রোকন রাইয়ান
নির্বাহী সম্পাদক
গত ১৪ অক্টোবর জাগ্রত কবি মুহিব খানকে নিয়ে কবিকেন্দ্র আয়োজন করেছিল ‘জাগ্রত প্রহর’ নামের একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক বেশ কয়েকটি সংগঠন ছিল এ আয়োজনের নেপথ্যে।
অনুষ্ঠানের আগে আয়োজনটি নিয়ে কোনো সমালোচনা না হলেও শুরু হয়েছে অনুষ্ঠানের পরপর। সেদিন সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান উপভোগ করে রাতেই ফেসবুকে এ বিষয়ে বিরূপ মতামত দিতে থাকেন অনেকে।
অনুষ্ঠান উপভোগ করা অনেকের অভিযোগ জন্মদিন উপলক্ষে এরকম আয়োজন ঠিক হয়নি। অনুষ্ঠানটি অন্য কোনো দিনে করা যেত বলে তাদের মতামত।
এছাড়াও অনুষ্ঠানে কয়েকজন নারীকে দেখা গেছে। যারা মঞ্চে উঠেছিলেন এবং বক্তব্যও দিয়েছেন। সামনে দাঁড়িয়ে মুহিব খানের হাতে তুলে দিয়েছেন সম্মাননা ক্রেস্ট। সমালোচকরা এটাকে কোনোভাবেই মেনে নিচ্ছেন না।
তাদের বক্তব্য- ইসলামি ভাবধারার কবি হয়ে মুহিব খানকে সবার মতো হলে চলবে না। তার চর্চা ও ব্যক্তিত্বে ইসলামের আদেশ নিষেধাজ্ঞার পূর্ণ নিদর্শন থাকতে হবে।
তবে তাদের এসব বক্তব্যের পাল্টা জবাব ফেসবুকেই দিয়েছেন অনেকে। তারা বলেছেন, এ ধরনের সামগ্রিক কাজে সবার অংশগ্রহণ থাকতেই পারে। বিশেষ করে যে প্রোগ্রামটির আয়োজক ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী সেই প্রোগ্রামে এমন দৃশ্য থাকলে সমস্যা কোথায়? ইতোপূর্বে আলেমরা এমন ইস্যুতে নারীদের সঙ্গে বসেছেন আলোচনা করেছেন।
জাগ্রত প্রহর নিয়ে মুহিব খান অনুষ্ঠানের আগে আওয়ার ইসলামকে বলেছিলেন, সচরাচর আমরা যেমন প্রোগ্রাম করে থাকি সেগুলো থেকে এটি হবে সম্পূর্ণ আলাদা। এর আয়োজকও ভিন্ন। তাই অনেক কিছুই হয়তো আমাদের সঙ্গে মিলবে না।
তবে প্রোগ্রামটির আয়োজক ও আয়োজন ভিন্নমাত্রার বলা হলেও গতানুগতিক বিষয় আশয়ই লক্ষ করা গেছে এবং যথারীতি অডিয়েন্সে প্রাধান্য ছিল মাদরাসা শিক্ষার্থীর। প্রোগ্রামটি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ৪র্থ তলায় হওয়ার কথা থাকলেও অনুষ্ঠিত হয় বিল্ডিংয়ের ছাদে।
এ বিষয়ে প্রোগ্রামে উপস্থিত থাকা নবরবি শিল্পীগোষ্ঠীর পরিচালক ইউসুফ বিন নূর আওয়ার ইসলামকে বলেন, অনুষ্ঠানে আয়োজকদের নানারকম সমস্যা ছিল। প্রোগ্রাম যথাসময়ের অনেক পড়ে শুরু হয় এবং উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এই নিয়ে বেশ হট্টগোলও হয়েছে।
মাওলানা ইউসুফ বলেন, ছোট খাট কিছু মিসটেক ছাড়া পুরো অনুষ্ঠানটি ছিল আনন্দমুখর। শ্রোতাদের কাছে বেশ উপভোগ্য হয়েছে পুরো প্রোগ্রাম এবং বাইরের অতিথিগণ শ্রোতাদের উপস্থিত ও শেষ পর্যন্ত বসে থাকার ধৈর্য দেখে অবাক হয়েছেন।
তিনি বলেন, অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা কচিপাতা নামের একটি সাহিত্য পাতার সম্পাদক রেজওয়ানা বলেন, কবিতার প্রতি আপনাদের ধৈর্য ও ভালোবাসা দেখে সত্যিই অাশ্চর্য হয়েছি। বলতে দ্বিধা নেই আমরা আপনাদের কাছে হেরে গেছি।
কবি মুহিব খানকে বহিরাঙ্গনে জানার সুযোগ এরকম আয়োজন ছাড়া সম্ভব নয় বলে অনুষ্ঠানটি নিয়ে গর্ব করেন ইউসুফ। আর সমালোচকদের বাস্তব চিত্রটা বোঝার আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা সমালোচনা মনে হয় এখানেই শেষ হয়ে যেত, কিন্তু সমালোচনার পর ফেসবুকে মুহিব খানের পর পর কয়েকটি স্ট্যাটাস আলোচনার পরিধি বাড়িয়ে দিয়েছে। অনুষ্ঠান ছাড়িয়ে তার কবিতার বিচার বিশ্লেষণও করছেন অনেকে।
সমালোচনা আছে মুহিব খানের আল্লামা লকব নিয়েও। এ ক্ষেত্রে তার বয়স ও কাজের স্বল্পতার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন অনেকে। মুহাম্মদপুরের এক মাদরাসা শিক্ষক আবদুল্লাহ আল মাসুদ নামের ফেসবুকে মন্তব্য করেছেন, আল্লামা লকবে তাকে নাবালেগ মনে হয়। ঠিক এখনই এরকম লকব মানানসই ছিল না তর জন্য।
এর আগে আওয়ার ইসলামের একটি নিউজে তার নামের আগে আল্লামা লিখলে পাঠকরা রিপোর্টারকে অবিবেচক বলেও উল্লেখ করেন। যদিও তারা এটা বিবেচনা করেননি ব্যক্তি তার নাম ও উপাধি যেভাবে লেখেন সেভাবে নিউজে উল্লেখ করাই সিদ্ধ।
নতুন করে তার কবিত্ব নিয়ে শুরু হয়েছে সমালোচনা। সমালোচনার জবাবে দেয়া মুহিব খান তার এক পোস্টে জানিয়েছেন, অনুষ্ঠানে বক্তারা তাকে রবীন্দ্র-নজরুলের পর একবিংশের একমাত্র কবি বলে উল্লেখ করেছেন। ফেসবুকে রীতিমতো বিষয়টি এখন ট্রলের শিকার।
অবশ্য ভক্তরা বলছেন, কেউ যদি তাকে ‘একবিংশের একমাত্র কবি’ বলে স্বীকৃতি দেয় বিষয়টা উপহাসের নয় বরং আমাদের পরম প্রাপ্য।
মুহিব খান একজন প্রতিভাবান এবং তার সমকালীন বিষয় নিয়ে গান ও কবিতা লেখার শক্তি অতুলনীয়। তবে তার আত্মপ্রচারের মানসিকতা দৃষ্টিকটু উল্লেখ করে ফেসবুকের একটি পোস্টে কবি সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর লিখেছেন, ‘মুহিব খান ভালো ছান্দসিক কবি, সন্দেহ নেই। তার ছন্দজ্ঞান এবং গান বাঁধবার শক্তি উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু তার আত্মপ্রচার এবং আত্মপ্রসাদে বুঁদ হয়ে থাকার যে বিব্রতকর প্রচেষ্টা, এটা খারাপ লাগে। এই মুদ্রাদোষটি যদি তার না থাকতো তবে তিনি বহুদিন আগেই বাংলাদেশের প্রথিতযশা কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেতেন।
কিন্তু যিনি নিজেকে ছাড়া পৃথিবীর আর কাউকে (জীবিত) কবি হিসেবেই ধরেন না, তাকে আর কে তোয়াজ করতে যাবে। তার তোয়াজ তার নিজেরই করতে হয়!’
তবে মুহিব খান তার প্রোগ্রামে নারী ইস্যুটিকে ‘সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দাওয়াতি কার্যক্রম’ উল্লেখ করে তর্কের জবাব দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি অযথা বিতর্ক সৃষ্টিকারীকে আহমক বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করে জ্ঞানী শত্রু কামনা করেছেন।
বছর খানেক ধরেই কবি মুহিব খানের নামের আগে আল্লামা লেখতে দেখা যাচ্ছে। এই বয়সে এই লকব অন্য কেউ না বসালেও তার ভক্তদের অনেকে এটাকে মেনে নিয়েছেন এবং নানা যুক্তিও তুলে ধরছেন।
তবে ভক্তরা যাই বলুক, মুহিব খান তার নিজের ইচ্ছাতেই যে এটি ব্যবহার করছেন এবং নিজেকে এর মাধ্যমে আল্লামা ইকবালের সঙ্গে তুলনার একটা বাসনা মনে মনে পুষছেন তা সহজেই অনুমেয়।
মুহিব খানের গীতিসত্ত্বাকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন বিষয়টি তাদের মানতে অসুবিধা হবে না হয়তো, কিন্তু আল্লামা ইকবাল যেখানে নিজের দেশ ও সমকালিনতাকে ছাপিয়ে বিশ্বময় প্রসারিত হয়ে উঠেছিলেন তার নিকটবর্তী অন্তত কিছু নজির বা সময়ের অপেক্ষা থাকতে হবে মুহিব খানের মধ্যে। দাবি সমালোচকদের।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, অনেকের কাছে কবি মুহিব খান যে আঙ্গিক নিয়ে কাব্য চর্চা করছেন তা ৩০ এর দশকেই থেকে গেছে। অথচ কবিতা এখন আধুনিক থেকে উত্তর আধুনিক যুগ পার করছে যেখানে মুহিব খানের কবিতা ছন্দ ও গতিময়তার দিক থেকে পিছিয়ে।
যদিও তার কবিতার ধর্মীয় ভাবাবেগের একটি পৃথক মূল্যায়ন রয়েছে।
সে নিরিখে একালের কবিদের ভাষ্য, ভাষা ও কবিতা কখনো এক জায়গায় স্থির থাকে না। আধুনিক কবিতায় যে রহস্যময়তা ও জীবনজটিলতার প্রতীকী ব্যঞ্জনা ধরা পড়েছে তা মুহিব খানের কবিতায় অদৃশ্য।
অথচ এ কালের কবিতায় প্রাচীন সব ধ্যান-ধারণার বিপরীতে এমন এক জীবনবীক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে, যা ছিল সুদীর্ঘকালের অভ্যস্ত ধারণার বিপরীতে এক নতুন ও অভিনব নির্মাণ।
১৪ অক্টোবর আল্লামা মুহিব খানের ‘জাগ্রত প্রহর’
মুহিব খানের কবিতা: কাবার ইমাম আপনি জাগুন