পলাশ রহমান
ইতালি থেকে
চরমোনাইর বার্ষিক মাহফিল (ফালগুন) সদ্য শেষ হয়েছে। প্রতি বছরের মতো এবারও ব্যাপক মানুষের সমাগম হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ নিয়ম করে ওয়াজ নসিয়ত শুনেছেন। জিকির আজকার করেছেন। খোদায়ি মদদ কুড়াতে চেষ্টা করেছেন।
মুজাহিদ কমিটির আমির মাওলানা, মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীম সকাল সন্ধ্যা বয়ানের মাধ্যমে মানুষকে দ্বীনের শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। আত্মশুদ্ধির কথা বলেছেন। বরাবরের মতো এবারও তিনি বেশ গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, আমাদের কোনো ভুল থাকলে ধরিয়ে দিন। আমরা সংশোধন হতে প্রস্তুত আছি।
আমি মনে করি সৈয়দ রেজাউল করীমের এই কথা অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। তারা যে এ কথা শুধু বলার জন্য বলেন না তার প্রমাণ হলো এর আগেও বহুবার তাদের মুখে অভিন্ন কথা শুনেছি। তার বাবা মরহুম সৈয়দ ফজলুল করীমও একই কথা বলতেন। সমালোচকদের তিনি কখনো কটাক্ষ করে, ব্যাঙ্গ করে কথা বলেননি। বরং বিনয়ের সাথে, উদারভাবে আহবান জানাতেন তার বা তাদের কোনো ভুল থাকলে ধরিয়ে দেয়ার জন্য।
ভুল সংশোধন করা, সমালোচনা মেনে নেয়া বা সহ্য করার সংস্কৃতি বাংলাদেশে নেই। কোনো রাজনীতিক বা ধর্মীয় নেতাকে আজ পর্যন্ত শুনিনি বিনা বাক্যে নিজের ভুল মেনে নিয়েছেন। সংশোধন হয়েছেন, চেষ্টা করেছেন বা অন্যদের আহবান করেছেন ভুল ধরিয়ে দেয়ার জন্য। এদিক থেকে চরমোনাইর তরিকা যে ব্যতিক্রম তা তারা বার বারই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
এ পর্যন্ত কেউ তাদের ভুল ধরিয়ে দেয়ার জন্য গিয়েছে কিনা আমি জানি না। তবে কাউকে অভিযোগ করতে শুনিনি যে ভুল ধরিয়ে দেয়ার পরেও তারা তা সংশোধন হননি। এর অর্থ ধরে নেয়া যেতে পারে তারা তাদের অনিচ্ছাকৃত ভুল সংশোধনের যে কথা বলেন তা শুধু কথার কথা নয়। বরং তাদের কথার মধ্যে আন্তরিকতা আছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো পীর সাহেবরা যতোটা উদার তাদের মুরিদ বা কর্মীবাহিনী কী ততটা উদার হতে পেরেছেন? তারা কি পীর সাহেবের মতো এভাবে প্রতিপক্ষকে নরম সুরে বলতে পারেন?
আমি মনে করি এক্ষেত্রে কিছুটা ঘাটতি রয়ে গেছে। মুরিদ বা কর্মীদের বড় একটা অংশ পীর সাহেবদের বা দলের সমালোচনা কোনোভাবেই বরদাস্ত করতে পারেন না। তাদের আচারণে মনে হয়- তারা পীর সাহেবদের ভুলের উর্ধে কেউ মনে করেন। আর এ কারণেই তারা যত্রতত্র বিবাদে জাড়িয়ে পড়েন। যাকে তাকে অসম্মান করে কথা বলেন। পীরের বা তরিকার সামান্যতম সমালোচনাতেও তারা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন।
চরমোনাইর মাহফিল, সেখানের ওয়াজ নসিয়তসহ গোটা আয়োজনটা মূলত মানুষের আত্মশুদ্ধির জন্য। সেখানে মানুষকে আত্মশুদ্ধি শেখানো হয়। আত্মশুদ্ধির প্রথম শর্ত হলো আত্মসমালোচনা। আর আত্মসমালোচনার জন্য নিজেকে চিনতে হয়। নিজের আত্মার সাথে পরিচয় থাকতে হয়।
আত্মসমালোচনা ছাড়া যেমন আত্মশুদ্ধি হয় না, তেমনি আত্মপরিচয় ছাড়া আত্মসমালোচনা হয় না।
আত্মপরিচয়ের জন্য মানুষের কমেন্ট জানতে হয়, শুনতে হয়। অন্যের দৃষ্ট থেকে নিজেকে মূল্যায়ন করতে শিখতে হয়। এখানে ছোট বড়, ধনী গরিব মূখ্য কোনো বিষয় নয়। প্রধান বিষয় হলো আত্মপরিচয় জানার চেষ্টা করা।
লেখক: প্রডিউসার, রেডিও বেইস ইতালি
চরমোনাই মাহফিল ও আমার অভিজ্ঞতা