মূল : শহিদুল্লাহ ফজলুল বারী রহ.
অনুবাদ : ওবাইদুল্লাহ ওবাইদ
কল্পকথার উপর বিশ্বাস; ইবাদত ও আকিদাগত বিষয়ে ধর্মীয় বিধিবিধানকে পরিহার করাটা মানুষকে সরল, সত্য ও সঠিক পথ থেকে টেনে ভ্রষ্টতা ও বিচ্যুতির দিকে নিয়ে যায়। তাদের ভ্রান্ত মতবাদ ও কুসংস্কারের স্রোতধারায় নিক্ষেপ করা হয় এবং কখনও কখনও তা তাদের শিরিক ও ধর্মদ্রোহিতার দিকেও টেনে নিয়ে যায়।
বিগত শতাব্দিতে যারা ইমানের বিচ্যুতি ও মতবাদের ভ্রষ্টতায় আক্রান্ত হয়েছে তারা কল্পকথা ও ধারণার উপর বিশ্বাসস্থাপন এবং ধর্মীয় বাণী ও সোনালি যুগের অনুকরণীয় ব্যক্তিদের কর্মজীবন থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণেই আক্রান্ত হয়েছে।
এসব উদাসীন লোক তাদের সম্মানিত নবী সা. -এর উপদেশ ভুলে গেছে যিনি বলে গেছেন, আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। তোমাদের কেউ কখনও পথভ্রষ্ট করতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা তা ধরে রাখবে। প্রথমটা হচ্ছে কুরআন। দ্বিতীয়টা হচ্ছে সুন্নাতে রাসুল সা. তথা হাদিস।
তিক্ত বাস্তবতা, যেটা আমি ও পুরো মুসলিম উম্মাহ অনুভব করছে- তা হচ্ছে প্রত্যেক যুগে মানুষদের একটা দল আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যাচার করে যায় এবং তার কিতাবকে বিকৃত করে। দৃঢ়তার সাথে রাসুলের উপর মিথ্যাচরণ করে। ধর্মের মাঝে এমন একটি নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটায় যা আল্লাহ তায়ালা অবতীর্ণ করেননি এবং নবী মুুহাম্মদ সা. এর উপর চলেননি। এমনকি সাহাবায়ে কেরামও রা. এমন কাজ করে যাননি।
তারা মনে করে, একটি ভালো ও সুন্দর জিনিস সৃষ্টি করেছে। অথচ শয়তান তাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে ফিরিয়ে রেখেছে এবং তার ভণ্ডামিপূর্ণ কাজকে সুন্দর করে সাজিয়ে তুলেছে। তারা নিজেরাও ভ্রষ্ট হয়েছে এবং আল্লাহর সৃষ্টিজগত থেকে অনেক আল্লাহর বান্দাকেও পথভ্রষ্ট করেছে।
আমাদের দেশেও এদের সন্ধান পাওয়া যায়, যেভাবে অন্যান্য মুসলিম দেশে পাওয়া যায়। মানুষের একটা দল দাবি করে— তারা রাসুল সা. কে চূড়ান্ত পর্যায়ের ভালোবাসে। তাদের বর্ণনা মতে তারা ‘রাসুলকে অসীম মর্যাদা ও সম্মান দিয়ে থাকে’।
রাসুল সা. কে তারা এতই সম্মান করে যে, কখনও কখনও রাসুলকে আল্লাহর স্থান থেকেও উপরে উঠিয়ে ফেলে। আল্লাহকে যতটুকু সম্মান করে তারচেয়েও বেশি সম্মান করে রাসুল সা. কে। তারা মনে করে এটাই আসল ইমান। এটাই বাস্তব দীন-ধর্ম, মূল শরিয়ত।
এ দলটা আশ্চর্যরকমের একটা অনুষ্ঠান পালন করে। সেখানে তারা আরও আশ্চর্যধরনের কিছু স্লোগান বলে। ধর্মের নামে, নবীপ্রেমের নামে, শরিয়তের নামে, তাদের ভুল মতবাদ ও চিন্তাচেতনাকে আঁকড়ে ধরে রাখে। খুব কম মানুষই আছে যারা তাদের মাজারপন্থী ও কুসংস্কারবাদি বলে। কেননা তারা মাজারকেই তাদের আসল ঠিকানা বানিয়ে নিয়েছে।
(মাজার হচ্ছে সাধুপুরুষের সমাধিক্ষেত্র। তবে বর্তমানে মাজারগুলো নেককারদের সমাধি হওয়াটা খুবই কঠিন। বেশির ভাগই পদচ্যুত লোকদের এবং তাদের বানানো; বিশিষ্টজনদের এটাই মত। এ দলটার প্রায় সব কর্মকাণ্ড মাজার কেন্দ্রিক হওয়াতে মানুষ তাদেরকে মাজারপন্থী বলে।)
সেখান থেকে তারা সাহায্য সহযোগিতা প্রার্থনা করে। তারাই হচ্ছে বিদয়াতি সম্প্রদায়। তারা রাসুল সা. এর ব্যাপারে এমন কিছু বিশ্বাস পোষণ করে যা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বিশ্বাসের পরিপন্থী। তা সত্ত্বেও তারা তাদের খেলখুশি মতে নিজেদের নাম 'সুন্নি' বা 'আহলুস সুন্নাহ' বলে দাবি করে।
রবিউল আওয়াল মাসে তাদের বাস্তব কার্যকলাপ দেখা যায়। বিশেষ করে এ মাসের বারো তারিখে। তারা এ তারিখটাকে রাসুলের জন্মদিন বলে থাকে। তাই তারা এদিনকে অত্যন্ত মর্যাদা ও হকপন্থীদের সাথে জেদ ধরে অনুষ্ঠান করে পালন করে।
পবিত্র লাইলাতুল কদর, রমজান মাস ও দুই ঈদ থেকেও এ দিবসকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে সীমালঙ্ঘন করে। এদিনে তারা খুব হইচই করে। যে সকল হক্কানি ওলামায়ে কেরাম তাদের কুসংস্কার ও রবিউল আওয়াল মাসকে ঘিরে যে সব ভ্রান্ত মতবাদের চর্চা হয় তার বিরুদ্ধাচারণ করে, স্বঘোষিত সুন্নিরা তাঁদের বিরুদ্ধ জোরাল ভাষায় মন্দ কথা বলে।
কুসংস্কারবাদি ও মাজারপন্থীরা আরও দুঃসাহস দেখায় যে, তারা ঈদে মিলাদুন্নবীকে কেন্দ্র করে তাদের ভ্রান্ত মতবাদ চিন্তাচেতনা পত্রপত্রিকায় পর্যন্ত প্রকাশ করে। কিছু কিছু পত্রিকা তাদের এ সংবাদ গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করে। যদিও অন্য সময়ে ইসলামি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ নিবন্ধ যা বিধিবিধান সম্বলিত ও দলিল প্রমাণসহ লেখা হয়, যেখানে সুচিন্তার প্রতিফলন হয়, এমন লেখা তারা কখনও প্রকাশ করে না।
তথাকথিত সুন্নিদের একজন ব্যক্তির নাম মাহবুবে খোদা দেওয়ানবাগী। সে তার প্রবন্ধে লিখেছে— ‘যারা রাসুলের নিকটবর্তী হয়েছে, তাঁর চরিত্রে চরিত্রবান হয়েছে, অন্তরকে মুহাম্মদি নুরে আলোকিত করেছে এবং তাঁকে এ পরিমাণ ভালোবাসে যে, তার জাতের মাঝে বিলিন হয়ে স্বয়ং মুহাম্মদ হয়ে গেছে, এমন ব্যক্তির নামের পরে 'আলাইহিস সালাতু আসসালাম' বলা প্রয়োজন হয়ে গেছে। যেন তারা বনী ইসরাইলের নবীদের মত।’
তার একথাটাতেই 'ত্রিত্ববাদ ও তিনের সমন্বিত এ খোদা’ প্রমাণ হয়। কারণ ওই লোকটি তার প্রবন্ধে মুসলমানদের নাসারাদের সাথে উপমা দিয়ে আহ্বান করে বলে— ‘আমরা টেলিভেশন ও পত্রপত্রিকা থেকে জেনেছি পৃথিবীর চতুর্দিকে খ্রিস্টানরা কত আগ্রহ, উৎসাহ ও নিষ্ঠার সাথে তাদের যিশুুর (ইসা আ.) জন্মের আনন্দ আনুষ্ঠানিকতার সাথে উদযাপন করে। তাহলে কি মুসলমানদের জন্য যথাযোগ্য হবে না তাদের ওই সম্মানিত রাসুলের জন্মদিনের আনন্দ উদযাপন করা, যার উম্মত হওয়ার জন্য যিশু (ইসা আ.) আল্লাহ কাছে দোয়া করেছেন?"।
অথচ এ ব্যক্তি আল্লাহর রাসুল সা. এর এ হাদিসটা ভুলে গেছেন, যেখানে নবী সা. বলেন, যে যে-গোত্রের সাথে মিল রাখবে সে ওই গোত্র থেকেই গণ্য হবে।
তাদের দলের আরেকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি তার প্রবন্ধে লেখেন, যেটা আল মুজাদ্দিদ পত্রিকায় ২৯/৭/১৯৯৬ খ্রি. তারিখে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে তিনি বলেন, "আল্লাহ তায়ালা নিজেই ফেরেশতাদের মাঝে তার প্রিয় রাসুলের সা. গুণাগুণ বর্ণনা করতে জন্মানুষ্ঠান পালন করেছেন। নিশ্চয় মিলাদ-কেয়াম ও ঈদে মিলাদুন্নবী আল্লাহ, ফেরেশতা, নবী ও সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম রা. এর আদর্শ। আর সমস্ত উলামায়ে কেরাম এ কথার উপর একমত হয়েছেন যে রাসুলের জন্মানুষ্ঠান পালন করা বিদআতে হাসানাহ ও মুস্তাহাব বিষয় (উত্তম কাজ)।"
তাদের আরেক ব্যক্তি যাকে সুফী আব্দুল হামিদ। তিনি ২৮/৭/১৯৯৬ সনে বাংলা দৈনিক 'দিনকাল' -এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলেন, "আল্লাহর রাসুল (স.) তার রবের প্রেমে ডুবে গেছেন এবং প্রেমের এমন উচ্চস্থানে পৌঁছে গেছেন, যেখানে আল্লাহ ও নবীর মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।"
নাউজুবিল্লাহ! এ মূর্খ আমাদের এ কথাটাই বলতে চাচ্ছে যে আল্লাহ ও মুহাম্মদ একই জিনিস। তাদের মাঝে কোনো ভিন্নতা নেই। আল্লাহই মুহাম্মদ। মুহাম্মদই আল্লাহ। নাউজুবিল্লাহ! (এটাই ত্রিত্ববাদ ও তিনের সমন্বিত এক খোদার ডিজিটাল ভার্সন।)
আরও আশ্চর্যের বিষয় যে এ ভ্রান্ত দলের কিছু ব্যক্তি তাদের নষ্ট আকিদা বিশ্বাস, ত্রিত্ববাদ ও তিনের সমন্বিত এক খোদার মতবাদ প্রমাণের জন্য কুরআনের আয়াতকে বিকৃতি করে। তারা আয়াতের খণ্ডিত অংশ এনে বলে, আল্লাহ বলেছেন, ‘যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি করতে চায়। প্রকৃতপক্ষে এরাই সত্য প্রত্যাখ্যানকারী। (আন নিসা, ১৫০-১৫১)
এই মিথ্যাবাদী পাপিষ্ঠের উপর আল্লাহর অভিশাপ যে সামান্য মূল্যের বিনিময়ে সামান্য স্বার্থরক্ষার জন্য কুরআনকে বিকৃত করে। যে আয়াত সে বিকৃতি করেছে এবং আয়াতের যে খণ্ডিত অংশ দিয়ে তার ভ্রান্ত মতবাদ প্রমাণের চেষ্টা করেছে তার পুরোটা হচ্ছে, ‘যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী তদুপরি আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি বিশ্বাসে তারতম্য করতে চায় আর বলে যে— "আমরা কতককে বিশ্বাস করি কিন্তু কতককে প্রত্যাখ্যান করি" এবং এরই মধ্যবর্তী কোনো পথ অবলম্বন করতে চায়। (আন নিসা, ১৫০)
প্রকৃতপক্ষে এরাই সত্য প্রত্যাখ্যানকারী। আর যারা সত্য প্রত্যাখ্যানকারী তাদের জন্য তৈরি করে রেখেছি অপমানজনক আজাব। (আন নিসা, ১৫১)
আয়াত বিকৃতিকারী লোকগুলো আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মাঝে রাসুলের জন্মানুষ্ঠান পালনের উপর এতই গুরুত্বারোপ করে আলোচনা করে যা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার গুরুত্বকেও হার মানায়। কুসংস্কার ও বিদআতের প্রলয়ঙ্করী স্রোতের সামনে আল্লাহওয়ালা ওলামাদের হাতগুটিয়ে বসে থাকা এবং তাদের সাথে সম্মান রক্ষা করে চলাটা, ইমানের চাহিদা ও জ্ঞানবন্ত কাজ হবে না।
এখন আবশ্যক হলো জ্ঞান ও বিচক্ষণতার সাথে বিষয়টা গুরুত্বের সাথে নেওয়া এবং দলিল ও অকাট্য প্রমাণের মাধ্যমে তাদের ভ্রান্ত মতবাদগুলোকে খণ্ডন করা। যতক্ষণ পর্যন্ত না খেজুর পাথর থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং সত্য আর মিথ্যা প্রকাশ পেয়ে যায়।
(আল ইহসান নভেম্বর ১৯৯৮ সংখ্যায় প্রকাশিত আরবি প্রবন্ধের অনুবাদ)