আমিনুল ইসলাম হুসাইনী: গহীন অরন্য। অরন্যজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে শত বছরের পুরনো বিশাল বিশাল বৃক্ষেরা। বৃক্ষ বল্লবের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে আছে তরমুজের মতো এক ফালি চাঁদ। অদূরেই কোথাও ডেকে ওঠছে দু’একটা খেক শিয়াল। ঘাসবনে আসর বসেছে নীল জোনাকিদের।
জাহিদ আনমনে হাতখানা বাড়াতেই কতোগুলো জোনাকি এসে বসে যায় জাহিদের হাতে। জাহিদ জোনাকিদের দিকে তাকিয়ে বলে- ‘সুবহানাল্লাহ! প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সেবার জন্য কতো কিছুই না সৃষ্টি করেছেন। কতো সুন্দর করে সাজিয়েছেন এই অবাক পৃথিবীকে।
সত্যিই জাহিদ ভাই, সৃষ্টিকর্তা আমাদের জন্য এই পৃথিবীটা অনেক সুন্দর করেই সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু কিছু মানুষরূপী অমানুষেরা সেই সৌন্দর্যকে বিনষ্ট করতে আজ মরিয়া হয়ে ওঠেছে।
জাহিদের কথার পরিপ্রেক্ষিতে কথাটা না বলে থাকতে পারলো না মুক্তিযোদ্ধা গৌরাঙ্গ ভট্টাচার্য। গৌরাঙ্গ জাহিদেরই সহযোদ্ধা। এমন সময় আরেক মুক্তিযোদ্ধা লুৎফুর রহমান এসে বলে-
‘কমা-ার সাহেব সবায়কে ডাকছেন’।
জাহিদ আর গৌরাঙ্গ ক্যাম্পে প্রবেশ করে। ক্যাম্প বলতে গোলপাতার ছাউয়া একচালা একটি ঘর। মাওলানা রাশেদই এই ক্যাম্পের কমান্ডার। শেখ বাড়ির অপারেশনের যাবতীয় তথ্য নিয়ে তিনি এইমাত্র ক্যাম্পে ফিরেছেন। আর ফিরেই সাথিদের নিয়ে গোল হয়ে বসে পড়লেন।
রাশেদ এবার চট্রগাম ‘জামিয়া আহলিয়া মঈনুল ইসলাম হাটহাজারি’ মাদরাসা হতে মাস্টার্স পাশ করেছেন। তিনি জানেন, দেশপ্রেম ঈমানেরই অংশ। তিনি শিখেছেন কীভাবে দেশকে ভালোবাসতে হয়। কীভাবে শত্রুদের হাত থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে হয়।
একটি লাল সবুজের পতাকার জন্য, একটি স্বাধীন মানচিত্রের জন্য, একটি স্বাধীন দেশের জন্য যারা প্রিয় মুখগুলোকে বিসর্জন দিয়ে হাত মিলিয়েছে রাশেদের হাতে, তারা হলো- হাসান, জাহিদ, গৌরাঙ্গ, কালাম, মনির, সামছুল, তাহের এবং রফিক।
গতকাল তারা পাঠানবাড়ি মিলিটারি ক্যাম্প থেকে দু’টি মেয়েকে উদ্ধার করেছে। তাদেরকেও ডাকা হয়েছে এই মিটিংয়ে। মেয়ে দু’টির নাম ফারিহা ও সুমাইয়া। কমা-ারের নির্দেশে সুমাইয়া মুখ খুলে-
অন্যান্যদিনের মতোই প্রকৃতির কোলে মাথা রেখে আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গল দরজায় কারোর বজ্র নিনাদে। বিছানা থেকে ওঠে বসলেন আমার বাবা আকমল মাষ্টার।
জিজ্ঞেস করলেন-
কে? কিন্তু কোনো জবাব এলো না। বাবা ভাবলেন, ‘মুক্তিবাহিনী’ বোধহয়। কেন না দু’দিন আগেও এভাবেই কড়া নেড়েছিল কুসুমপুরের মুক্তিবাহিনীরা। বাবা তাদেরকে ধানের গোলায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। এতে করে সেদিন বেঁচে গিয়েছিল চারটি তরুণ প্রাণ।
এভাবে আরো কতো যে মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নিয়েছেন এই মাস্টার বাড়িতে, তার কোনো ইয়াত্তা নেই। বাবার ভাবনার মোড় ঘুড়ে। তিনি ভাবতে থাকেন-
মুক্তিবাহিনী হলে তো এতক্ষণ মুখে কুলুপ এঁটে থাকতো না। তাহলে কি মিলিটিরি?
মিলিটিরির কথা ভাবতেই গা শিউরে উঠে বাবার। ওরা যে কতো নির্দয়, কতো নির্মম, তা কি আর কারো অজানা? দরজায় আবারও ঠক ঠক শব্দ হলো।
সেই সাথে এক বিচ্ছিরি খিস্তি-
‘আরে শালে, জলদি দরওয়াজা খোল দে।
একরাশ ভয় নিয়ে বাবা দরজা খুললেন। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই এক মিলিটিরি এসে বাবাকে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। মেজর মোস্তাক বাবাকে ধমকে জিজ্ঞেস করলো-
‘বোল, নাফিস কিধার’?
নীচু কণ্ঠে বাবা বললেন-
‘হাম নাহি জানতা।’
অমনি তারা বাবার মাথার চুল ধরে টেনে হিচড়ে উঠোনে নিয়ে যায়। উঠোনভরা মিলিটিরিরা একজনের পর একজন বাবার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালাতে থাকে। আর বলতে থাকে-
‘শালে সিপাহী কো মদদ কিয়া। উসকি ইনাম আজহি পায়ে গা। বোল নাফিস কিধার? মুক্তি কিধার’?
অসহ্য যন্ত্রণায় কোঁকাতে কোঁকাতে বাবা পূণরায় বললেন-
‘হাম নাহি জানতা।’ এদিকে চারজন হানাদার আমাদের চোখের সামনেই আমাদের মায়ের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। যদিও সে দৃশ্য দেখা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
কিন্তু তারপরও নিজেদের সম্ভ্রমের কথা ভেবে মুখে কাপড় গুজে দিছে দিয়েছিলাম। কিন্তু ক্ষান্ত হল না নির্দয় হায়েনাগুলো। ওরা আমাদের ছোট ভাইটাকে শূন্যে তুলে ছেড়ে দিল। এরপরও কি আর লুকিয়ে থাকা যায়? চিৎকার দিয়ে খাটের নীচ থেকে বের হয়ে এলাম আমরা দু’ বোন। আর তখনই ওরা আমাদের দু’বোনকে...
২৬ অক্টোবর। পূর্ব আকাশের সূর্য তখন পশ্চিম দিগন্তে অনেকটাই হেলে গেছে। ঝাঁকে ঝাঁকে বলাকা ফিরে যাচ্ছে নিজ নিজ নীড়ে। সূর্যের লাল রঙ ছড়িয়ে পরেছে সবুজের বুকে। এ যেন স্বাধীনতার পূর্বাভাস। রাশেদ তাঁর সহযোদ্ধাদেরকে নিয়ে পরামর্শ সভায় বসলেন।
হাসানের দিকে তাকিয়ে রাশেদ জানতে চাইলেন-
হাসান! তুমি কী কী খবর সংগ্রহ করেছো?
ওরা আজ রাতে কোম্পানীগঞ্জে আসবে হুজুর। থাকবে আনন্দপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই ছড়িয়ে পড়বে বিভিন্ন গ্রামে।
তাহলে আমাদের খুব তাড়াতাড়িই কিছু একটা করতে হবে। আর সেটা করতে হবে আজ রাতেই। সবায়কে লক্ষ্য করে মাওলানা রাশেদ কথাটা বললে লুৎফুর বিস্ময় প্রকাশ করে বলে- কিন্ত কিভাবে? ওরা তো সংখ্যায় অনেক।
সংখ্যার কথা চিন্তা করো না। আমরা সত্যপথের ওপর আছি। আর যারা সত্যের ওপর অটল থাকে, তাদের সাথে আল্লাহ থাকেন।
স্মরণ কর ঐতিহাসিক বদর-বিজয়ের ঘটনাকে। কীভাবে তিনশ’ মুজাহিদের হাতে পরাজয় বরণ করেছিল সহ¯্রাধিক কাফের। তোমরা কি ভুলে গেছ হযরত শামীল রহ.-এর জীবন-ইতিহাস? আহা! নিজের দেশকে রক্ষা করার জন্য তিনি জীবনকে মৃত্যুর হাতে আমানত রেখে প্রাণপণ লড়েছিলেন।
সে জন্যই তো তিনি রাশিয়ানদের থেকে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পেরেছিলেন। আমরাও যদি নিজের জীবন বাজি রেখে লড়ি, তবে ইনশা আল্লাহ আমরাও এ দেশকে রক্ষা করতে পারবো। পারবো এদেশের মানুষকে মুক্ত করতে। আল্লাহর ওপর পূর্ণূ ভরসা আর মনে সাহস রেখে লড়লে এদেশ স্বাধীন হবেই ইনশাআল্লাহ।
কোম্পানীগঞ্জের কাঠের ব্রীজের মাঝখানে রশি দিয়ে দুটি গ্রেনেড বেঁধে রাখে মাওলানা রাশেদের গেরিলা বাহিনী। তারপর রশিটির সাথে আরো অনেকগুলো রশি জোড়া দিয়ে অনেক লম্বা করে নিল। রশির একটি মাথা এপারে এনে ঝুলিয়ে রাখে। রাত নামতেই মাওলানা রাশেদ তার বাহিনী নিয়ে গাছ-গাছালির আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।
ঝোপের ভেতর থেকে একদৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে মুক্তিযোদ্ধাদের সবায়। ঝিঁ ঝিঁ পোকাগুলো যেন আগাম বিজয়ী গীত গাওয়া শুরু করেছে। রাত তখন তিনটা পনের হবে। পাকিস্তানিদের গাড়ীর হেড লাইটের আলো পড়ছে কাঁচা সড়কে। সে আলো অগ্রসর হচ্ছে দ্রুত গতীতে। মাওলানা রাশেদ রশির এক মাথায় আগুন জ্বেলে দিলেন।
ধীরে ধীরে সে আগুন ব্রীজের মাঝখানে রাখা গ্রেনেডের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পাক বাহিনীর দুটো জীপ ইতোমধ্যে কাঠের ব্রীজে উঠে পড়েছে। হঠাৎ একটা বিকট শব্দ হল। কিছুক্ষণ পর আরেকটা শব্দ। তার মানে মাওলানা রাশেদের বাহিনী সফল।
‘জয় বাংলা, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ শ্লোগানে কেঁপে উঠল হানাদারদের আত্মা। অল্পক্ষণের মধ্যেই তিনটি মিলিটিরি জিপসহ ধসে পড়ল কাঠের ব্রীজটা। তবে ব্রীজ ধ্বংসের আগেই একটা জিপ পার হয়ে গিয়েছিল। জিপটি ব্রীজ অতিক্রম করতেই ঝোপের ভেতর থেকে গর্জে ওঠলো মুক্তিযোদ্ধাদের এল এম জি, এবং এস এল আর গুলো।
হানাদার বাহিনীরাও কিছুক্ষণের মধ্যে যুদ্ধের পুরো প্রস্তুতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তি বাহিনীর ওপর। দু’দলের ঠা ঠা গর্জনে কেঁপে উঠে রাতের প্রকৃতি। শান্ত বৃক্ষপল্লব। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চললো ভোর হওয়ার আগ পর্যন্ত। যুদ্ধ শেষে নিথর হয়ে মাটিতে পড়ে থাকে আঠারজন হানাদারের মৃতদেহ।
এদিকে মুক্তিবাহিনীতে রাশেদকে নিয়ে কান্নার রোল পরে গেছে। হানাদারদের অনেকগুলো গুলী মাওলানা রাশেদের বুকটা জার্জরা করে দিয়েছে। রাত গড়িয়ে সুবহে সাদেক শুরু হয়েছে। রাশেদ সুবহে সাদেকের নূরানী বাতাসে চোখ মেলে তাকান। ডানহাতে বুকের তাজা রক্ত মেখে গোমতী নদীর পানিতে মিশিয়ে দেন।
আর বলেন-
হে বাংলার নদী! হে বাংলার আকাশ! বাংলার বৃক্ষ-পল্লব আর পাখ পাখালিরা! তোমরা আজ স্বাক্ষী থেকো। দেশ মাতৃকার জন্য এই অধম জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত লড়েছি। জীবনকে স্বাধীনতার জন্য বিলিয়ে দিচ্ছি। তোমা স্বাক্ষী থেকো, যেন শেষ বিচারের দিন আমি শহীদের মর্যাদা পাই।
হে মহান আল্লাহ! তুমি আমার এই জীবনকে কবুল করো। শাহাদাতের অলঙ্কারে অলঙ্কিৃত করো। আয় আল্লাহ! তুমি বাংলাদেশকে স্বাধীন করো। তার পর কালিমায়ে তাইয়্যিবা পড়তে পড়তে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন একাত্তরের এই আলেম মুক্তিযোদ্ধা।
এইচজে