সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


যেভাবে শহীদ হন হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রা.

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি মুহাম্মাদ রাশিদুল হক
অতিথি লেখক

হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রা. তখন মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলীফা। কিছু সাথী নিয়ে মদীনার একটি পথ ধরে চলছেন। পথের পাশেই একটি দোকান চোখে পড়লো তাঁর। দোকানটি অগ্নি উপাসক আবু লুলুর।

খলীফা প্রবেশ করলেন দোকানটিতে। আবু লুলুকে প্রশ্ন করলেন তোমার পেশা কী? আবু লুলুর উত্তর- আমি লৌহকার এবং ছুতার। পেষণযন্ত্রও (জাঁতা) তৈরি করি।

আমীরুল মুমিনীন তাকে লক্ষ করে বললেন, আমি শুনেছি তুমি নাকি বলেছো, আমি এমন পেষণযন্ত্র তৈরি করতে সক্ষম যা বাতাসে চলবে। শুনে অগ্নি উপাসক বলল, আমি আপনার জন্য এমন কিছু করব যা সারা দুনিয়ার মানুষ জানবে।

হযরত উমর রা. এবার সঙ্গীদেকে লক্ষ করে বললেন, দেখ সে কিন্তু আমার সাথে অঙ্গীকার করেছে। এ কথা বলে তিনি দোকান থেকে বেরিয়ে পড়লেন।

কিছু দিন পর আবু লুলু একটি খঞ্জর তৈরি করল। সেটির হাতল ছিলো মাঝখানে, ফলা দুইপাশে। উভয় দিকে ধারালো সেই খঞ্জরটি সে পুরো এক মাস বিষের মধ্যে ডুবিয়ে রাখলো। যেন সেটি দিয়ে কাউকে আঘাত করলে সল্প আঘাতেও বিষক্রিয়া রক্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং আঘাত মামুলি হলেও যেন আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই না পায়।

এরপর কোনো এক রাতের আঁধারে সে মসজিদে নববীতে সবার অগোচরে প্রবেশ করে মেহরাবের ভেতরে লুকিয়ে রইল।

হযরত উমর রা. অন্যান্য দিনের মত সেদিনও ফজরের নামজের জন্য মসজিদের প্রবেশ করেন এবং মসজিদে অবস্থানরত ব্যক্তিদের জাগিয়ে দিতে ‘আসসালাত’ ‘আসসালাত’ বলতে লাগলেন। জামাতে জন্য মুসল্লিবৃন্দ প্রস্তুত হলেন।

তখনকার দিনে বর্তমান সময়ের মত মসজিদে এত আলোর ব্যবস্থা ছিলো না। সারা মসজিদে একটি বা দুটি বাতি জ্বলতো। হযরত উমর রা. নামাজ শুরু করলেন। আবু লুলু তখনো মেহরাবে লুকিয়ে। সে মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায়।

আমিরুল মুমিনীনকে আঘাত করার সে দ্বিতীয় রাকাতকে বেছে নিলো। যেন মহল্লার সবাই জামাতে থাকে এবং তার পালিয়ে যেতে সহজ হয়।

আমিরুল মুমিনীন দ্বিতীয় রাকাত শুরু করলেন। সুরা ফাতিহা পড়ছেন- আলহামদু লিল্লাহি রব্বিল আলামীন।... ইয়াকা নাসতাঈনু’ পর্যন্ত পৌঁছতেই আবু লুলু হায়েনার মত ঝাপিয়ে পড়লো তাঁর উপরে।

মুহূর্তেই আঘাতে আঘাতে জর্জতিক করল তাঁকে। একটি বুকে, অপরটি পার্শ্বদেশে এবং শরীরের বিভন্ন স্থানে আরো কয়েকটি।

সবচেয়ে গুরুতর আঘাতটি ছিলো তাঁর তলপেটে। নাভির নিচের অংশে পুরো খঞ্জরটি ঢুকিয়ে হেচকা টানে ফেঁড়ে ফেলে দিয়ে ছিলো পেট। জখম এতটাই বড় হয় যে, এতে আমীরুল মুমিনীনের অন্ত্রের কিছু অংশ বাইরে বেরিয়ে আসে। তিনি একটি চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

এবার আবু লুলুর পালানোর পালা। নামাজের কাতার থাকা মুসল্লীদের বিষাক্ত খঞ্জর দিয়ে ডানে বায়ে আঘাত করতে করতে দরজার দিকে এগিয়ে যায় সে।

এ সময় মোট তেরজন মুসল্লীকে আঘাত করে আবু লুলু। এর মধ্যে সাতজনই তৎক্ষণাত শহাদাত বরণ করেন। তাকে ধরতে অন্যরা পিছু নিলে রক্তাক্ত খঞ্জর নিয়েই সে ঘুরে দাঁড়ায় এবং কেউ কাছে এলেই তাকে আঘাত করতে উদ্যত হয়।

হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ রা. তার নিকটবর্তী হয়ে গেলে তাকেও আঘাত করতে উদ্যত হয় আবু লুলু। তিনি একটু পিছিয়ে আসেন এবং নিজের গায়ের চাদরটি খুলে ছড়িয়ে সেটি ছুড়ে দেন আবু লুলুর দিকে।

চাদরটি তার শরীরের উপর গিয়ে পড়ে এবং শরীর আবৃত করে ফেলে। এক পর্যায় তার পুরো শরীর জড়িয়ে যায়।

এবার সাহাবীরা তার দিকে এগিয়ে যান। আবু লুলু বুঝে ফেলে, সে ধরা পড়ে যাচ্ছে এবং আর রেহাই পাবার সুযোগ নেই। এবার নিজের গলায় বিষাক্ত ছুরিটি চালিয়ে দেয় এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তারপর সংক্ষিপ্ত দুটি সুরা দিয়ে নামাজ শেষ করা হয়।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, আমরা আমীরুল মুমিনীনের কাছে গিয়ে দেখি তার ক্ষতগুলো থেকে অনর্গল রক্ত ঝরছে। আমি রক্ত বন্ধ করার জন্য আমার হাতটি তার তলপেটে চেপে ধরতে চাইলাম।

কিন্তু ক্ষতটি এত বড় ছিলো যে আমার হাত তাঁর পেটের ভিতরে ঢুকে যায়। ততক্ষণাৎ আমি নিজের পাগড়ি খুলে আব্বজানের ক্ষতস্থানে বেঁধে দিই। ততক্ষণে তিনি জ্ঞান হারিয়েছেন। আমরা তাঁকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিই।

আমীরুল মুমিনীন শয্যশায়ী। আমরা তাঁর জ্ঞান ফেরানোর জন্য নানাভাবে চেষ্টা করতে থাকি। কিন্তু কিছুতেই তার জ্ঞান ফিরছিলো না।এভাবেই অনেক সময় কেটে গেল। সূর্য উদিত হলো।

একজন বুদ্ধি করে তাঁর কাছে গিয়ে উচ্চস্বরে বলতে শুরু করলেন- ‘আসসালাত ইয়া আমীরুল মুমিনীন’। একসময় আমীরুল মুমিনীন চোখ খুললেন। ডানে এবং বায়ে তাকালেন। উপস্থিত সবার চোখে অশ্রু পর্দার উপার থেকেও চাপা কান্নার শব্দ ভেসে আসছে।

নিজের শরীর ব্যাথায় ভারী। পরনের পোশাকে ছোপ ছোপ রক্ত। এমতাবস্থায় জ্ঞান ফিরে আমীরুল মুমিনীনের প্রথম প্রশ্ন- ‘মুসল্লীরা নামাজ পড়তে পেরেছেন? তোমরা সালাত আদায় করছ?’

সবাই সমস্বরে জবাব দিল, জি, আমীরুল মুমিনীন আমরা নামাজ আদায় করেছি। তাদের জবাব শুনে তিনি বললেন- ‘আলহামদুলিল্লাহ। যে ব্যক্তি নামাজ ছেড়ে দেয়, ইসলামে তার কোনো অংশ নেই।’

হযরত উমর রা. এবার পুত্র আবদুল্লাহ রা. কাছে অজুর পানি চাইলে সবাই ধারণা করলো হয়তো তিনি পান করার জন্য পানি চাইছেন। কিন্তু না, তিনি অজুর পানি চেয়েছেন।

তিনি বললেন, আমাকে অজুর পানি দাও। আমি ফজরের নামাজ শেষ করতে পারিনি।

পানি আনা হলো। আমীরুল মুমিনীন অজু শেষ করে বললেন, আবদুল্লাহ আমাকে বসিয়ে দাও। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বললেন, আব্বাজন আপনি এভাবেই নামাজ আদায় করতে পারেন।

হযরত উমর রা. কঠোর হয়ে পুনরায় নিজেকে বসিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। (তিনি বলে ছিলেন- ‘আকইদ নী লা উম্মা লাক’।

আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, আমি তাঁকে বসানোর জন্য তাঁর পিঠ কিছুটা বাকা করতেই তলপেটের ক্ষত দিয়ে কিছু অন্ত্র বেরিয়ে এলো। ফলে আবার তাঁকে শুইয়ে দিলাম এবং পাগড়ি দিয়ে আবার ক্ষতস্থান ভালোভাবে বেঁধে দিলাম।

হযরত উমর রা. নামাজ শেষ করলেন। নামাজের পর ইস্তেগফার করলেন এবং জিকির-দোআ পাঠ করলেন।

এবার উপস্থিত ব্যক্তিদের দিকে তাকিয়ে তাঁর প্রশ্ন- আমাকে আঘাত করেছে কে? নামাজ শেষ করার আগ পর্যন্ত তিনি নিজের আঘাত সম্পর্কে একটি প্রশ্নও করেননি।

উপস্থিত কেউ উত্তর দিল, মুগীরা বিন শুবার দাস অগ্নিপূজক আবু লুলু আপনাকে আঘাত করেছে। একথা শুনে তিনি বললেন- ‘আলহামদুলিল্লাহ। এমন ব্যক্তি আমাকে হত্যা করেছে যে এক আল্লাহর জন্য একটি সেজদাও করেনি।’

তিনি কোনো মুসলিমের হাতে আঘাতপ্রাপ্ত না হওয়ায় এবং মুসলমানদের অন্তদ্বন্দ্বের কারণ না হওয়ায় এই শুকরিয়া আদায় করেন।

এরপর ঘরে হেকিম প্রবেশ করলেন। তিনি এক পেয়ালা দুধ আনিয়ে আমীরুল মুমিনীনকে পান করাতে বললেন। দুধ আনা হলো। তিনি পান করলেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তা তাঁর ক্ষতস্থান দিয়ে বেরিয়ে এল।

হেকিম হতাশ হয়ে বেরিয়ে গেলেন। বেরিয়ে যাওয়ার সময় হযরত উমর রা. হেকিমের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তার কাপড় মাটি ছুঁয়ে যাচ্ছিলো।

হযরত উমর রা. হেকিমকে লক্ষ করে বললেন, ‘কাপড় উঠিয়ে পরো। এটি তোমার কাপড়েকে সুরক্ষা করবে এবং খোদভীতি বৃদ্ধি করবে।’

এভাবে প্রায় তিন দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর রা. শাহাদাত বরণ করেন।

তাঁর শাহাদাতে পর পবিত্র মদীনার নারীরা আক্ষেপ করে বলত, হায়! আমীরুল মুমীনীনের বদলে যদি আমার সন্তান মারা যেত।

তাঁর শাহাদাতে আম্মাজান আয়েশা রাযি. এতবেশি কান্না করেন যে, ধারণা করা হয়, নিজ পিতার মৃত্যুতেও তিনি এতটা কান্না করেননি।

হ্যাঁ তিনি হযরত উমর র.। তাঁর ব্যাপারে নবীজি সা. ইরশাদ করে ছিলেন, ‘আমার পরে কেউ নবী হলে উমর নবী হতো’। তিনি সেই উমর যিনি নিজে বলেছিলেন, ‘আমি বেঁচে থাকতে দিন-ধর্মের ক্ষতি হতে দেব না’।

মৃত্যুর আলিঙ্গনেও তিনি নিজের এবং গোটা সমাজের নামাজের ব্যাপারে ছিলেন সোচ্চার। ইন্তেকালের পূর্ব মুহূর্তেও অন্যকে দিনের ওপর অটল রাখার ফিকিরে মগ্ন।

মনে রাখা উচিত, আমরা কিন্তু নিজেকে তাঁর উত্তরসূরী মনে করি। কিন্তু প্রশ্ন হলো আমরা তার আদর্শ নিজেদের মধ্যে কতটুকু ধারণ করতে পেরেছি।

লেখক: মুহাদ্দিস, গবেষক

এই লেখকের আরও লেখা

ব্লু হোয়েল: পরিচিতি, প্রতিকার-প্রতিরোধ ও সচেতনতা

আহলে বাইতের ভালোবাসার নামে সীমালঙ্ঘন নয়!

হিজরী সন নিছক বর্ষপঞ্জি নয়


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ