মাজার ও ধর্ম ব্যবসা সমাচার
প্রকাশ:
১২ অক্টোবর, ২০২৪, ০৮:৩৪ রাত
নিউজ ডেস্ক |
|| হাসান মুরাদ || মাজার একটি আরবি শব্দ। এটি ফারসি দরগাহ শব্দের প্রতিশব্দ। এর ধাতুগত অর্থ ‘জিয়ারত বা 'দর্শনের স্থান'। এক্ষেত্রে সব মুমিনের কবরই ‘মাজার’। কেননা সব মুমিনের কবরই জিয়ারতের স্থান এবং কবরই জিয়ারত করা হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশে মাজার বলতে সাধারণত অলি-আওলিয়া, দরবেশগণের সমাধিস্থলকে বোঝায়। আরবে মাজারকে মাকামও বলা হয়। আবার মাজারকে রওজা বা কবরও বলা হয়। মুহাম্মাদ সা. কে মসজিদে নববীর ভেতরে নিজ ঘরেই দাফন করা হয়। আমরা এখন যা জিয়ারত করে থাকি। রাসুল সা. মদিনার কবরস্থান জান্নাতুল বাকিতে এবং উহুদের যুদ্ধে শাহাদতপ্রাপ্ত সাহাবিদের কবরস্থানে গমন করতেন এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। সুফিতন্ত্র অনুসারীরা সুফি দরবেশদের কবরস্থান জিয়ারত করতে পছন্দ করেন। অনেক মাজারে সমাধিস্থ ব্যক্তির ওরশ অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়। একে ঈসালে ছওয়াবের মাহফিল বলে। ঐতিহাসিক মাজারগুলি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ওয়াক্ফ সম্পত্তি থাকে এবং খাদেমও থাকেন; অনেক ক্ষেত্রে তারা উত্তরাধিকারসূত্রে এ পদে অধিষ্ঠিত হন। মাজার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ মওজুদ আছে। সব থেকে বেশি মাজার মিশরে। অনুন্ধানে যানা যায়, মিশরে প্রায় ৬,০০০ মাজার আছে। কিছু প্রসিদ্ধ মাজার আছে অথচ যার নামে মাজার তার কবর সম্পর্কে ৪ দেশ চার স্থানে কবরের কথা আছে। এখান থেকে অনুমেয় মাজারগুলো মানুষের অনুমান নির্ভর হয়ে গড়ে উছেছে। আমাদের দেশেও আছে প্রচুর মাজার।এসব মাজারের কর্মকান্ড আমাদের সকলেরই সামনে স্পষ্ট। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে দেখা যাচ্ছে এক-দুজন বুদ্ধিজীবি এবং কিছু ভাবপ্রগতশীল মানুষ মাজারের পক্ষে কথা বলছেন। তারা বলতে চাচ্ছেন এগুলো ধর্মীয় একটি সাধনা এবং এসব মাজারের নাকি আছে ঐতিহ্যগত ইতিহাস। এবং তাদের আরো বড় দাবি হল মাজারে যারা অবস্থান করে তারা তো কারো হক মারে না, কারো ক্ষমতার দেয়াল দখলের জন্য হুমকি হয় না ইত্যাদি। অন্যদিকে মাজারপন্থীরা বলছেন যারা মাজারের বিরুদ্ধে যে সকল উলামারা কথা বলেন তারা নাকি ধর্ম ব্যবস্য করেন। কিন্তু আমরা দেখছি উল্টো বিষয়। একটি সাধারণ পর্যায়ের মাজারে যে পরিমাণ মান্নতের ছাগল,গরু, মুরগি, ডিম, নগদ টাকা আসে তা আম জনতার ধারণার বাইরে। প্রশ্ন হল; এসব সম্পদ যায় কোথায়? কারা এগুলো গ্রাস করে? এগুলো কি ধর্মের নামে হারাম ব্যবসা নয়? আবার যারা মাজারের পক্ষে কথা বলছেন তাদের ধর্মীয় জ্ঞান কতটুকু? তারা নিজেরাও কতটুকু ধর্ম পরিপালন করেন? আমার মনে হয় এটাও একটা রাজনীতি! এসব কথা বলে কিছু মানুষকে উস্কে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে চাই। আরেকটি কথা। আমি / আমরা তাদের ভাষায় মুল্লা,মৌলভি মানুষ। লেখাপড়া মাদরাসাতে। বিভন্নি সময়ে শিক্ষাবিদরা আমাদের বলেন বিজ্ঞান মনস্ক হতে। মাদরাসা শিক্ষাকে বিজ্ঞানময় করতে ইত্যাদি জাতীয় কথা। এগুলো স্ন্দুর পরামর্শ। আমাদের কাজগুলো বিজ্ঞান সমৃদ্ধ হওয়া উচিত। এখন তাদের কাছে আমার প্রশ্ন বর্তমানে মাজারগুলোতে যা চলছে তা কি বিজ্ঞানময়। মাদ-মাদক, সমাজিক কুসংস্কার কি বিজ্ঞান সমর্থন করে? নিশ্চয় না। তাহলে এসব বিজ্ঞান মসস্ক বুদ্ধিজীবিরা কেন মাজারগুলোকে বিজ্ঞানময় করে গড়ে তোলার আওয়াজ তুলছেন না? মাজারগুলোকে বিজ্ঞান গবেষনা কেন্দ্র গড়ে তুলুন। দ্বিতীয়ত: সব কিছুর মূলে হল শিক্ষা-দীক্ষা। শিক্ষা ছাড়া সবই মনগড়া। মাদরাসাগুলোতে কুরআন সুন্নাহ শেখানো হয়। কিন্তু মাজারগুলো যারা আছেন,যারা ধ্যান করছেন তারা কি বিদ্যায় পারদর্শী? সুতরাং বুদ্ধিজীবিদের উচিত মাজারগুলোতে বিজ্ঞান সেন্টার না হলে মাদরাসা গড়ে তোলা দরকার। আমরা দেখছি মাজারকেন্দ্রিক কার্যকলাপের তাত্তিক প্রেক্ষাপট মাজারকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে যেসব অনাচার হয়ে থাকে তার অধিকাংশই রিপুতাড়িত কর্মকান্ড। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, গান-বাদ্য এবং মদ ও গাঁজা হচ্ছে মাজারকেন্দ্রিক মেলা ও ওরসের অন্যতম অনুষঙ্গ। এগুলোর তাত্তিকসূত্র একটিই, তা হচ্ছে, নোংরামী ও রিপুর চাহিদা-পূরণ। এজন্য দেখা যায়, এইসব মাজার-ওরসে অংশগ্রহণকারীদের সিংহভাগ হল সমাজের অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন জনগোষ্ঠী। মাজারে আগত নারী-পুরুষের দান-দক্ষিণা ও মান্নত-কোরবানি গ্রহণ করে এবং ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবজ ও আশীর্বাণী বিক্রি করে। বলাবাহুল্য, এখানে তত্তে চেয়ে বৈষয়িক দিকটিই বড় আর এটাই ধর্মের নামে ব্যবসা। তাছাড়া মাজারে আগত লোকেরা বিভিন্ন কুফরি ও শিরকি ধারণা পোষণ করে। যেমন মাজার বা মাজারে শায়িত ব্যক্তিকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী মনে করা; হাজত-পূরণকারী, বালা-মসিবত থেকে উদ্ধারকারী এবং মানুষের উপকার-অপকারের মালিক মনে করা ইত্যাদি। এসকল শিরকি বিশ্বাস থেকে তারা বিভিন্ন শিরকি কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়। যথা : মাজারের নামে মান্নত করা, মাজারে সেজদা করা, পশু জবাই করা, মাজারওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে রোনাযারী করা এবং মাল-দৌলত, সন্তান-সন্তুতি, সুস্থতা ও সচ্ছলতা প্রার্থনা করা ইত্যাদি। এভাবে বিশ্বাসের শিরক মানুষকে কর্মের শিরকের মাঝেও লিপ্ত করে দেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা শুধু ‘অপব্যাখ্যা’ থাকে না; বরং জরুরিয়্যাতে দ্বীন বা দ্বীনের সর্বজনবিদিত আকিদা ও আমলকে অস্বীকার করা হয়। হাদিস শরিফে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘‘আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন তোমরা জিয়ারত করতে পার। কারণ তা আখিরাতের কথা মনে করিয়ে দেয়। (সুনানে আবু দাউদ হাদীস : ২১২৭) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও তাঁর সাহাবীদের কবর জিয়ারত করেছেন এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন। কবর জিয়ারতেরও মাসায়েল ও নিয়মকানুন আছে। সে মোতাবেক কবর জিয়ারত করলে তা হবে সওয়াবের কাজ। পক্ষান্তরে কোনো কবরকে ‘মাজারে’ পরিণত করে বছর বছর নির্দিষ্ট স্থানে জমায়েত হওয়া এবং উৎসবে পরিণত করা সম্পূর্ণ হারাম। হাদিস শরিফে পরিষ্কার ভাষায় তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এক হাদিসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা নিজেদের ঘরকে কবর বানিয়ো না। (অর্থাৎ কবরের মতো ইবাদত-বন্দেগি শূন্য করো না) এবং আমার কবরকে উৎসবের স্থান বানিয়ো না। বরং আমার প্রতি দরূদ পড়। কেননা তোমরা যেখানেই থাক না কেন তোমাদের দরূদ আমার নিকট পৌঁছবে।’-সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২০৪০। সত্যকে জানুন। স্বার্থের রাজনীতি বন্ধ করুন। মনে রাখতে হবে মাজারপন্থীরা কারো ক্ষমতা নিতে চাই না এটা সত্য, কিন্তু তারা হাজার হাজার মানুষের ঈমান কেড়ে নিচ্ছে। রাষ্ট্রিয় চেয়ারের চেয়ে ইমানের দাম অনেক বেশি। সুতরাং মুমিন নর-নারীর ঈমান রক্ষার্থে আমরা মাজারের এসব অনৈতিকতা, অধর্ম, শিরকের বিরুদ্ধে বলেই যাব ইনশাআল্লাহ! লেখক: আলেম, শিক্ষক, কলামিস্ট ও আলোচক এনএ/ |