শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
কাল যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় মজলিসে দাওয়াতুল হকের ইজতেমা শেখ হাসিনা ভারতে বসে দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন: মজলিস মহাসচিব ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহে ৩১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৬২৩০ মসজিদে নববীর আদলে হবে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ: ধর্ম উপদেষ্টা খাগড়াছড়ি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত নতুন নির্বাচন কমিশনকে বিগত কমিশন থেকে শিক্ষা নিতে হবে: মুফতী ফয়জুল করীম লালপুরে যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে জমি দখল ও বাড়ি ভাংচুরের অভিযোগ জনতার চেয়ারম্যান সৈয়দ তালহাকে সুনামগঞ্জ ৩ আসনে জমিয়তের প্রার্থী ঘোষণা কুরআন-হাদিসের ভিত্তিতেই হতে হবে সংস্কার: বায়তুল মোকাররমের খতিব ইসলামী সঙ্গীত সম্রাট আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ.-এর বাবার ইন্তেকাল

প্রবাসে বাংলাদেশি ইমামদের সাফল্যগাথা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

যুবায়ের আহমাদ
আলেম, কলামিস্ট

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা উজ্জ্বল করছেন বাংলাদেশের হাফেজ-আলেমরা। আন্তর্জাতিক কোরআন অ্যাওয়ার্ডে কিছুদিন পরপরই বাংলাদেশের হাফেজরা পৃথিবীর শতাধিক দেশকে পেছনে ফেলে বিজয়ের মুকুট ছিনিয়ে এনে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছেন।

দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত ২১তম দুবাই হলি কোরআন অ্যাওয়ার্ড প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের পতাকা সামনে নিয়ে ১০৩টি দেশকে পেছনে ফেলে বিজয়ী হয়ে এসেছিলেন হাফেজ তরিকুল ইসলাম।

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে বাহরাইনের রাজধানী মানামায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কোরআন হিফজ ও কেরাত প্রতিযোগিতায় বিগত ৫০ বছরের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে পৃথিবীর ৬০টি দেশের প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে প্রথমবারের মতো একই সঙ্গে কেরাত ও হিফজুল কোরআন উভয় প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করে বাংলাদেশের জন্য বিরল সম্মান বয়ে আনেন হাফেজ জাকারিয়া।

প্রতিবছর বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের ছেলেরা বিজয়ী হয়ে কোটি কোটি টাকা রেমিট্যান্স নিয়ে আসছেন।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে উজ্জ্বল করেছেন উস্তাদ শাইখ আহমাদ বিন ইউসুফ। ক্বিরাতে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তিত্ব তিনি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় শীর্ষ বিচারকের ভূমিকা পালন করে থাকেন বাংলাদেশের গর্ব শাইখ আহমাদ বিন ইউসুফ আল আজহারি।

ক্বিরাত নিয়ে রাজকীয় অতিথি হিসেবে প্রায়ই বিভিন্ন দেশে আমন্ত্রিত হয়ে থাকেন ক্বিরাত জগতের এ পুরোধা ব্যক্তিত্ব।

তরিকুল ইসলামের মতো অনেক হাফেজ, কারি ও আলেম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সম্মানের সঙ্গে ধর্মীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছেন। যাঁদের বেশির ভাগই কওমি মাদরাসায় শিক্ষিত।

ইউরোপ, আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মানসম্পন্ন ইমাম ও খতিব পেতে দক্ষ জনশক্তির জন্য আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ। অনারব হয়েও কাতারের আমিরের প্রাসাদের খতিব হিসেবে কর্মরত আছেন একজন বাংলাদেশি।

বাংলাদেশের কৃতীসন্তান, ঢাকার মারকাজুত তানজিল আল ইসলামিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছেলে হাফেজ মাওলানা সাইফুল ইসলাম কাতারের বিপুল সম্মানজনক এ পদে কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।

২০১৫ সালে দুবাইয়ের শ্রেষ্ঠ ইমাম নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশের গৌরব বয়ে এনেছিলেন মাওলানা আবদুস সালাম। (বাংলানিউজ : ২৮ অক্টোবর, ২০১৫) ব্রিটেনের অন্যতম বড় মসজিদ রিজেন্ট পার্ক মসজিদে ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশের কৃতীসন্তান মাওলানা কাজী লুত্ফুর রহমান।

দুবাইয়ের ৫০০ বছরের প্রাচীন আল বিদিয়া মসজিদে দীর্ঘদিন ধরে ইমামের দায়িত্ব পালন করছেন চট্টগ্রামের হাফেজ আহমাদ।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে চার হাজার মসজিদ রয়েছে। এসব মসজিদে বাংলাদেশি খতিব ও ইমামের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও আমিরাতের ৭০ শতাংশ মসজিদের মুয়াজ্জিনই বাংলাদেশি। তবে যাঁরা মুয়াজ্জিন হিসেবে কর্মরত আছেন, তাঁরাও ইমামের মর্যাদাই পান। (বাংলাদেশ প্রতিদিন : ১১ আগস্ট, ২০১৭)

যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন এবং শুদ্ধ উচ্চারণ ও সুকণ্ঠে কোরআন তিলাওয়াতে পারদর্শী হওয়ায় স্থানীয়দের কাছে তাঁদের কদর অনেক বেশি। ইমাম, মুয়াজ্জিন ও শিক্ষক হিসেবে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বাংলাদেশি দায়িত্ব পালন করছেন। সরকারি ওয়াকফর মাধ্যমে নিয়োগ পেলে বাংলাদেশি মুদ্রায় মাসে দেড় লাখ টাকা বেতন পান।

এর বাইরে রয়েছে মুসল্লিদের পক্ষ থেকে প্রদত্ত হাদিয়া (সম্মানী বা উপহার)। পরিবার নিয়ে যাওয়া-আসা ও থাকার সব ব্যবস্থা করা হয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকেই। ফলে তাঁরাও প্রচুর অর্থ দেশে পাঠাতে পারেন। প্রায় ৭০ কোটি টাকা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে কর্মরত ইমাম, খতিব, মুয়াজ্জিন ও ধর্মীয় শিক্ষকরা।

পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ ধনী দেশ কাতারে কর্মরত আছেন প্রায় এক হাজার ২০০ বাংলাদেশি ইমাম, মুয়াজ্জিন।

কাতারে মসজিদের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। সেখানে ইমাম নিয়োগ হয় সরকারিভাবে। বাংলাদেশি আলেমদের মেধা, আচরণ, মনোমুগ্ধকর তিলাওয়াত, শুদ্ধ আরবি ও অন্যান্য সাফল্যের কারণে কাতারিদের কাছে বাংলাদেশি ইমামদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

১৯৯০ সালে প্রথম বাংলাদেশ থেকে কাতার সরকার ইমাম নেয়। কাতারের আমিরের রাজকীয় প্রাসাদের খতিবের পদসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মসজিদের খতিব পদে বাংলাদেশি আলেম কর্মরত আছেন।

সরকারি ও বেসরকারিভাবে কর্মরত খতিব, ইমাম, মুয়াজ্জিন ও শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় এক হাজার ২০০ হলেও খতিবের সংখ্যা খুব কম। বেশির ভাগই সহকারী ইমাম ও মুদাররিস (শিক্ষক)।

খতিব ও মুদাররিস হিসেবে দায়িত্ব পালন করলে বেতন পান সাত হাজার ৭০০ রিয়াল বা এক লাখ ৭০ হাজার ৫৫৫ টাকা। এর বাইরে রয়েছে মুসল্লিদের পক্ষ থেকে প্রদত্ত হাদিয়া (সম্মানী উপহার)। যাঁরা শুধু সহকারী ইমাম ও শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা পান এক লাখ ৩৯ হাজার ৫৪৫ টাকা বেতন।

কাতারে খতিব, ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের জন্য পানি, বিদ্যুৎ ও প্রয়োজনীয় সুবিধাসহ মানসম্মত আবাসন একেবারেই ফ্রি। চিকিৎসার খরচও বহন করে কাতার সরকার। ইমামরা তাঁদের সন্তানদের কাতারের সরকারি বিদ্যালয়ে পড়ালে তা-ও একদম ফ্রি। ফলে তাঁরা বেতন ও হাদিয়া যা-ই পান, পুরোটাই দেশে পাঠাতে পারেন।

গড়ে দুই লাখ টাকা দেশে পাঠালে প্রায় ২৫ কোটি টাকা প্রতি মাসে তাঁরা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছেন বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা।

যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে প্রসারিত হচ্ছে ইসলাম। মুসলমানের পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মসজিদের সংখ্যাও। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় আড়াই হাজার মসজিদ রয়েছে। সেগুলোতে রয়েছে বাংলাদেশি ইমামদের চাহিদা।

যুক্তরাষ্ট্রের মতো যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন মসজিদে কর্মরত বাংলাদেশি ইমাম, খতিব, মুয়াজ্জিন হিসেবে দুই হাজারেরও বেশি আলেম কর্মরত আছেন। তবে তাঁদের বেশির ভাগই বাংলাদেশি কমিউনিটি পরিচালিত মসজিদগুলোতে কর্মরত।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশি কমিউনিটিতে প্রায় ৫০০ মসজিদ আছে। মসজিদে ইমামতির পাশাপাশি তাঁরা সেখানে শিক্ষক হিসেবেও কাজ করেন। ইভিনিং মকতব, সাপ্তাহিক ক্লাস ও ইমামতি মিলে সপ্তাহে প্রায় ৫০০ পাউন্ড, মাসে দুই হাজার পাউন্ড বেতন পান ইমামরা।

বর্তমান রেট অনুযায়ী (১ পাউন্ড ১১০ টাকা) মাসে ব্রিটেন প্রবাসী বাংলাদেশি ইমামরা প্রায় দুই লাখ ২০ হাজার টাকা বেতন পান। তবে যুক্তরাজ্যে জীবনযাত্রা বেশি ব্যয়বহুল হওয়ায় এর অনেকটাই তাঁদের খরচ হয়ে যায় সেখানে।

তবু হিসাব করে চললে প্রায় এক লাখ টাকা প্রতি মাসে তাঁরা দেশে পাঠাতে পারেন। সে হিসাবে যুক্তরাজ্যে কর্মরত বাংলাদেশি প্রবাসী ইমামরা প্রতি মাসে প্রায় ২০ কোটি টাকা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে আমাদের জাতীয় অর্থনীতির চাকা গতিশীল করছেন।

মসজিদ ছাড়াও সেখানে বিভিন্ন ইসলামী খেদমতের সঙ্গে জড়িয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন বাংলাদেশি আলেমরা। মাদানি গার্লস স্কুল, লন্ডন ইসলামিক স্কুল ও বর্মিংহাম জামিয়া ইসলামিয়াসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তাঁরা।

ভালো ইংরেজি জানা কর্মঠ আলেমরা বাংলাদেশি কমিউনিটি ছাড়া অন্যান্য কমিউনিটিতেও সম্মানের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। মসজিদ, মাদরাসা ও মক্তব প্রতিষ্ঠা ছাড়াও বিভিন্ন স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলাদেশি আলেমরা। তাঁদের প্রতিষ্ঠিত কিছু কিছু স্কুল সাধারণ স্কুলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ফলাফলে চমক দেখাচ্ছে।

বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে কর্মরত ইমামরা দেশের গৌরব বয়ে আনার পাশাপাশি প্রায় ১৫০ কোটি টাকা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন।

এ খাতে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি নিতে আগ্রহী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের পারস্পরিক বোঝাপড়া, সমঝোতা ও ভিসা প্রসেসিংয়ের জটিলতার অবসানসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুবিধার হাত প্রসারিত করলে এ খাতে দক্ষ লোকবল দেশে অবদান রাখার পাশাপাশি দেশের বাইরেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে, অন্যদিকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল করবে পৃথিবীবাসীর কাছে।

লেখক : জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কারি ও খতিব বাইতুশ শফীক মসজিদ, বোর্ডবাজার, গাজীপুর।

সূত্র: কালেরকণ্ঠ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ