মুফতী মানসূরুল হক
শাইখুল হাদিস ও প্রধান মুফতি, জামিয়া রাহমানিয়া (আলী এন্ড নুর রিয়েল এস্টেট)
নিম্নে লিখিত পদ্ধতিগুলো অবস্থা ও সুযোগ অনুযায়ী লৌকিকতাবশত হলেও অবলম্বন করবে।
১। চিকিৎসার প্রাথমিক অবস্থায় প্রত্যহ নির্ধারিত সময়ে আধাঘন্টা বা তার কম সময় একাগ্রচিত্তে কোন নির্জন স্থানে বসে নিজের সৃষ্টি, বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যত এ তিন বিষয়ে চিন্তা করবে। অর্থাৎ, এভাবে চিন্তা করবে যে, আমার আসল অবস্থা হলঃ-
- নাপাক পানির ফোটা থেকে আমার সৃষ্টি।
- অতঃপর নাপাক রক্তের মাধ্যমে প্রতিপালিত হয়েছি।
- এবং বর্তমানেও সারা শরীর নাপাকীতে পরিপূর্ণ কারণ শরীরের মধ্যে রক্ত, পেশাব ও পায়খানা আছে।
- পেটের নাপাকী তো আরো দুর্গন্ধযুক্ত। সর্বদা এ নিয়েই তো বিচরণ করছি। এর থেকে সামান্য বায়ু বের হলে পার্শ্ববর্তী লোকদের তো কষ্ট ও ঘৃনা হয়ই নিজেরও কষ্ট ও লজ্জিত হতে হয়। আল্লাহ তা‘আলা নিজ গুণে এগুলোকে গোপন রেখেছেন যে পেটের ঐ নাপাকী দৃষ্টিতেও আসে না এবং সর্বদা প্রকাশও হয় না।
- পেট পূর্ণ হওয়ার পর তা ময়লা আকারে সহজভাবে নির্জনস্থানে বের করার ব্যবস্থা করেছেন। যদি তা বন্ধ হয়ে যেত তাহলে কতইনা মুসীবত হতো।
- এমনিভাবে মৃত্যুর পর এ নাপাক শরীরকেও গোসল দিয়ে আতর খুশবু লাগিয়ে আল্লাহ তা‘আলা নিজ গুণে মাটিতে গোপন করার হুকুম দিয়েছেন।
অন্যথায় যদি এ মৃত শরীর দু তিন দিন মাটির উপর থাকত তাহলে দুর্গন্ধে মানুষকে ঘর বাড়ি ও এলাকা ছাড়তে হতো। সকলে পেরেশান হতো।
অতঃপর কবরের মধ্যে এ সুন্দর চেহারা-নাক কান চক্ষু গোস্ত পঁচে গলে পোকামাকড়ের খাদ্য হয়ে মাটির সাথে মিশে যায়, দুনিয়াবাসীর জন্য কোন সমস্যা সৃষ্টি করে না, এগুলো আল্লাহ তা‘আলা নিজ অনুগ্রহ ছাড়া আর কিছুই না।
(২) শাসকবর্গ ও ধনাঢ্য লোকদের সাথে উঠাবসা এবং তাদের সাহচর্য ত্যাগ করবে। চাই এতে দীনের দাওয়াত এবং অভাবগ্রস্থ লোকদের সাহায্য সহযোগিতা ইত্যাদি কল্যাণজনক কাজ হাত ছাড়া হোক না কেন।
(৩) গরীবলোকদের সাথে থাকবে, তাদের দাওয়াত কবুল করবে। তাদের কাজ কর্ম করে দিবে। সাধারণ লোকদের খেদমত করবে।
(৪) চাকর, নওকর, সন্তানাদি থাকা সত্ত্বেও ঘরের কাজ কর্ম যেমনঃ বাজার সদাই, শাক সবজি আটা ময়দা ইত্যাদি নিজেই শক্তি অনুযায়ী বহন করতে চেষ্টা করবে। অপারগতা ছাড়া মজদুর তালাশ করবে না বরং যে পয়সা মজদুরকে দিতে সেটা গোপনে দান করে দিবে।
(৫) সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে যে কেউ হোক না কেন প্রথমে নিজে তাকে সালাম দিবে। কখনো অন্যের সালামের আশা বা অপেক্ষা করবে না। এটা অহংকারের আলামত।
এ ব্যাপারে বিনয়ী এবং সাধারণ লোকদের খেদমতই বেশী উপকারী। মাশায়েখে কিরামের খেদমত তো গর্ব ও বড়ত্বের জিনিস।
(৬) নিজের ব্যাপারে গীবত কুৎসা রটনা, অপবাদ ইত্যাদি শুনে প্রতিবাদ ও নিজের সাফাইয়ের ফিকির করবে না। বরং নিজের আত্মিক দোষ ত্রুটিকে সামনে রেখে শুকরিয়া আদায় করবে যে, আমার অসংখ্য দোষত্রুটির মধ্য থেকে অনেক অল্পই বর্ণনা করা হয়েছে। আর এর মধ্যে আমারই ফায়দা হয়েছে যে, গুনাহসমূহের কিছু কাফফারা হয়ে গেছে। এবং গীবতকারী তার নেকীগুলী আমাকে হাদিয়া দিয়েছে। সুতরাং তার উপর রাগ করা অনর্থক কাজ, কারণ নেকীর হাদিয়া তো আপনজনও দিবে না।
(৭) কখনো যদি গোস্বা প্রকাশ পেয়ে যায় তাহলে ছোটদের থেকেও ক্ষমা চেয়ে নিবে। এ ব্যাপারে লজ্জা শরমকে প্রশ্রয় দিবে না। কারণ জুলুম হয়ে থাকলে হাশরের ময়দানের আযাব দুনিয়ার সামান্য লজ্জা থেকে অনেক কঠিন হবে।
(৮) কেউ যদি তোমার হক নষ্ট করে অথবা তোমার উপর বাড়াবাড়ি করে তাহলে নিজ হক উসূল করার বৈধ চেষ্টাতে দোষ নেই। তবে প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করবে না।
(৯) সকলের সহীহ ও সঠিক উপদেশ ও রায় মানার জন্য তৈরী থাকবে। তবে শর্ত হল এ নসীহত তবীয়তের খেলাপ হতে পারে। কিন্তু শরী‘আতের খেলাপ না হতে হবে। যদি কোন বিষয় একেবারে বুঝে না আসে তাহলে যোগ্য কারো সাথে মাশওয়ারা করে নিবে।
(১০) যদি সদকা, যাকাত ইত্যাদি গ্রহণের উপযুক্ত হও এবং গ্রহণও করো তাহলে গোপনে নেওয়ার পরিবর্তে প্রকাশ্যে অন্যদের সামনে নিবে। সাধারণ সদকার তুলনায় যাকাত বেশি নিবে কেননা এতে বিনয় বেশি প্রকাশ পায়।
তারপর নিজের প্রয়োজন না হলে তা সদকা করে দিবে। কেননা দান সদকা করাও কিবিরের এক বড় চিকিৎসা।
(১১) মৃত্যুকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করবে এবং যেখানেই সুযোগ হয় পূর্ণ চেষ্টা করে ইহতেমামের সাথে মৃতের দাফন কাফনের মধ্যে শরীক হবে। বিশেষ করে নিজ হাতে গোসল দিবে, কবরে রাখবে। যদি গোসল দেয়ার অভিজ্ঞতা না থাকে তাহলে কমপক্ষে মৃতের শরীরে পানি ঢেলে দিবে অথবা অন্য কোন খেদমত আঞ্জাম দিবে।
(১২) নির্জনে উপরোল্লেখিত বিষয়ের মোরাকাবা করবে। সাথে সাথে অহংকারী ও বিনয়ী লোকদের ঘটনাবলীও পড়তে থাকবে। এরজন্য ‘আকাবির কা তাকওয়া’ ‘আকাবিরে উলামায়ে দেওবন্দ’ ইত্যাদি কিতাবসমূহ অনেক উপকারী।
অহংকারের চিকিৎসার ব্যাপারে মাওলানা সাঈদ আহমাদ খান সাহেব রহ. এর অমূল্যবাণী তিনি বলেনঃ এক হাদীস শরীফে এসেছে-
تَمَعْدَدُوا وَاخْشَوْشَنُوا وَامْشُوا حُفَاة
অর্থাৎ, সাদাসিধা খাওয়া দাওয়া কর, মোটা কাপড় পরিধান কর, কখনো কখনো জুতা ছাড়া চলাফেরা কর। এছাড়া অহংকারের চিকিৎসা এটাও যে, জামা, পায়জামা সুন্নাত তরীকায় পায়ের গোছার মাঝামাঝি পর্যন্ত পরিধান করবে। জামা কাপড় তালি লাগানো ছাড়া পরিত্যক্ত করো না। কখনো কখনো সাধারণ খাবার যেমন : সিরকা, নিম্নমানের খেজুর ইত্যাদি খাও। কখনো কখনো সাধারণ বাহনেও যেমন রিকশায় আরোহন কর। এসব আমল অহংকারের চিকিৎসার নিয়তে কর।
(শাইখুল হাদীস কুতবুল আলম হযরত মাওলানা যাকারিয়া রহ.-এর রচিত উম্মুল আমরায কিতাব থেকে সংগৃহীত)
এসএস/