রেজাউল করিম আবরার
শিক্ষক ও কলামিস্ট
দেওবন্দ! আমাদের শিকড়। আকাবিরদের চোখের পানি আর কলজের খুনে সিক্ত প্রতিষ্ঠান। মক্কা, মদীনা এবং বায়তুল মাকদিসের পর আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা!
যে মাটি মাড়িয়েছেন হুজ্জাতুল ইসলাম কাসিম নানুতবী, শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দি, মুহাদ্দিসুল আসর আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী, হাকিমুল উম্মাত আশরাফ আলী থানভী, শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী, সে মাটির ভালোবাসা আমার হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত।
নিজের পরিচয় দেয়ার কিছুই নেই। শুধু বুক ফুলিয়ে বলতে পারি যে, দেওবন্দের স্বর্ণ কাফেলার আমিও একজন ক্ষুদ্র সদস্য! মূর্খ হওয়া সত্ত্বেও দেওবন্দি চেতনা লালনের চেষ্ঠা করি।
দেওবন্দিয়ত কী? কী কাজ করলে দেওবন্দি হওয়া যাবে? এ বিষয়ে প্রথমে কয়েকজন আকাবিরের বক্তব্য তুলে ধরছি।
দারুল উলূম দেওবন্দের সূর্য সন্তান মাওলানা মানযুর নুমানী রহ. রাসূলগণ কবরে জীবিত থাকা সংক্রান্ত একটি কিতাব লিখেছেন ‘মাসআলাতু হায়াতিন নাবী’ নামে। সে কিতাবের শেষে তিনি দেওবন্দের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলাচনা করতে গিয়ে লিখেন-
“দারুল উলূম এবং আকাবিরে দেওবন্দ হলো একটি শিরোনাম। বসুধার সকল উত্তম পন্থা, উত্তম ফিকির এবং প্রত্যেক উত্তম বস্তু হল দেওবন্দিয়ত”। (মাসাআলাতু হায়াতিন নাবী, পৃষ্টা নং, ১৩০)
১৪০০ হিজরীতে দারুল উলূম দেওবন্দের শতবার্ষিকী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে মুফাক্কিরে ইসলাম আল্লামা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. একটি যুগান্তকারী বক্তব্য পেশ করেছিলেন।
সে ভাষণে তিনি দেওবন্দের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, দেওবন্দের বৈশিষ্ট্য হল চারটি।
“এক: এ দরসগাহের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এ দরসগাহ মতনৈক্যকে পেছনে ফেলে তাওহীদ এবং সুন্নতের উপর নিজের দৃষ্টি রাখবে। আর এটা এমন ওয়ারাছাত এবং আমানত, যা শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী, শাহ ইসমাইল শহীদ এবং সায়্যিদ আহমদ শহীদ এর ওসীলায় এ প্রতিষ্ঠান পেয়েছে এবং এখন পর্যন্ত শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে আছে।
দুই: সুন্নাতের অনুসরণের জযবা এবং ফিকির থাকতে হবে।
তিন: আল্লাহর সাথে সম্পর্ক তৈরি করার ফিকির, যিকির এবং গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার জযবা থাকতে হবে।
চার: আল্লাহর কালেমা বুলন্দীর জযবা থাকতে হবে এবং চেষ্টা করতে হবে। এ চারটি শিরোনাম যার মধ্যে থাকবে, সে দেওবন্দি। যদি এর মধ্যে কোন একটি কমে যায়, তাহলে সে পূর্ণ দেওবন্দি নয়”। (কারওয়ানে জিন্দেগী, ৩/৩১০-৩১১)
এ প্রসঙ্গে কারী তায়্যিব সাহবে রহ. এর বক্তব্য অবশ্যই বেশ চমৎকার । তিনি বলেন, উলামায়ে দেওবন্দের গুণ হল ‘দিলে দরদমন্দ, ফিকরে আরজুমন্দ, যবানে হুশমন্দ’। অর্থাৎ তারা হবেন দরদী হৃদয়, সমুন্নত চিন্তা এবং সুপ্রাজ্ঞ ভাষার অধিকারী”।
এ বিষয়ে শায়খুল ইসলাম তাকি উসমানী’র ছোট রেসালা “আকাবিরে দেওবন্দ কিয়া থে” অবশ্যই পাঠ করার মত একটি বই। আমাদের আকাবিরদের জীবনের বাকেঁবাঁকে ঘটে যাওয়া ঘটনা পড়ে চোখে অশ্রু চলে আসে! বুক ফুলিয়ে বলতে পারি, এরাই আমাদের পিতৃ পুরুষ। আমরা তাদের উত্তরসুরি।
দেওবন্দিয়ত নিয়ে মনে হয় সবচেয়ে বেশি মাতামাতি করি আমরা। এই দল করলে দেওবন্দি, এই দল না করলে পরিপূর্ণ দেওবন্দি না, এগুলো নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক করি আমরা।
আসলে দেওবন্দিয়ত আকাবিরদের বক্তব্য থেকে যতটুকু অনুধাবন করা যায় কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নয়। কারণ দেওবন্দিয়ত তো একটি ফিকিরের নাম!
বাকি আমাদের আকাবিররা যে দল করেছেন, সে দলকে অবশ্যই আমাদের সকলের সম্মান করা উচিৎ।কিন্তু দেওবন্দি হতে হলে আপনাকে এ দল করতে হবে এগুলো বাতুলতা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন করা যেতে পারে, বর্তমানের সাইদ আহমদ পালনপুরী, তাকি উসমানী এবং আবদুল মালেক সাহেবরা কি দেওবন্দি নয়? এজন্য মনে হয় আমাদের প্রচলিত রাজনীতিতে দেওবন্দিয়তকে না টেনে আনাই ভালো। আল্লাহ আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করুন।
‘কওমি শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ করছি’