মাওলানা হাসান মুহাম্মদ জামিল
মুহতামিম, খতিব ও আলোচক
বেঁচে আছি রবের রহমতেই। এমন দুর্ঘটনায় কারো বেঁচে থাকার কথা নয়। অথচ শুধু বেঁচে নয় ভালোভাবেই বেঁচে আছি, আলহামদুলিল্লাহ।
দুর্ঘটনাস্থল, ময়মনসিংহ মহাসড়কে ত্রিশাল ভালুকার মাঝামাঝি। শেরপুর থেকে মাহফিল করে ফিরছিলাম, রাত তখন ৪.১৫।
গত কয়েকদিনের লম্বা সফরে আমার ড্রাইভার ক্লান্ত থাকায় সাথে নিয়েছিলাম পুরাতন ড্রাইভার জাভেদ ভাইকে। আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে বলে প্রস্তাব দেওয়ার সাথে সাথেই রাজি ‘জ্বি সার, আমার ডিউটি নাই, আমি যেতে পারবো ইনশাআল্লাহ।’
সে-ই ড্রাইভ করছিল। ওয়ানওয়ে রোড, গভীর রাতে রোডে গাড়িও কম, নাই বললেই চলে। তাই গতিতে গাড়ি চলাটাই স্বাভাবিক। সেভাবেই চলছে। সামনে ড্রাইভার জাভেদ, আর আমার ড্রাইভার মানসুর।
পেছনের বামপাশে আমি, ডানে শেরপুর থেকে জোড়ের উদ্দেশে আসা এক মাওলানা। গাড়ি চলছে আপন গতিতে। হঠাৎ দেখি বিপরীত দিক থেকে রংরোডে ট্রাক ধেয়ে আসছে, যেন আমাদের গাড়িকে উদ্দেশ্য করেই!
কিংকর্তব্যবিমুঢ় জাভেদ ভাই ডানে বামে করতে করতেই লেগে গেলো ট্রাকের সাথে। একটু বামে কাটতে পারায় সংঘর্ষটা হয়নি মুখোমুখি।
কিন্তু প্রচণ্ড আঘাত লাগে পাশের নিরাপত্তাপিলারের সাথে। পাঁচটি পিলার ভেঙ্গে রাস্তা থেকে প্রায় পচিশ ফিট নিচে
আঘাত খেতে খেতে গড়িয়ে পড়ে! কিছু বুঝার আগেই মুহূর্তের মধ্যে কি থেকে কি হয়ে গেল!
যখন গাড়ি স্থির হলো নিজের উপর থেকে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া সিটগুলো সরালাম। অনুভব করলাম নিচে পানি!
তার মানে গাড়িতে পানি ঢুকছে! ভাবতেই আঁতকে উঠলাম।
এর মধ্যেই সবার চিৎকার থামাতে চেষ্টা করলাম, বললাম স্থির থাকুন, বের হবার রাস্তা বের করুন। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বড় আশ্চর্য লাগছিল, এর মধ্যেও জাভেদ ভাই চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আল্লাহ আমার সারকে বাঁচান’! (এই মুহাব্বতের মূল্য রব তুমিই দিও)
প্রায় দশমিনিট কেটে গেলো এভাবেই। পাশের মাওলানা কীভাবে যেন বের হলেন!
আওয়াজ দিলেন, হুজুর আমি বের হয়েছি। আমি হাতড়ে খুঁজছিলাম দরজা। তখনো বুঝতে পারিনি গাড়ি চিত হয়ে আছে। খুঁজতে খুঁজতেই হাত পরলো দরজার লকে। অজানা আশঙ্কা কাজ করছিল, এমন পরিস্থিতে তো দরজা লক হয়ে যায়।
কিন্তু মা'বূদের রহমত যখন সঙ্গী হয় তখন পদে পদেই তা উপলব্ধি করা যায়; আল্লাহুম্মা লাকাল হামদ।
লক টানতেই দরজা খুলে গেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পুশ করে খুলতে পারছিলাম না। কাদার নিচে দেবে যাওয়ায় খোলা যাচ্ছে না। তাও সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে বাইরে থাকা মাওলানার সহায়তায় আমি বের হলাম।
ভেতর থেকে জাভেদ ভাইয়ের চিৎকার, আমার আশা ছেড়ে দেন!
প্রাণন্তকর চেষ্টায় মানসুরকে বের করলাম। ড্রাইভারের পাশের এবং পেছনের ডানপাশের দরজা লক হয়ে গেছে!
সিটবেল্ট বাঁধা থাকায় জাভেদ ভাই বের হতে পারছেন না। কীভাবে তার হাতও আটকে গেছে, নাক বরাবর পানি!
পানি আর দুই ইঞ্চি হলে এমনিই সে মারা যায়!
পকেটে হাত দিয়ে মোবাইল বের করে লাইট মারলাম, পানি খেয়ে মোবাইল বন্ধ হয় হয়। (পরে অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি)
মানসুর রিস্ক নিয়ে আবারো ভেতরে ঢুকে বেল্টমুক্ত করে জাভেদকে। পরে পা ধরে টেনে বের করি। কিন্তু গ্লাসের টুকরায় ক্ষতবিক্ষত হয় শরীর। বুকে পিঠে প্রচণ্ড চাপ। সবাই রাস্তায় উঠি। কেউ নেই। দূর থেকে দুজন দৌড়ে আসছেন। তারা রাস্তায় কিছু দেখতে না পেয়ে বিকট শব্দের কারণ তালাশে ব্যস্ত!
সবাই যখন প্রায় পচিশ ফিট উপর থেকে গাড়িটা দেখছিলাম, বিশ্বাস করতে পারছিলাম না-এই গাড়িতে আমরা ছিলাম!
রহমতের দোয়ারে সিজদায় লুটতে চেয়েছিলাম, অযু না থাকায় তা আর হয়নি।
একটা খালি পিকআপে ওদের উঠালাম, বুঝলাম তুলনামূলক আমিই ভাল আছি, লাকাল হামদু ইয়া হাফিজ।
দ্রুত ঢাকা ঢুকেই ওদের হসপিটালে পাঠালাম, সাথে গেল আমাদের মাদরাসার শিক্ষকরা।
কাঁদাপানিতে গড়াগড়ি খেয়ে সবার কাপড়ই নোংরা, পায়ে নেই জুতো। আমার অবস্থা আরো করুন, সাদা কাপড় বলে কথা। টেবটা আর পাইনি। পানিতে কোথায় পড়ে আছে আল্লাহ মা'লূম।
টেবের জন্য আফসোস নেই, সমস্যা হলো সব ডকুমেন্ট এর ভেতরেই। বিশেষ করে মোহাজিরদের খেদমতগুলোর ডকুমেন্ট।
যাক বেঁচে আছি রবের করুনায়, এতেই অনেক খুশি; আলহামদুলিল্লাহ।
সারাদিনের প্রচেষ্টায় কাল বিকেলে গাড়ি উপরে উঠানো গেছে। গাড়ির ছাদ নাই, আমার সাইডে প্রচণ্ড আঘাত। পিলার লেগেছিল বোধহয়! উফ ভাবতে পারছি না, আমি কীভাবে অক্ষত আছি বুঝতে পারছি না!
ইয়া রব, লাকাল হামদ।
গাড়ি দেখে নাকি কেউ বিশ্বাস করেনি যাত্রীরা কেউ বেঁচে আছে!
সবই রবের মহিমা, মা'বূদ সবাইকে তুমি হেফাজত করো।
যারা উৎকণ্ঠায় ছিলেন, অথবা অস্থিরচিত্তে ছুটে এসেছেন, অথবা দূর থেকে দোয়া করেছেন সবাইকে - জাযাকুমুল্লাহু খাইরা।
শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা থাকলেও আমি বেঁচে আছি, সুস্থ আছি, ভালো আছি; আলহামদুলিল্লাহ।
নবীজিকে কতটা ভালোবাসেন? লিখুন, জানবে বিশ্ব