ভারতের কয়েক লক্ষ চিকিৎসক মঙ্গলবার প্রায় আট ঘণ্টার এক ধর্মঘট এবং 'কালো দিবস' পালনের পরে সেই আন্দোলন সাময়িকভাবে তুলে নিয়েছেন।
চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের এক নতুন পরিকাঠামো গড়ার সরকারী প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন তারা।
এতদিন চিকিৎসা পরিষেবা আর ডাক্তারি-শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ করত চিকিৎসকদেরই নির্বাচিত যে মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া বা এমসিআই, তাকে আমূল বদলে ফেলতে একটি নতুন আইন আনতে চাইছে সরকার।
নতুন আইনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে এমসিআইয়ের বদলে যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হবে জাতীয় মেডিক্যাল কমিশনের হাতে।
বর্তমান ব্যবস্থায় চিকিৎসকদের মধ্যে থেকেই নির্বাচিত সংস্থা এমসিআইয়ের হাতে নিয়ন্ত্রণ থাকলেও প্রস্তাবিত কমিশনে চিকিৎসক ছাড়াও আমলা ও রোগীস্বার্থে কাজ করে এমন সংগঠনগুলিকেও রাখা হবে।
কমিশনের সিংহভাগ সদস্যই হবেন সরকারের মনোনীত। তারাই চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তদন্ত করা থেকে শুরু করে ডাক্তারি পাঠ্যক্রম ও চিকিৎসকদের রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করবে।
চিকিৎসকরা এই নতুন প্রস্তাবের বিরোধিতা করছেন।
এমসিআইয়ের পরিচালনায় অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি সহ নানা অভিযোগ অনেকদিন আগে থেকেই উঠেছে। একবার দুর্নীতির অভিযোগে গোটা কাউন্সিলকেই ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল।
ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রী জে পি নাড্ডা মঙ্গলবার পার্লামেন্টে বলছিলেন, "এটা স্পষ্ট করার দরকার আছে যে এই নতুন ব্যবস্থায় চিকিৎসা পেশা এবং দেশ - দুই-ই লাভবান হবে।"
তবে চিকিৎসকদের সিংহভাগ এই প্রস্তাবিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন।
চিকিৎসকদের সবথেকে বড় সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন বা আইএমএ-র প্রেসিডেন্ট ড. কে কে আগরওয়াল এক ওয়েবকাস্টে ব্যাখ্যা করেছেন, "এমসিআই-তে নির্বাচিত এবং মনোনীত - দুই ধরণের সদস্যই থাকেন। সেটা ভেঙ্গে দিয়ে যে এনএমসি তৈরির কথা বলা হচ্ছে, তার ২৫ জন সদস্যের মধ্যে ২০ জনকেই সরকার মনোনীত করবে। স্বশাসিত আর গণতান্ত্রিক যে ব্যবস্থাপনা এখন রয়েছে, সেটাকে ভেঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।"
মেডিক্যাল কমিশনের প্রস্তাবে এটাও আছে যে হোমিওপ্যাথি বা আয়ুর্বেদ পাশ করা চিকিৎসকেরাও একটা স্বল্প মেয়াদী কোর্স করে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা করতে পারবেন। তাদের পরীক্ষা ব্যবস্থা আর রেজিস্ট্রেশন নিয়ন্ত্রণ করবে মেডিক্যাল কমিশন।
চিকিৎসকদের একটা বড় অংশের বক্তব্য এমনিতেই হাতুড়ে বা জাল ডাক্তারে দেশ ছেয়ে গেছে। এর পরে যদি হোমিওপ্যাথি বা আয়ুর্বেদ ডাক্তারদেরও অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার লাইসেন্স দেওয়া হয়, তাহলে তার ফল হবে মারাত্মক। সেক্ষেত্রে চিকিৎসা বিভ্রাট বহু গুণে বেড়ে যেতে পারে।
আই এম এ-র প্রাক্তন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি ডা সুদীপ্ত রায় বিবিসিকে বলেন, "হোমিওপ্যাথি বা আয়ুর্বেদ যারা পাশ করেছেন, তাঁরা একটা ছোট কোর্স করেই কি অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারবেন? এটা কি সম্ভব?"
মঙ্গলবারই এন এম সি বিলটি পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় পেশ করার কথা ছিল। তার আগেই ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন সহ সবকটি চিকিৎসক সংগঠন দেশ জুড়ে কালা দিবস পালনের ডাক দিয়েছিল।
কয়েক লক্ষ চিকিৎসক তাই ধর্মঘট পালন করেছেন - যদিও প্রায় সব হাসপাতালেই জরুরী বিভাগ, ভর্তি হওয়া রোগীদের চিকিৎসার মতো বিভাগগুলি চালু ছিল কিন্তু বহির্বিভাগে ডাক্তাররা ছিলেন প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
পশ্চিমবঙ্গেও প্রতিবাদ হয়েছে চিকিৎসকদের।
আই এম এ-র রাজ্য শাখার সভাপতি ডা নির্মল মাজি বলছেন, "সরকারের মোসাহেব, তাদের পেটোয়া কিছু ব্যক্তি এবং আমলাদের নিয়ে এন এম সি তৈরি করার পরিকল্পনা হচ্ছে। যাদের মেডিক্যাল শিক্ষার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই, তারা কোন অধিকারে এই ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করবে? মেডিক্যাল কাউন্সিলের মতো একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দিয়ে মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজকে ছাড়পত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।"
তবে এমসিআই ভেঙ্গে দিয়ে জাতীয় মেডিক্যাল কমিশন গড়ার পক্ষেই মত দিয়েছেন রোগী স্বার্থে কাজ করে এমন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পিপলস ফর বেটার ট্রিটমেন্টের সভাপতি ডা. কুনাল সাহার।
"বাংলায় প্রবাদ আছে কাক কাকের মাংস খায় না। এখানেও ব্যবস্থাটা সেরকমই। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগের তদন্ত করে এমসিআই - যেটা সম্পূর্ণ চিকিৎসকদের ভোটে নির্বাচিত সংস্থা। হিসাব দেখলেই বোঝা যাবে কটা চিকিৎসকের গাফিলতি এম সি আইয়ের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে, অথচ অভিযোগ ভুরি ভুরি।"
তিনি আরও বলেন, উন্নত দেশে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে তদন্তে অন্য পেশার ব্যক্তিরাও যুক্ত থাকেন।
"তাই এটা এনএমসি বিলের একটা অত্যন্ত ভাল পদক্ষেপ। তবে এই প্রস্তাবিত আইনের খারাপ দিকও আছে। যেমন হোমিওপ্যাথি বা আয়ুর্বেদ ডাক্তারদের ব্রিজ কোর্সের শেসে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার লাইসেন্স দেওয়াটা সাংঘাতিক ভুল হবে।"
সরকার অবশ্য সার্বিক চাপের মুখে বিলটি সংসদের সিলেক্ট কমিটিতে পাঠিয়েছে আরও বিস্তারিত আলোচনার জন্য। সূত্র : বিবিসি