ইযাযুল হক
এক.
একটি বই নিয়েই এ লেখাটি। এই ক্ষুদ্র জীবনে পড়া বইগুলির মধ্যে অন্যতম পাওয়ারপুল বই হয়ে থাকবে এটি। লাইব্রেরি থেকে বাসায় এসে বসেছি আর একশো বিশ পৃষ্ঠার পুরো বইটি শেষ না করে উঠতে পারিনি।
বইটি পড়তে পড়তে কখনো কুটকুটিয়ে হেসেছি। কখনো ঠোট কামড়ে অশ্রুসংবরণ করা ব্যর্থ চেষ্টা করেছি। কখনো আবার নিজেকেই ধিক্কার দিয়েছি। আমাকে মনে হয়েছে পৃথিবীর ঘৃণ্যতম প্রাণী; ইতিহাসের নর্দমার ভাগাড়েই আমাকে ছুঁড়ে ফেলা উচিত!
মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়েছি বলে কি আমাদের বোধ জাগ্রত হয় না?
কেন আমরা মুসলিম হয়েও মুসলিম না? কেন?
কেন আমরা অমুসলিমদের ইসলাম গ্রহণের অন্তরায়?
বইটি পড়ে ঈমান বেড়েছে। নাহ! ঈমান নবায়ন হয়েছে বললেই যথার্থ হবে। নিজেকে একজন আলিম পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত হই। এখন থেকে শুধু সত্যিকারের মুসলিম হতে চাই।
দুই.
দুই সহোদর বোনের জীবনের গল্প 'ফেরা'। বইয়ে দুটি অংশ। প্রথম পর্ব সিহিন্তার গল্প। দ্বিতীয়টি নাইলাহর। দুজনেই নিজের কলমে বয়ান করেছেন সেই শিহরণজাগানিয়া কাহিনী।
স্বতঃস্ফূর্ত বলে গেছেন কীভাবে তাঁরা ফিরেছেন আপন আপন নীড়ে। অনেক চড়াই-উৎড়াই পাড়ি দিয়ে; বন্ধুর পথ মাড়িয়ে। মোটেও মসৃণ ছিল না এ পথ তাঁদের জন্যে। খৃস্টান মাকে বিয়ে করতেই মুসলিম বাবা চার্চে ঘোষণা দিয়ে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। চরম ইসলামবিদ্বেষী মায়ের কাছে জিম্মি বোনদ্বয় শেষ পর্যন্ত কীভাবে এসেছেন হিদায়াতের পথে- তাই আলোচিত হয়েছে পুরো বইজুড়ে।
তিন.
খৃষ্টধর্মের ধাঁধা থেকে নাস্তিকতার চোরাবালিতে আঁটকে যাওয়া সিহিন্তার জীবনে কীভাবে উদিত হয়েছিল হিদায়াতের প্রভাতরবি, সে এক রোমাঞ্চকর কাহিনী। চরম ইসলামবিদ্বেষী খৃষ্টান-কমিউনিটিতে বেড়ে-ওঠা এই ভদ্র মহিলা স্বাভাবিকভাবেই ইসলামবিদ্বেষী ছিলেন।
যত অনুরাগ, সবই খৃষ্টধর্মের প্রতি। পরিবারের মুখউজ্জ্বলকারী ধর্মপালনে নিষ্ঠাবান সেই সিহিন্তাই বই পড়তে পড়তে একসময় নাস্তিকবাদে মন দেন। পুরোদস্তুর একজন নাস্তিকই ভেবেছিলেন নিজেকে। তবে এতেই প্রশান্ত ছিলেন না তিনি। খৃষ্টবাদ থেকে বিতৃষ্ণার কারণেই সাময়িক এই ভনিতা। তিনি তো খুঁজে ফিরছিলেন এক মহাসত্য!
বইপড়া ছাড়া অন্য তেমন কোনো মাধ্যম ছিল না তাঁর। তখনও ইসলাম সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণাই ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে খানিকটা জানাশোনা হলো। শুরু হলো অন্য এক জীবন। ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করতে করতেই এক সময় মুসলিমাহ হয়ে যান।
পরিবারের সঙ্গে তুমুল সংগ্রাম করে পাড়ি দেন পরবর্তী ধাপগুলো। ঈমানী পরীক্ষার সবগুলো পর্যায় পার হয়ে একসময় ঘর ছাড়ার সাহসী সিদ্ধান্ত নেন। ইসলামের জন্যই শুধু ছিন্ন করেন পরিবারের মায়াজাল।
চার.
নাইলাহর গল্পটা অনেকাংশেই সিহিন্তানির্ভর। ছোট বোনের সাথে সবকিছুই শেয়ার করতেন তিনি। তাঁর সাথে গোপনে ইসলামও গ্রহণ করেন নাইলাহ। তবে তিনি তেমন সিরিয়াস ছিলেন না প্রথমে। অনেকদিন হাবুডুবু খেয়েছেন সন্দেহের সাগরে। তবে সিহিন্তার পরিবারত্যাগের পর মোড় ঘুরে যায় নাইলাহরও। তিনি এবার একটু সিরিয়াস হলেন। ইসলামকে জানতে শুরু হলো নতুন করে জ্ঞানযাত্রা।
আল্লাহ তাঁকে ফিরিয়ে দেননি। তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন হিদায়াতের আলোকবর্তিকা। অনেক বাধাবিপত্তি মাড়িয়ে একসময় সিহিন্তার মতো তিনিও কোনো মুসলিম ভাইয়ের হাত ধরে পরিবার ত্যাগ করতে চাইলেন। ইসলামকে স্বাধীনভাবে পালন করতে। অনেক নাটকীয়তার পর পরিবারের সম্মতিতেই বিয়ে হলো তাঁর।
দুবোনই এখন মা, লেখিকা, সম্পাদিকা। বাবাকেও ফিরিয়ে এনেছেন আলোর পথে। সিহিন্তা চান, খৃষ্টানদের যাবতীয় ভণ্ডামো থেকে তারা বেরিয়ে আসুক। সেই ধর্মে তারা ফিরে আসুক, শেষ যুগে যিশু যে ধর্মের হয়ে লড়বেন। আর যেসব নামধারী মুসলিমের কারণে ইসলাম গ্রহণ করতে তিনি বারবার দ্বিধান্বিত হয়েছেন, তাদেরকে বলেছেন, কাল কেয়ামতের ময়দানে রাব্বে কারীমকে কী জবাব দেবেন?
পাঁচ.
লেখিকাদ্বয়ের কলমের প্রশংসা করতেই হয়। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় গোগ্রাসে গিলার মতো ভাষা মাশাআল্লাহ। আল্লাহ তাঁদের কলমকে আরো শাণিত করে দিন। সম্পাদক মহোদয়কে শুধু বলতে চাই, জাযাকাল্লাহ। শরয়ী সম্পাদনার বিষয়টি নিশ্চয় প্রশংসার দাবি রাখে।
বইয়ের প্রচ্ছদ বেশ আকর্ষনীয় ও যথার্থ। কাগজ ও ছাপার মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকতেই পারে না। হাতেগোনা কয়েকটি ছোটখাটো অসংগতি বাদ দিয়ে বলতে হয়, অসাধারণ! সত্যিই অসাধারণ!!
'ফেরা' পড়ে নীড়ে ফিরবেন অনেকেই -ইনশাআল্লাহ। আমি ফিরেছি। আপনিও হয়ত ফিরবেন। হয়ত অনেকেই ফেরার অপেক্ষায়। কতো খৃস্টান ফিরতে চায়। কতো এগ্নোস্টিক ও নাস্তিক ফিরতে চায়? কতো ভ্রান্ত মুসলিম ফিরতে চায়। তাদের হাতে কে তুলে দেবে একটি 'ফেরা'? আমার আপনার একটি 'ফেরা-উপহার'ই হয়ত ঘরে ফেরাবে শত নীড়হারা পাখিকে।
বই সম্পর্কে
‘ফেরা’
লেখক: সিহিন্তা শরীফা ও নাইলাহ আমাতুল্লাহ
সম্পাদনা: শরীফ আবু হায়াত অপু
শরঈ সম্পাদনা: সানাউল্লাহ নজির আহমদ
প্রকাশক: সমকালীন প্রকাশন
পরিবেশক: সিজদাহ.কম
গায়ের দাম: ১৫০ টাকা
এসএস/