মুহাম্মাদ মিনহাজ উদ্দিন
ভেনিজুয়েলা (venezuela) দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের উত্তর উপকূলে ক্যারিবীয় সাগরের তীরে অবস্থিত ফেডারেল প্রজাতন্ত্র শাসিত একটি রাষ্ট্র। ভেনিজুয়েলা মোট ২১টি রাজ্য নিয়ে গঠিত।
দেশের সরকারি ভাষা স্প্যানিশ। তবে ইংলিশ, ফরাসি ও পর্তুগিজ ভাষারও প্রচলন রয়েছে। ভেনিজুয়েলার রাজধানী এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহত্তম শহরের নাম কারাকাস।
সরকারি হিসাব মতে, জনসংখ্যা প্রায় ৩০ মিলিয়ন। মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় দশ লাখের মতো। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভেনিজুয়েলাবাসী ইউরোপীয় ও প্রাচীন আমেরিকান আদিবাসী বংশোদ্ভূত জাতি।
ভেনিজুয়েলার উত্তর প্রান্তে রয়েছে আন্দিস পর্বতমালার সুউচ্চ পর্বতাঞ্চল। এগুলো উত্তরাঞ্চল ছাড়িয়ে দক্ষিণের ক্রান্তীয় অরণ্য পর্যন্ত বিস্তৃত। দেশের মধ্যভাগে আছে তৃণময় সমভূমি ও রুক্ষ উচ্চভূমি।
উপকূলজুড়ে রয়েছে নয়নাভিরাম বেলাভূমি। তীর থেকে অদূরের অনেক দ্বীপ ভেনিজুয়েলার সীমানার অন্তর্গত।
৩০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভেনিজুয়েলা একটি স্পেনীয় উপনিবেশ ছিল।
১৯ শতকের শুরুর দিকে দক্ষিণ আমেরিকার যেসব দেশ স্পেনীয় উপনিবেশ থেকে প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করে, সেগুলোর মধ্যে ভেনিজুয়েলা অন্যতম।
স্বাধীনতা লাভের পর ভেনিজুয়েলা দেশীয় অন্তর্সংঘাত ও স্বৈরশাসনের নানা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করেছে। ভেনিজুয়েলার রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর শক্তিশালী প্রভাব-প্রতিপত্তি রয়েছে।
আগে ভেনিজুয়েলা একটি কৃষিপ্রধান দেশ ছিল; কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পেট্রোলিয়ামের বিশাল মজুদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর অর্থনীতির গতিপথ পাল্টে যায়। তেলশিল্প প্রচুর সম্পদের সৃষ্টি করা সত্ত্বেও ভেনিজুয়েলায় ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে রয়েছে সুস্পষ্ট বিভাজন।
ব্যবসায়ী, তেল কম্পানির কারিগর ও জমিদাররাই দেশের বেশির ভাগ সম্পদের মালিক। অন্যদিকে শহরের অদক্ষ শ্রমিক ও গ্রামের খামারকর্মীরা তুলনামূলকভাবে দরিদ্রাবস্থায় জীবন যাপন করে থাকে।
ভেনিজুয়েলায় ইসলামের আগমন
বেশির ভাগ দক্ষিণ আমেরিকা ও মধ্য আমেরিকান দেশগুলোতে ইসলাম যেভাবে আগমন করে, ভেনিজুয়েলায়ও ঠিক তেমনি পনেরো শতকের শেষের দিকে ইসলাম আগমন করে; বিশেষত নতুন পৃথিবী আবিষ্কারের লক্ষ্যে যেসব স্প্যানিশ পরিব্রাজক ভ্রমণে বের হয়েছিলেন, তাঁদের দলের মুসলিম সদস্যের মাধ্যমে এতদঞ্চলে ইসলাম আগমন করে।
ভেনিজুয়েলা আবিষ্কারের পর স্প্যানিশরা আফ্রিকা মহাদেশ থেকে হাজার হাজার মুসলিম ক্রীতদাসকে নিয়ে আসে। ফলে ভেনিজুয়েলায় মুসলিমদের একটা বড় জনসংখ্যা তৈরি হয়।
পরিতাপের বিষয় হলো, মুসলমানদের ওপর স্পেনীয় উপনিবেশবাদীদের সীমাহীন অত্যাচার-নিপীড়ন ও গণহত্যাযজ্ঞ আর জোরপূর্বক খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিতকরণের ফলে একপর্যায়ে ভেনিজুয়েলা প্রায় মুসলমানশূন্য হওয়ার জোগাড় হয়েছিল।
কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ভেনিজুয়েলা স্পেনীয় উপনিবেশ থেকে মুক্তি পায়। পরবর্তী সময়ে বিংশ শতাব্দীতে সিরিয়া, লেবানন ও ফিলিস্তিন থেকে ক্রমাগত আরবদের আগমন অব্যাহত থাকে। কার্যত তাদের এ আগমনই ছিল ভেনিজুয়েলায় আবার ইসলামের জাগরণের চালিকাশক্তি।
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে আরবরা যখন এখানে আসে, তখন তারা ছিল অতি দরিদ্র সাধারণ ব্যবসায়ী।
তবে সময়ের আবর্তনে নিজেদের প্রতিভা-যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা ও কুশলতার মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য, ডাক্তারি ও অন্যান্য পেশার দ্বারা নতুন ভেনিজুয়েলা নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
তাদের এ অবদান-ভূমিকা সত্তর ও আশির দশকে ভেনিজুয়েলার বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিম কমিউনিটির প্রতিষ্ঠা লাভের ক্ষেত্রে ব্যাপক সাহায্য করেছে। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই ভেনিজুয়েলার বেশ কয়েকটি শহরে মুসলমানদের জন্য ছোট ছোট নামাজঘর তৈরি হয়ে যায়।
অবশ্য কয়েক বছর আগে নতুন মসজিদ তৈরির পাশাপাশি আগের সে নামাজঘরগুলো পর্যাপ্ত সম্প্রসারণ করে বড় মসজিদ তৈরি করা হয়েছে। আবার কিছু কিছু মসজিদের আওতাধীন কমপ্লেক্সে ইসলামিক স্কুল ও কবরস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মুসলমানরা ভেনিজুয়েলার বিভিন্ন শহরে আবাসন গড়ে তুলেছেন। রাজধানী কারাকাস ও গুরুত্বপূর্ণ শহর ভ্যালেন্সিয়া, পুনঞ্জো, মার্গারিটা এবং বারকুইসিমেটো ও অন্যান্য শহরে মুসলমানরা বিস্তৃতি লাভ করেছে।
তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান বাস করে রাজধানী কারাকাসে। ভেনিজুয়েলায় সুন্নি মুসলিম সম্প্রদায়ের ১৫টি ইসলামিক সেন্টার রয়েছে।
রাজধানী কারাকাসে অবস্থিত ‘শেখ ইব্রাহিম বিন আবদুল আজিজ আল-ইবরাহিম মসজিদ’ (মসজিদে ইবরাহিমি) লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বিখ্যাত ইসলামী নিদর্শনাবলির অন্যতম।
এ মসজিদেই রয়েছে লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে উঁচু মিনার। অনুরূপ মসজিদ কমপ্লেক্সটির ভেতরে বেশ কয়েকটি বৃহৎ শ্রেণিকক্ষসমৃদ্ধ একটি ইসলামী স্কুল, প্রশাসনিক ভবন ও শরীরচর্চার জন্য একটি জিমনেসিয়ামও রয়েছে।
মার্গারিটা শহরে বিশালকায় সুদর্শন একটি মসজিদ রয়েছে। মসজিদ কমপ্লেক্সটির আওতাধীন ভেনিজুয়েলার সর্ববৃহৎ মাদরাসা ও সর্ববৃহৎ কবরস্থান রয়েছে। কমপ্লেক্সটি ৩০ হাজার বর্গমিটারের বেশি জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে। কয়েক মাস আগে মাদরাসাটি উদ্বোধন করা হয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ শহর ভ্যালেন্সিয়ায় একটি বড় মসজিদ, একটি মাদরাসা ও একটি কবরস্থান রয়েছে। এ শহরে ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মুসলমানরা বসবাস করেন। ভেনিজুয়েলার অন্যান্য শহরেও মসজিদ, নামাজঘর এবং কিছু ইসলামী স্কুল বা মাদরাসা রয়েছে।
ভেনিজুয়েলায় দাওয়াতি কার্যক্রম
কিছু ইসলামী সংগঠনের দাওয়াতি তৎপরতার কারণে ভেনিজুয়েলার মুসলমানরা কয়েক বছর আগে সেখানে বড় একটি ইসলামী দাওয়াতি জাগরণ দেখেছে।
ভেনিজুয়েলার নাগরিকদের কাছে সুন্দরভাবে ও বস্তুনিষ্ঠরূপে ইসলামের পরিচয় তুলে ধরতে ‘ভেনিজুয়েলা কমিউনিকেশন সেন্টার’ নামের একটি ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
ইসলামের প্রচার-প্রসার, দাওয়াত ও তাবলিগের কার্যক্রম বৃদ্ধির লক্ষ্যে সক্রিয়ভাবে এবং সরাসরি ফোকাসের ওপর ভিত্তি করে ‘ভেনিজুয়েলা কমিউনিকেশন সেন্টার’ মার্গারিটা শহরে অবস্থিত ‘ইসলামী সংঘ ভেনিজুয়েলা’র সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে।
বিভিন্ন দাওয়াতি কার্যক্রম
► প্রতিদিন ভেনিজুয়েলার বিভিন্ন শহরে স্প্যানিশ ভাষায় অনূদিত ইসলামবিষয়ক লিফলেট ও বইপত্র বিতরণ করা। মিসরের ‘অ্যাসোসিয়েশন অব ইসলামিক রিপোর্টিং’ বইগুলো আল-আজহার শরিফে যাচাই-বাছাই করার পর ভেনিজুয়েলায় পাঠিয়ে থাকে।
► অডিও-রেডিও ও স্থানীয় পত্রিকাগুলোর মাধ্যমে ইসলামের সৌন্দর্য-নিষ্ঠা, অনুপম সহনশীলতা এবং অভূতপূর্ব ন্যায়বিচার ব্যবস্থাপনা ও সাহায্য-সহযোগিতার দিকগুলো তুলে ধরা।
► নতুন মুসলমানদের জন্য ইসলামের মৌলিক শিক্ষাগুলো, আরবি ভাষা শিক্ষা ও ভেনিজুয়েলার সমাজে দাওয়াতি কাজ করার জন্য যোগ্য ও প্রস্তুত করার লক্ষ্যে ধারাবাহিক স্থায়ী কোর্সের ব্যবস্থা।
► ইসলামী শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সেমিনারের আয়োজন করে মুসলিম ও অমুসলিম সবাইকে তাতে অংশগ্রহণের প্রতি আহ্বান জানানো।
► মুসলিম শিশুদের জন্য ইসলামী শিষ্টাচার এবং আরবি শেখার জন্য গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে বিভিন্ন কোর্সের আয়োজন।
ভেনিজুয়েলায় ‘দাওয়াত ও তাবলিগে’র কার্যক্রম খুব সক্রিয়ভাবে প্রচলিত। দাওয়াত ও তাবলিগের সদস্য এবং অন্য সাধারণ মুসলমানদের চেষ্টা ও মেহনতের মাধ্যমে ভেনিজুয়েলার জনগণের কাছে, বিশেষত শিক্ষিত শ্রেণির কাছে বিগত কয়েক বছরে ইসলাম বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ফলে বিপুল পরিমাণ ভেনিজুয়েলিয়ান নাগরিক ইসলাম ধর্মের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে চলছে।
(কুয়েতের বিশ্বখ্যাত নিউজপোর্টাল ‘আল-মুজাতামা’য় ভেনিজুয়েলা কমিউনিকেশন সেন্টারের সভাপতি এবং ইসলামী সংঘ ভেনিজুয়েলার ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. আহমদ আবদুহুর প্রকাশিত একটি আরবি প্রবন্ধ অবলম্বনে রচিত। )