মুহাম্মাদ শোয়াইব : সৌদি আরবে প্রথমবারের মতো নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতিসংক্রান্ত একটি আদেশ জারি করেছেন দেশটির বাদশাহ সালমান। বিশ্বে সৌদি আরবই একমাত্র দেশ, যেখানে এতদিন নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি ছিল না। কিন্তু এখন তারা গাড়ি চালানোর অনুমতি পেতে যাচ্ছেন।
সৌদি প্রেস এজেন্সির প্রতিবেদনে বলা হয়, নারীদের গাড়ি চালানোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন তৈরি করবে। আদেশটি ২০১৮ সালের জুন থেকে কার্যকর হবে।
নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দিতে দেশটির মানবাধিকার সংগঠনগুলো অনেক দিন থেকেই সক্রিয়। সেই প্রেক্ষাপটে রাজকীয় আদেশ অনুযায়ী পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও গাড়ি চালানোর লাইসেন্স দেয়া হবে বলে জানিয়েছে সৌদি প্রেস এজেন্সি।
নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতিসংক্রান্ত আদেশকে ‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত প্রিন্স খালেদ বিন সালমান। তিনি বলেছেন, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
প্রিন্স খালেদ বিন সালমান বলেন, গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পাওয়ার জন্য নারীদের তাদের পুরুষ অভিভাবকদের অনুমতি নিতে হবে না। নারীরা তাদের ইচ্ছানুযায়ী যেকোনো জায়গায় গাড়ি চালাতে পারবেন।
সৌদি সরকারের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন। সৌদি সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোও।
তবে সৌদির ওলামায়ে কেরাম বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?
সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদ ‘হাইয়াতু কিবারিল উলামা’ এর সদস্যগণ বলেন, সুস্পষ্ট কোনো দলিল না থাকায় ‘প্রতিটি জিনিসের আসল হলো বৈধতা’ এই নীতির ভিত্তিতে নারীদের গাড়ি চালানোতে কোনো সমস্যা নেই।
তাছাড়া তাদের দৃষ্টিতে সরকার এ বিষয়ে যথেষ্ট সতর্কতার পরিচয় দিয়েছে। এই অনুমতি দানের সঙ্গে আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। আর শর্ত লঙ্ঘন হলে তার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে কঠোর শাস্তি এবং জরিমানা। এই আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় নিয়ম-পদ্ধতি পর্যালোচনার জন্য উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করে ৩০ দিনের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে।
আর ইসলামী শরীয়তের বিধিবিধান ও প্রচলিত আইন অনুসরণ করে এই আইন বাস্তবায়ন করা হবে জানানো হয়েছে। আগামী ১০/১০/১৪৩৯ হি: অর্থাৎ এখন থেকে আরও প্রায় ১০ মাস পরে এই আইন বাস্তবায়ন করা হবে। যাতে করে প্রয়োজনীয় সময় নিয়ে এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো পর্যালোচনা করা যায়।
শায়েখ আলবানী রহ.কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, মহিলাদের গাড়ি চালানো বৈধ কি না? তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, মহিলাদের গাধা বা ঘোড়া চালানো কি বৈধ?
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে মহিলারা উট, গাধা, ঘোড়া ইত্যাদি হাঁকাতে পারলে বর্তমান যুগে মহিলারা গাড়ি হাঁকাতে পারবে না কেন? বরং উট, গাধা ইত্যাদির উপর খোলা থাকে। পক্ষান্তরে বর্তমানে গাড়ি চতুর্দিক থেকে ঢাকা থাকে। সুতরাং এটি তার পর্দা ও আত্মমর্যাদার জন্য আরও অধিক উপযোগী তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সুতরাং মাহরাম ছাড়া সফর, বেপর্দা, সাজগোজ ইত্যাদি শরীয়ত নির্ধারিত বিধানগুলো ফলো করে মুসলিম মহিলা তার প্রয়োজনের স্বার্থে নিজে ড্রাইভিং করতে পারে এতে শরীয়তে কোন সমস্যা নেই।
আরেকটি বিষয় হল, মাহরাম ছাড়া বিদেশি ড্রাইভারের সঙ্গে বাইরে যাওয়ার চেয়ে নিজে শহরের মধ্যে কর্মস্থল, হসপিটাল বা দরকারী কাজে বাইরে যাওয়া অধিক উত্তম নয় কি?
অন্যদিকে উলামা পরিষদেরই অন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এই ফাতওয়ার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তারা ‘অবৈধতার রাস্তা বন্ধ করা জরুরি’ নীতির ভিত্তিতে নারীদের গাড়ি চালানোকে অবৈধ ঘোষণা করেন। কেননা এতে সত্যিই অনেক ফেতনা-ফাসাদের সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অবশ্য যারা ফিতনার আশঙ্কা করছেন তাদের ব্যাপারে উলামা পরিষদের অনুমতি দানের পক্ষের সদস্যগণের বক্তব্য হলো, সৌদি সরকার ইসলামী শরিয়ত এবং প্রচলিত আইন রক্ষার অঙ্গিকার করে থাকলে ইনশাআল্লাহ সমস্যা নেই। আর সমস্যা হলে শরিয়া মোতাবেক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।
সৌদি সরকারও উলামা পরিষদের সদস্যগণের অধিকাংশের মতামত এবং তাদের মধ্যে যারা বিরোধিতা করছেন তাদের যুক্তি এবং এর ইতিবাচক-নেতিবাচক দিকগুলো পর্যালোচনা পূর্বক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। তবে এ মর্মে নিশ্চয়তা দিয়েছে, এ ক্ষেত্রে ইসলামী শরিয়ত এবং প্রচলিত আইন লঙ্ঘন করার কোন সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে নিকট অতীতে গত এপ্রিলে ফাতওয়া দিয়েছিলেন উলামা পরিষদের চেয়ারম্যান শায়েখ আব্দুল আজীজ বিন আব্দুল্লাহ আলে শায়েখ। তিনি বলেন, ‘ফেতনার রাস্তা বন্ধ করা ওয়াজিব। নারীদের গাড়ি চালানো ফেতনার রাস্তা খোলে।’
সৌদি আরবের সাবেক মুফতি এবং উলামা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল আজীজ বিন বাজের এ বিষয়ে প্রাচীন একটি অভিমত রয়েছে। ‘আল লাজনাতুদ দায়েমা লিল বুহুসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতায়িস সাউদি’ এর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘নারীদের জন্য গাড়ি চালানো জায়েজ নয়। কেননা এতে বেগানা পুরুষের সঙ্গে মিশ্রণ ঘটে। তাছাড়া ড্রাইভিং করতে গেলে হাত, মুখ অথবা শরীরের কোনো অঙ্গ উম্মুচিত হয়ে যেতে পারে। আর পর পুরুষের সঙ্গে মিশ্রণ একটি বড় ধরনের ফেতনার কারণ।’
এই ফাতাওয়াটির ওপর স্বাক্ষর রয়েছে শায়েখ আবদুল্লাহ ইবনে কুয়ুদ (উলামা পরিষদের সদস্য), শায়েখ আব্দুল্লাহ ইবনে গদয়ান (সদস্য), শায়েখ আব্দুর রাজ্জাক আফীফী (উলামা পরিষদের উপচেয়ারম্যান), ও শায়েখ আব্দুল আজীজ বিন বাজ (চেয়ারম্যান)।
মিডিয়ায় হঠাৎকরে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়, শায়েখ আব্দুল্লাহ বিন বাজ নারীদের গাড়ি চালানোর ব্যাপারে তার মতাদর্শ পরিবর্তন করেছেন। আর ঠিক তখনই লাজনার পক্ষ থেকে একটি বিবৃতির মাধ্যমে জানানো হয়, শায়েখ বাজ তার আগের মতের ওপরই প্রতিষ্ঠিত আছেন।
উলামা পরিষদের আরেকজন সদস্য শায়েখ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল উসাইমিন। তিনি তার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট বলেছেন, ‘নারীদের গাড়ি চালানোর কারণে যে খারাপ প্রতিক্রিয়া ও ফেতনা সৃষ্টি হয় তাতে তা হারাম হয়ে যায়। তবে গাড়ি চালানোটা হারাম নয়; ফেতনার কারণে হারাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘নারীর গাড়ি চালানোর কারণে যেসব আপত্তিকর বিষয়ের সৃষ্টি হয় তার দাবি হলো, গাড়ি চালানো থেকে নারীকে বাধা প্রদান করা হোক।’
উলমা পরিষদের আরেকজন সদস্য হলেন শায়েখ সালেহ আল-ফাওজান। তিনি বলেন, ‘নারীদের গাড়ি চালানো এমন একটি ভয়ংকর ফাসাদ, যার কারণে সৌদি আরবের মতো রক্ষণশীল দেশে নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দেয়া যায় না।’
তিনি তার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে নারীদের গাড়ি চালানোর নিষেধাজ্ঞার কারণ সম্পর্কে জানতে চাওয়া একটি প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘এই মাসআলায় ওলামায়ে কেরাম কথা বলেছেন, এবং সুষ্পষ্ট জবাব দিয়েছেন। আর তা হলো নারীদের গাড়ি চালানোতে রয়েছে অনেক ক্ষতিকর দিক। আর ‘ক্ষতিকর দিককে প্রতেরোধ করা উপকার আনয়ন করার চেয়ে বেশি অগ্রগণ্য’ নীতির ভিত্তিতে নারীদের জন্য গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, ‘নারীদের গাড়ি চালানোতে ক্ষতিকর দিকগুলো হলো, এতে বোরকা খুলতে হয়। পর পুরুষের সঙ্গে মিশ্রণ ঘটে। বিশেষ করে যখন কোনো দুর্ঘনা ঘটে তখন তো অবশ্যই পর পরুষের সাহায্য চাইতে হয়। এমনকি সাধারণ অবস্থায় ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে কথাবার্তা ও মিশ্রণ ঘটার বিষয়টিও অস্বীকার করার মতো নয়।’
তাছাড়া রাস্তায় গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে তাকে পুরুষদের সহযোগিতা নিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সঙ্গে মিশ্রণ ঘটবে আর এতে করে ফেতনার আশংকা দেখা দেবে।
আরও ক্ষতিকর দিক হলো, নারী গাড়ি নিলে রাত-দিন যখন ইচ্ছা তখনই বের হয়ে যেতে পারবে। কেননা গাড়ির চাবি তার সঙ্গে থাকবে। অপরদিকে গাড়ির ড্রাইভ যদি করেন নারীর কোনো পুরুষ অভিভাবক তাহলে যে কোনো সময় বের হতে পারবে না। কারণ নারীকে ইচ্ছাস্বাধীন ছেড়ে দিলে খারাপ মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
যেমন ইদানিং হচ্ছে। নারী ঘরে বসে বিছানায় শুয়ে বহু মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলছে। কেননা নারীরা স্বাভাবগতভাবেই দুর্বল। অল্পতেই অন্যের প্রতি আকর্ষিত হয়ে যায়।
শায়েখ ফাওজান শুধু নারীদের গাড়ি চালানো নাজায়েজ ফাতাওয়া দিয়েই ক্ষান্ত হননি; বরং তিনি ওইসব শায়েখদেরও কঠোর সমালোচনা করেছেন, যারা এ ব্যাপারে নমনীয়।
যেমন, ড. ইউসুফ আল কারজাভী। তিনি সৌদির প্রয়াত বাদশা আব্দুল্লাহকে গাড়ি চালানোর অনুমতি দানের জন্য আহবান জানিয়েছিলেন।
শায়েখ ফাওজান কারজাভীকে সৌদির আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানোর জন্যও অনুরোধ করেন। তিনি কারজাভীর দলিলগুলোকে তাচ্ছিল্য করে বলেন, তিনি যা লেখেন ও বলেন, ফাতওয়া দেয়ার পূর্বে তা পুনরায় দেখা উচিত।
শায়েখ আব্দুর রহমান আল বাররাক হাফিজাহুল্লাহ যারা নারীদের গাড়ি চালানোর বৈধ্যতার পক্ষে তাদেরকে ‘অজ্ঞদের দল’ মনে করেন। আর নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দান ফেতনার দরজা খুলবে বলেও তিনি মনে করেন।
সূত্র : আরাবি ২১