মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন। ইসলামি ধারার অন্যতম চিন্তাশীল লেখক। লিখছেন প্রায় তিন দশক ধরে। লেখক, অনুবাদক ও কথাশিল্পী হিসেবে তুমুল জনপ্রিয় এ আলেমের খ্যাতি এখন ছড়িয়ে পড়েছে বহিরাঙ্গণেও।
ভাষা, সাহিত্য ও সমকাল নিয়ে তার দীর্ঘ অধ্যয়ন, পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা তাকে সাহিত্য নিয়ে কথা বলার সার্বভৌম অধিকার দিয়েছে বলে মনে করেন সমালোচকরা।
সম্প্রতি আওয়ার ইসলামে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে লেখক যাইনুল আবিদীন কথা বলেছেন, তারুণ্যের জাগরণ, লেখালেখি ও সাহিত্যচর্চা নিয়ে। তিনি তার সাক্ষাৎকারে সময়ের একটি নিখুঁত মানচিত্র এঁকে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন তারুণ্যের পথরেখা। সাথে সাথে তিনি উত্তর দিয়েছেন তরুণ প্রজন্মের অনেক প্রশ্নের। তুলে ধরেছেন তরুণদের জন্য প্রবীণদের উত্তরাধিকারও।
নন্দিত আলেম লেখক ও কথাশিল্পীর সঙ্গে আলাপচারিতায় ছিলেন আওয়ার ইসলামের বার্তা সম্পদক আতাউর রহমান খসরু।
আওয়ার ইসলাম : বর্তমানে তরুণ প্রজন্ম নিখাঁদ সাহিত্য বলতে যা বোঝায়; যেখানে ধর্মের আশ্রয়টা নেই সেদিকে ঝুঁকছে। বিশেষত বইমেলাকেন্দ্রিক তাদের মাঝে এক প্রকার উদ্দীপনা কাজ করে।আপনি এটাকে কিভাবে মূল্যায়ন করছেন?
মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : সাহিত্য মূলত মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। পরিশিলিত রুচিজাত ও রুচিশীল মানুষের আবেগের অংশ। আপনার প্রশ্নে তরুণদের যে বিষয়টা এসেছে, এখানে একটা কথা মনে রাখা সমীচীন। আমরা যে ঘরানার লেখক বা তরুণদের নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি সে অঙ্গণটা দুই তিন দশক আগেও সাহিত্য লেখালেখি বিষয়ে শুধু বিমুখ ছিল বললেই কথা শেষ হবে না; বলা যায় বিরোধী ছিলেন।
আর এটা একটা স্বাভাবিক ও স্বভাবজাত বিষয়, যখন কোন মানুষ কোনো বিষয়ের বিরোধী হয়। এবং পরবর্তীতে সে বিষয়ের জানালা দরজা খুলে দেয়া হলে বিরোধকারীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
বর্তমান তরুণ প্রজন্ম ধর্মহীন সাহিত্য; বরং বলতে হয় ধর্ম বিরোধী সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিপরীতমুখী যে সাহিত্য সেই সাহিত্যের দিকে ঝুঁকছে। এটা এমন না যে আমাদের ঘরানার তরুণরা নতুন একটা জায়গা আবিষ্কার করে সেখানে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাদের দাঁড়ানোর স্থানটা অন্যদের তৈরি।
তারা এখন যেখানে নামছে, দীর্ঘকাল ধরে বহমান একটা স্রোত ধারা সেখানে বয়ে চলছে। তারা বিচার করছে না, এখানে নামার মধ্যে কী স্বার্থকতা আছে আমার জন্য? কি অপেক্ষা করছে? ইত্যাদি বাছ-বিচার না করে একটা স্রোতে পঙ্গপালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে। একদিক থেকে এটা একটা ঘটনা যে আমাদের শিবিরের তরুণরা সেখানে যাচ্ছে অন্যদিকে এটা আবার কিছুই না। বিষয়টা এমন যে, আগে থেকে বহমান একটা স্রোতে তারা সাঁতার কাটার জন্য নামছে। এদিক থেকে এটা কোন বড় ঘটনা না।
আওয়ার ইসলাম : যখন বড় কোনো স্রোতের সাথে ছোট একটা স্রোতের মিলন হয়, তখন ছোট স্রোতের পেছনে যে ধারা আছে তারাও কিন্তু এই বড় স্রোতের দিকেই প্রবাহিত হয়। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, এই যে বড় স্রোতের সাথে ছোট স্রোতের মিলনে তরুণরা গতি পাচ্ছি সেটা আমাদের জন্য কতটা উদ্বেগ বা আশার বিষয়?
মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : আপনি বাংলা ভাষার একজন লেখক, লেখালেখির সঙ্গে আপনার দীর্ঘদিনের সখ্যতা রয়েছে। সাহিত্য ও লেখালেখি বিষয়ে আপনার নিজেরও অভিজ্ঞতা আছে। আপনি জানেন, এই জায়গাটাতে যারা পুরোনো ও অভিজ্ঞ মানুষ তাদের মতামতের কাছেও আমাদের ফিরে যেতে হয়।
ধরুন, আমাদের অগ্রবর্তীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি আহমদ ছফা। তারা যখনর সাহিত্য করতে এসেছিলেন তখনকার সময়ের এমনকি যারা কমিউনিষ্ট অঙ্গণের কবি সাহিত্যিক, তারাও কিন্তু সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে উগ্রচিন্তাকে ভালো চোখে দেখেন নি।এটাকে অনেকে সাংস্কৃতিক মাস্তানি বলেছেন।
কবি আল মাহমুদকে দেখুন, তিন দশক আগে তিনি বইমেলাকে বলেছে, এটা এক ধরণের সাংস্কৃতিক মাস্তানি। বোঝা যায়, তারাও এই জায়গাটাকে খুব আকাঙ্ক্ষা জায়গা বা স্বপ্ন-আদর্শের জায়গা হিসেবে দেখেননি।
সেই হিসেবে আমরা তো আরও শক্ত একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের নিজস্ব একটা বিশ্বাস আছে। দেড় হাজার বছরের বিশ্বাস। পৃথিবীর বুকে আমাদের ঐতিহাসিক এই বিশ্বাসের উজ্জ্বল একটা ভাবমূর্তি আছে। সেই জায়গা থেকে যারা বের হচ্ছে, আমাদের আশা তো সেটাই থাকবে যে, তারা আমাদের বিশ্বাসের আলোটা চারদিকে ছড়িয়ে দেবে।
কিন্তু এই বিশ্বাসকে পাশ কাটিয়ে তারা যখন এমন কারও সাথে মিশে যায় যারা নিজেরাই যেখানে সাহিত্যকে বড় কোন আদর্শ বলে দাবি করতে পারে না। তাকে আশা জাগানিয়া কোন বিষয় বলে মনে করছি না বরং কিছুটা উদ্বেগের জায়গা।
আওয়ার ইসলাম : আমরা যখন এই বিষটা নিয়ে তরুণদের মুখোমুখি হই তারা স্বীকৃতির প্রশ্নটা সামনে নিয়ে আসে। তাদের ভাষ্যে বাংলা সাহিত্যে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য তারা সেখানে মিশে যেতে চাচ্ছে।এই যে স্বীকৃতির জন্য পরিচয় বিসর্জন দেয়া হচ্ছে। স্বীকৃতিটা একজন লেখকের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : স্বীকৃতির জন্যে কাজ করা এক ধরনের আত্মসমর্পণ। কোন আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন মানুষ নিজের চিন্তা রাসতায় ফেলে রেখে তারপর কারও সামনে স্বীকৃতির জন্য হাত পাতবে; এটা কোনো আভিজাত্য বা ব্যক্তিত্বের পরিচয় নয়।
আমাদের দেশে সাহিত্যে যেসব স্বীকৃতি দেয়া হয়, সেগুলোর পেছনে নানারকমের গল্প আছে। এমন শোনা যায়, এই পুরস্কারটা পাওয়ার জন্য অমুক ব্যক্তি অমুকের সাথে দেন দরবার করছেন । এই কথাগুলো বাতাসে উড়ে। বিপরীতে আবার অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তি আছেন যারা প্রতিষ্ঠান স্বীকৃতি দিতে চাইলেও নেন না। তারা সমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। তারা কাগজের স্বীকৃতি নেন নি কিন্তু তারা কাজ করেছেন। এখন তাদের জায়গাটা এমন যে তারা যদি অন্য কারও লেখাকে স্বীকতি দেন তাহলে তা প্রাতিষ্ঠানিক অনেক স্বীকৃতির চাইতেও অধিক মূল্য রাখে।
এখানেও ফিরে আসবে সেই সাহসিকতার কথা, নিজের ব্যাপারে আস্থা রাখা - আমি আমার শক্তিতে দাঁড়াতে পারব। নিজের চরিত্র ও আদর্শকে বিলিয়ে দিয়ে কারও সামনে গিয়ে একমুঠো স্বীকৃতির আশায় হাত পাতবো এটা কোন তরুণ সাহসী যুবকের কাজ হতে পারে না। এটা এক রকমের আত্মসর্পণ বলেই আমি মনে করি।
আওয়ার ইসলাম : স্বীকৃতির বাইরে আরেকটি বিষয় আছে।প্রতিনিধিত্ব। আমরা যদি ইসলামের কথা সাহিত্যে বলতে চাই তাহলে তো বাংলা সাহিত্যে আমাদের প্রতিনিধিত্ব থাকাটাও তো জরুরি। আর এটাই তো প্রত্যাশিত? উর্দু সাহিত্যের সেরা ২০ জনের তালিকা করলে ইসলামি মূল্যবোধসম্পন্ন অন্তত ৫ – ৭ জন প্রতিনিধিত্বকারী লেখক পাবেন। আমাদের বাংলা সাহিত্যেও কি থাকা দরকার না?
মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : আমাদের তরুণদের এ যুক্তি দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি। এখানে আমার দুটো কথা রয়েছে, এক. আমাদের অন্তরে লালিত বিশ্বাসকে ছড়িয়ে দিতে সমাজের সকল শ্রেণী ও স্থানে আমাদের জোরালো প্রতিনিধিত্ব থাকাটা জরুরি। কিন্তু আমরা হতাশার সাথে একটা জিনিস লক্ষ্য করি, একটা ছেলে প্রাইমারি থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত পড়ালেখা করে, একদিনের জন্যও মাদরাসায় না পড়ে তাবলিগ জামাত বা অন্য কোনো দীনি খেদমতের মাধ্যমে সে আমাদের প্রতিনিধিত্ব করছে। আমাদের আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করছে। কলেজে করছে, ইউনিভার্সিটিতে করছে, চাকরি জীবনে করছে।
আমাদের সন্তানদের বেলায় দেখা যায়, আমাদের বেলায় দেখা যায়, আমাদের তরুণরা কোন একটা সার্টিফিকেটের ছুঁতো ধরে ভার্সিটিতে যাওয়ার পর তার জীবনকে আরেকরকম করে ফেলে। তখন, আমরা নিজেরাই তো তাকে আমাদের অনুসারী বলতে লজ্জাবোধ করি।
সেখানে সে আমাদের প্রতিনিধিত্ব করার মানেটা কি? ইসলামের প্রতিনিধিত্ব শুধুমাত্র মুখে বলার বা কলমে লেখার বিষয় না। ইসলামের প্রতিনিধিত্ব যে করবে তাকে দেখে বোঝা যাবে, হ্যাঁ এই লোক ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে বা ইসলামের প্রতিনিধি।
কিন্তু যে ব্যক্তি জীবনে যাবতীয় যোগ্যতাকে বিসর্জন দিচ্ছে সে আবার আমাদের কি প্রতিনিধিত্ব করবে। ঐ প্রতিনিধিত্বের জন্য ইসলাম ঠেকায় পড়ে থাকবে আমি ব্যক্তিগতভাবে এটা বিশ্বাস করি না।
দুই. আমি এক্ষেত্রে যে কথাটা বিশ্বাস করতে চাই, আলেমরাই ইসলামের যাবতীয় বিষয়ের দায়-দায়িত্ব ধারণ করবে তা নয়। এই কথাটা আমি বিশ্বাস করতে চাই এবং আমি মনে করি, ইসলামের সব বিষয়ে সমস্ত মুসলমানের সমান অধিকার। সুতরাং, ইসলামকে সাধারণভাবে ও ব্যাপকহারে মুসলিমরা ধারন করবে। ইসলামকে সঠিক ও যথার্থভাবে মানুষ যেন জানে বুঝে সেজন্যে হয়ত বা এটা করা যেতে পারে যে, আমরা আমাদের সমাজকে ইসলামের দিকে টানতে পারি। সুতরাং স্কুল থেকে যারা আসছে তারা সেখানে প্রতিনিধিত্ব করবে। আমাকেই যে সবখানে যেতে হবে এটা এমন নয়।
আওয়ার ইসলাম : আপনি শেকড়হীন হয়ে যাওয়ার কথা বলছেন। কিন্তু শেকড়হীন করে দেয়ার ঘটনাও কম না।
মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : আমাদের কান পর্যন্ত যা কিছু আসে তার মধ্যে ব্যতিক্রম আছে। ভালোর ব্যতিক্রম আছে, ভয়াবহ মন্দের ব্যতিক্রম আছে। খুব স্বাভাবিক একটি শ্রেনি আছে যারা আওয়াজে করে না। এ ক্ষেত্রে খুব ভালো বা মন্দের অভিযোগকে ব্যতিক্রমের মধ্যে ফেলতে চাচ্ছি।
যারা অন্যত্র যাচ্ছে তাদের মধ্যে বড় অংশটাই তাদের নিজস্ব জীবনধারা তৈরি করে নিয়েছে। তাদের ব্যাপারে কারো আগ্রহ ও অভিযোগ নেই। কিন্তু খুব কম মানুষ এমন যারা সেখানে যেয়ে নিজের পূর্বের অবস্থায় টিকে আছে। আবার এমন মানুষের সংখ্যাও খুব কম যাদেরকে বহিষ্কার করতে হয় এবং তার পরিবারের লোকেরাও তাদের সন্তান নিয়ে স্বস্তিতে থাকে না।
ঢালাওভাবে কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো কঠিন। আমি বলবো, ছাত্র-শিক্ষক ও অভিভাবক সকলকেই যুক্তির ভেতর থাকতে হবে। যুক্তির বাইরে চলে গেলে সেটা সবার জন্য অস্বস্তিকর। এমনও তো কিছু ছেলে আছে যাদের স্বীকৃতি দিতে গেলে প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নিয়ে মানুষ প্রশ্ন তুলবে। যেখানে তার পরিবার তাকে পরিচয় দিতে অস্বস্তিবোধ করে সেখানে প্রতিষ্ঠানকে দোষ দিয়ে লাভ কি?
আওয়ার ইসলাম : সব হিসেবের পরও আমাদের তরুণরা যে কাজ করছে, তাদের মধ্যে জাগরণ এসেছে। তারা গল্প লিখছে, কবিতা লিখছে, বইমেলায় বই করছে। তা নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখতে চাই।
মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : এখানে দুটি দিক। এক. মাদরাসাপড়ুয়া আলেম। এ অবস্থান থেকে যখন কেউ কাজ করেন, তখন তিনি কমপ্লিট ইসলাম ও মুসলমানের প্রনিধিত্ব করেন। এরপাশে আরেক দিক হলো, সে আলেম হিসেবে কাজ করছে না। আবার তার কাজটা ইসলামের বিরুদ্ধে বা বাইরে যাচ্ছে না। বরং দূর থেকে ইসলামের উপর আলো ফেলছে। এমন জায়গায় আমাদের তরুণরা কাজ করছে।
আমি মনে করি, এটা আমাদের স্বপ্নের কাজের উচ্চস্তরে না হলে এ কাজগুলো প্রয়োজন। এ কাজগুলো ধীরে ধীরে আমাদের সুন্দর ভবিষ্যত নির্মাণে সাহায্য করবে। একেবারে হতাশ না হয়ে সামগ্রিক কাজকে একত্র করে বিচার করতে হবে। যারা তাদের লেখায় প্রচ্ছন্নভাবে ইসলামকে আশ্রয় দিচ্ছে, তাদের লেখা প্রচ্ছন্নভাবে ইসলামের কল্যাণে কাজে আসবে।
দলছুট মানুষ সব জায়গায়-ই থাকে। তা নিয়ে খুব আক্ষেপ করার কিছু নেই। দলছুট হয়ে মানুষ যে ইসলাম বিদ্বেষী হচ্ছে তা নয়। অনেকে ইসলামের দিকেও আসছে।
আওয়ার ইসলাম : সন্তান হারানো নিশ্চয় কোনো মায়ের জন্য সুখকর নয়। আমাদরে সন্তানগুলো যেনো আমাদের ছেড়ে না যায়, সেজন্য আমরা কি করতে পারি?
মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : আমাদের তরুণরা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠন করছে। নিজেদের সজীব ও সংঘবদ্ধ রাখতে সাহিত্যের কাগজ করছে। নিজেদের শেকড়ের সঙ্গে যুক্ত রাখার চেষ্টা তারা করছে। বিপরীতে তাদের ধরে রাখারও নানা উদ্যোগ আপনি দেখবেন। সেটা ঘোষণা দিয়ে হোক বা ঘোষণা ছাড়া।
সার্বিক প্রচেষ্টার কারণেই বড় একটি স্রোত দাঁড়িয়ে যাচ্ছে যারা তাদের সবকিছুতেই নিজের পরিচয়টা ধরে রাখতে সচেষ্ট। তবে এ জাতীয় উদ্যোগ আরও প্রসারিত হওয়া দরকার বলে আমি মনে করি।
আওয়ার ইসলাম : বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়লে দেখা যায়, প্রত্যেক যুগ পরবর্তী যুগের জন্য কিছু উত্তরাধিকার রেখে গেছে। ইসলামি ধারায় সাহিত্যচর্চা করছে এমন তরুণদের জন্য আপনারা এবং আপনাদের পূর্ববর্তীরা কি উত্তরাধিকার রেখে গেছেন। তরুণদের অভিযোগ পূর্বসূরীদের কাছ থেকে তারা উল্লেখ্যযোগ্য কোনো মিরাস লাভ করে নি?
মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : বাংলা সাহিত্যের এ দিকটাকে ঠিক আমাদের ঘরানার করে দেখা ঠিক হবে না। আহমদ ছফার বিখ্যাত বই ‘যদ্যপি আমার গুরু’-তে তিনি এ বিষয়ে একটি দাগ দিয়েছেন। তিনি প্রফেসর আবদুর রাজ্জাককে জিজ্ঞেস করেছেন, আপনি পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করলেন কেনো? তিনি উত্তর দেন, ‘পাকিস্তান হওয়ার শত শত বছর আগ থেকে এ দেশে আমরা ছিলাম। মুসলমানের জন্য জীবনযাপন আমরা এখানে করছি হাজার ধরে। কিন্তু এখানে যে কবি-সাহিত্যিকগণ সাহিত্যচর্চা করেছেন সেখানে মুসলমানের জীবনচিত্র দেখা যায় না। তাদের কবিতা, গল্প ও উপন্যাসে শুধু হিন্দুরা এসেছে। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পর অল্পকিছু গেছে। এখন আপনি আমাদের সাহিত্যটা দেখুন।
এখন বিপুল পরিমাণ মুসলিম জীবনচিত্র আমাদের সাহিত্যে উঠে এসেছে। কারণ হলো এর আগে সাহিত্যের নেতৃত্ব পুরোপুরি হিন্দুদের হাতে ছিলো। ফলে কোনো মুসলমান সাহিত্যচর্চা করলেও তাকে ছবিটা সেভাবেই আঁকতে হতো যেভাবে একজন হিন্দু লেখক তা গ্রহণ করতো।
এখানে আলেম ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের প্রশ্ন নয়। এখানে প্রশ্নটা হিন্দু মুসলিমের। যদিও এখন অনেক উদার সাহিত্যিক বলেন, সাহিত্যে আবার ইসলাম কি? তা যদি না হয় তাহলে প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের এ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আসতে। বলতে হবে, সাহিত্যে আবার হিন্দু কি?
এতো পেছনে যেতে হবে না, এখন কলকাতা থেকে দেশ পত্রিকাসহ অন্যান্যরা যে পূজা সংখ্যা করছে তার পুরোটাই কি হিন্দুত্ব না? এখানে হিন্দুত্ব প্রবলভাবে থাকার পরও আমি তাকে হিন্দু সাহিত্য না বলে কি বলতে পারি?
বাংলা সাহিত্য নিজেদের কব্জায় রেখে দেয়ার যে চেষ্টা সেখান থেকে বের হওয়ার ইতিহাসের সূচনা হয়েছে ১৯৪৭ সালে। সেখান থেকে ২০১৭ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক অর্জনা মুসলমানের। মুসলমানের এ অর্জনের মধ্যে দেখা যেতে পারে তাদের একান্ত ধর্মীয় বিষয়গুলো আলাদাভাবে, স্পষ্টভাবে আছে কিনা?
এ জায়গায় যদি আমরা ইনসাফের সাথে বিচার করি, তাহলে বলতে হবে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাংলা সাহিত্যের একটি বাঁক বদল হয়েছে। সেটা বিশ্বাস ও মূল্যবোধ, আদর্শ, সভ্যা-সংস্কৃতির দিক থেকে। এ বাঁকবদল ও তার অর্জন যদি সামগ্রিকভাবে মুসলমানের হয় তবে কি আমাদের কোনো অংশ নেই? এখানে একটি ভুল বিচার আছে। অথবা বিচারের একটি সূক্ষ্ম প্রহসন আছে। সেটা হলো, এদেশে বাংলা সাহিত্যকে যারা মুসলিম পরিচয়টা দিয়েছেন এবং পরিচয়টা বাঁচিয়ে রেখেছেন পরিচয়ের আলোচনা উঠলে তাদের এখানে কোনো অংশ দেয়া হয় না।
এরপর আলাদা করে আমাদের ধর্মের একটা জায়গা থাকবে। সেটা সব ধর্মানুসারীদের মধ্যে আছে। খ্রিস্ট, বৌদ্ধ ও হিন্দু সব ধর্মে আছে। তাহলে উলামায়ে কেরাম কোন অংশটা করবেন? তারা তাদের ধর্ম ও ভাষা দুটো নিয়ে একটি উচ্চারণ তৈরি করবেন।
আমি মনে করি, মাওলানা আকরাম খাঁ থেকে শুরু করে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবদী, মাওলানা নূর মোহাম্মদ আজমি, মুন্সি মেহেরুল্লাহ, মাওলানা মুহিউদ্দিন খান পর্যন্ত। তারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তো কাজ শুরু করেছেন।
বিচারের ক্ষেত্রে কর্মীর পরিমাণটাও দেখতে হবে। কর্মী ও সামর্থের পরিমাণটুকু ভুললে চলবে না। বাংলা সাহিত্যে মুসলমানের প্রথম দিন থেকে তারা তাদের কাজ শুরু করেছেন।আমি সাহস করে বলবো, তাদের কাজের মান সমকালের চেয়ে পিছিয়ে ছিলো না। একটা উচ্চারণ মুসলমানের এবং একটা উচ্চারণ ইসলামের এ কাজটা তারা করেছেন।
সাহিত্যচর্চায় কালের ভাষা, কালের রুচি যতোটা দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে আমি বিশ্বাস করি এবং ধরিয়ে দেখতে পারি আমাদের ধারার যারা কাজ করেছেন তারা তাদের কালের ভাষা, কালের রুচি, কালের আবেদন, কালের উচ্চারণ ও কালের সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করেন নি। বরং ধারন করেছেন।
হজরত শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. কে দেখুন। তিনি তার সময়ের সাধারণ মানুষকে নিয়ে কাজ করেছেন। ফলে তার ভাষা ও ভঙ্গি যেমন, নুর মোহাম্মদ আজমী রহ. এর ভাষা ও ভঙ্গি তেমন না। আর মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীকে দেখি তিনি আরেকটু উপরে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন।
আজ যারা বাংলাদেশে লিখছেন। উলামায়ে কেরামের মধ্যে চল্লিশোর্ধ্ব যারা লিখছেন তারা তাদের উত্তরাধিকারটা রূপান্তরিত করে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে কোনো অবহেলা করেছেন বলে আমি মনে করি না।
আমরা যদি তাদের লেখা বইগুলো দশক ভিত্তিতে সাজিয়ে দেখি তবে তাদের ভাষা, রুচি, চিন্তা ও অলঙ্কারের স্পষ্ট একটি পরিবর্তন দেখবো। বিশ্বাস, সময়, ধর্ম, দেশ, সভ্যতা যেগুলো ধারন করে সাহিত্যটা দাঁড়ায় সেগুলোকে যথাযথভাবে আমরা ধারন করে এসেছি এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমাদের পতাকা তুলে দেয়ার পথে আছি।
এ ক্ষেত্রে আবারও বলবো, আমাদের কর্মী ও সামর্থ্য স্মরণ রেখে কাজকে মূল্যায়ন করতে হবে।
আওয়ার ইসলাম : আপনার কথায় একটি বৈপরিত্য দেখা দিলো। শুরুতে আপনি বলেছিলেন, এক সময় সাহিত্যচর্চা নিষিদ্ধ ছিলো। এখন বলছেন, যথাযথভাবে পূর্বসূরীরা উত্তরাধিকার পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়েছেন। নিষিদ্ধ পরিবেশে তা কিভাবে সম্ভব হলো?
মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : আমি পূর্বে যে নিষিদ্ধের কথা বলেছি সেটা ছিলো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধ বাইরেও যুগে যুগে বহু মানুষ কাজ করেছেন এবং সমাজ-সভ্যতায় অবদান রেখে গেছেন। মাদরাসার বাইরে সাহিত্যের আলাদা প্রতিষ্ঠান ছিলো। যেমন মাওলানা আকরাম করেছিলেন।
আওয়ার ইসলাম : এককথা যদি জানতে চাওয়া হয়, বর্তমানে সাহিত্যের বিষয় কি হওয়া উচিৎ। আপনি কি উত্তর দিবেন?
মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : উত্তর সম্ভবত আমার পূর্বের আলোচনায় চলে গেছে। দুটো দিক। এককি দিক হলো, জাতি হিসেবে আমাদরে চিন্তা। পৃথিবীর সকল জাতি ও দেশের ভাষায় ধর্মের একটি আলাদা জায়গা আছে। যদি এই জায়গা থেকে বলি তাহলে বলতে হবে, আমাদের মধ্যে এমন শক্তিশালী দল থাকতে হবে যারা ধর্মকেই সাহিত্যের বিষয় হিসেবে বেছে নিবে।
এর বাইরে যারা কাজ করবে সকলের একটি জায়গায় থাকতে হবে। তাহলো, ধর্ম-বিশ্বাস-সভ্যতা-সংস্কৃতি-দেশ-মানবতা এই যে বিষয়গুলো উপেক্ষা করে মানুষ সমাজে বাঁচতে পারে না, সেখানে সবাই দায়বদ্ধ থাকবে।
আওয়ার ইসলাম : পৃথিবীর প্রধান প্রধান ভাষাসমূহের ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখি সেখানে সাহিত্যের আশ্রয় ছিলো ধর্ম। যেমন, বাংলা, ইংরেজি, আরবি, ফার্সি প্রায় সব ভাষায়। আধুনিককালে সূচনাকাল পর্যন্ত সাহিত্যের ধর্মের প্রভাব চোখে পরার মতোই ছিলো। গত শতকের ত্রিশের দশকের পর সাহিত্য থেকে ধর্মকে ছেঁটে ফেলার প্রবণতা তৈরি হয়। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে যা প্রচণ্ড রকমে স্পর্ষ করছে।
মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : এ জায়গাটা খুব জটিল। কয়েকটি বিষয় সমাধান করে এখানে আসতে হবে। মানুষ ঠিক যেভাবে জীবনযাপন করে তারই ছবি সাহিত্যে আঁকা হয়। আমাদের সামাজিক জীবনেই তো আমরা প্রচণ্ড রকম বিশৃংখলার মধ্যে বাস করছি। সমাজকে শুদ্ধ না করে শুধু সাহিত্যকে শুদ্ধ করার খুব বেশি কিছু নেই। সে জায়গাতেই আমাদের যেতে হবে।
এতো বড় প্রসঙ্গ এখানে সমাধান করা কঠিন। ধরুন! বিশ্বব্যাপী ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের উত্থান নিয়ে কথা বললে ধর্মের বিষয়টাও আসে। সেখানে ধর্মের ব্যাপারে একটি সুনির্দিষ্ট মত আছে। কিন্তু আমাদের দেশের চতুর রাজনীতিকরা ধর্মের কথা উল্লেখ করে না। আবার ধর্মের বিরুদ্ধে যা যা করা দরকার তা করে।
তারা ধর্মের ব্যাপারে একটি ধোঁয়াশাও তৈরি করে। ধর্ম বলতে কি বোঝায় তা তারা স্পষ্ট করে না। ধর্ম দ্বারা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কোন ধর্ম উদ্দেশ্য তা তারা পরিস্কার করে না। মূল গোলোযোগ খ্রিস্ট ধর্ম ও গির্জার সঙ্গে। যে খ্রিস্ট ধর্ম সম্পূর্ণ নয় এবং যার প্রবর্তক সংসারি ছিলেন না (সেটা আল্লাহর ইচ্ছাতেই)। যখন সমাজে গির্জার শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখন অগ্রসরমান একটি সমাজের সঙ্গে গির্জার সংঘাত হয়েছে।
আমাদের অধ্যাপকরা আমাদেরকে ঘোল খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। তারা খ্রিস্ট ধর্মের সঙ্গে সমাজের সংঘাতকে সাধারণভাবে ধর্মের সঙ্গে সমাজের সংঘাত হিসেবে উপস্থাপন করেন। ইসলাম ও মসজিদের সঙ্গে আধুনিক সমাজের কোনো সংঘাত হতে পারে না।
এ জায়গাটা স্পষ্ট করতে না পারলে আধুনিক সমাজের পতন ঠেকানো যাবে না। আজ জায়গায় জায়গায় যে অস্পষ্টতা রেখে দেয়া হয়েছে তা ইচ্ছাকৃত। পুরো চিন্তাকে বস্তুতে আবর্তিত করার চেষ্টা হচ্ছে। ধোঁয়াশা ও ঘোল তৈরি করে তারা সমাজকে বিভ্রান্ত করছে।আমাদের তরুণরা সেই জালে পা দিয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছে।
এ সমস্যার সমাধা করতে হলে আমাদের প্রথমে দেখতে হবে এ সমস্যার শুরু কোথায় এবং এর কারণ কি। কেনো বিষয়গুলো স্পষ্ট করা হচ্ছে না। এ জায়গায় যেতে পারলে সমস্যার সমাধান হবে। আর সেখানে যাওয়ার জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে।