মূল্য বেড়ে যাচ্ছে এবং খুচরা বাজারেও পণ্যমূল্য বেড়ে যাচ্ছে। এতে প্রতিনিয়ত ভোগান্তি বাড়ছে সাধারণ ভোক্তাদের।
ডলারের মূল্য ও চাহিদা বৃদ্ধির কারণে চিকিৎসা এবং কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশগামী যাত্রীদের ডলার সংগ্রহ করতেও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বলে জানা গেছে।
গ্লোবাল ফিনানসিয়াল ইন্টিগ্রিটি(জিএফআই) রিপোর্ট অনুসারে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে কমপক্ষে ৬ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, আর এ সময়ে দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ হয়েছে ৯৯ হাজার কোটি টাকা।
অর্থাৎ বিনিয়োগের ছয় গুনের বেশি টাকা বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে বলতে হয়-কেন্দ্রিয় ব্যাংকের সতর্ক নজরদারি থাকলে এত বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার করা সম্ভব হতো না নিশ্চয়ই। যদিও শোনা যাচ্ছে, পাচারকৃত ৬ লাখ কোটি টাকা ফেরাতে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এ প্রয়াস কতটা সফল হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
মুদ্রা পাচার রোধকল্পে যদি বাংলাদেশের সব বিমানবন্দর, স্থলবন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ বর্ডার এরিয়া, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বাংলাদেশের সব এলসি (খ/ঈ) লগ্নিকারী ব্যাংকগুলো, আমদানি ও রফতানি কার্যালয়সহ, দুদক, পুলিশ, এনএসআই, শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরসহ বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন করা যেতে পারে। এই সমন্বয়ের মাধ্যমে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণের পাশাপাশি আইনের যথাযথ প্রয়োগ সম্ভব হলে মুদ্রা পাচার রোধ করা সম্ভব হতে পারে বলে মনে করি।
তবে জরুরি ভিত্তিতে করণীয় হচ্ছে, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণ সুচিহ্নিত করা। ডলারের বাজারের উপর নজরদারি বাড়ানো এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার পাচার রোধ করতে ইনভয়েসিং ও আমদানী-রফতানী বাণিজ্যের গতিবিধির উপর নজর রাখা।
একই সাথে এনবিআরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এনবিআরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব সংস্থায় ডিজিটাইজেশন ও সুশাসন বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে আইনের প্রয়োগ ও এ সম্পর্কে সচেতনতা। এসব পদক্ষেপের শতভাগ কার্যকারিতাই নিশ্চিত করতে পারলে অর্থ পাচার রোধ সম্ভব।
সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন : কবি, কলাম লেখক ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম