আরবি থেকে অনুবাদ করেছেন
ইমরান আনোয়ার
মিয়ানমারের আরাকানে মুসলিমদের বিরুদ্ধে চালানো গণহত্যার বিপক্ষে এক ঐতিহাসিক বক্তব্য দিয়েছেন মিশরের গ্র্যান্ড ইমাম, শাইখুল আযহার ডক্টর আহমাদ আত তায়্যিব। বক্তব্যে তিনি রোহিঙ্গাদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পাশাপাশি এ গণহত্যার বিচারেরও আশাপ্রকাশ করেছেন। পড়ুন তার পুরো ভাষণ...
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম। আল আযহার-এর পক্ষ থেকে পাঠ করছি। বিগত কয়েকদিনে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসংখ্য ভীতিজনক ও আতঙ্কজনক ছবি বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করছে। এগুলো সব হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, ঘরবাড়ি থেকে বিতারণ করা, অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যার ছবি; এবং পৈশাচিকতার প্রতিরূপ; যার বলি হয়েছে শত শত নারী, শিশু, যুবক ও বৃদ্ধ। তারা সবাই মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে অবরুদ্ধ হয়ে আছে। সেখানকার শাসকবর্গ নিষ্ঠুর ও বর্বর আচরণের মাধ্যমে তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে; মানবেতিহাস যে নৃশংসতা ইতিপূর্বে দেখেনি।
তাদের কেউ কেউ দীর্ঘ পথচলার ক্লান্তিতে, ক্ষুধার তারণায়, তৃষ্ণায়, এবং প্রখর সূর্যতাপে মৃত্যুবরণ করেছে। কেউ আবার সমুদ্রপথে পালিয়ে যাবার সময় ডুবে মারা গেছে। বিশ্বসম্প্রদায়ের বিবেক যদি না মরে যেত, নেতাগণ বোবা না হতেন; এবং সাথে সাথে সকল মানবীয় বৈশিষ্ট্য আজ ধ্বংস না হলে এই বর্বর ও অমানবিক ঘটনাগুলো ঘটত না।
সকল ন্যায়নীতি, স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের আওয়াজ নিশ্চুপ হয়ে গেছে, এ নিরবতা কবরের নিস্তব্ধতার মত! যে কোনো জাতির মানবাধিকার, নিরাপত্তা ও পৃথিবীতে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার জন্য যে সকল আন্তর্জাতিক চুক্তি রয়েছে এর সবগুলোই আজ কলাপাতার মত মূল্যহীন। বরং এমন মিথ্যায় রূপান্তরিত হয়েছে, যে কালি দিয়ে সেগুলো লেখা হয়েছে সেটারও সমতুল্য তা নয়।
বর্তমানে মুসলিম রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যা করা হচ্ছে তাতে শুধু নিন্দা জানিয়েই ক্ষান্ত হওয়া যাচ্ছে না, বরং যে কসাই পদ্ধতিতে গণহত্যা চালানো হচ্ছে তা সবাইকে জঙ্গলের হিংস্র প্রাণীদের কথা মনে করিয়ে দেয়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো মায়ানমারের সরকার ও সামরিক বাহিনীর হাত থেকে অসহায় মুসলিমদের রক্ষা করতে দ্বিধাজড়িত পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেগুলো কেবলই লোকদেখানো এবং সময়ের অপচয় মাত্র।
আমরা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, এই নাগরিকেরা ইহুদি-খ্রিস্টান কিংবা বৌদ্ধ হলে, অথবা ইসলাম ব্যতিত অন্য যেকোনো ধর্মের হলে এই সকল সংস্থা দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করত।
এই বছরের শুরুতে কায়রোতে যখন মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর একদল যুবক নেতৃবৃন্দকে আল-আজহার আমন্ত্রণ জানায়, যাদের মধ্যে ভিক্ষু এবং ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ সবাই ছিলেন, সেসময় মুসলিম গভর্নর কাউন্সিলের সঙ্গে মিলে আল-আযহার বিবাদমান সকল মতাদর্শগুলোর মাঝে সমন্বয় তৈরি করতে চেষ্টা করেছে। সেটি ছিল এ সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ। তবে মিয়ানমারের বেশ কিছু ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ এই প্রচেষ্টাকে নেতিবাচকভাবে নিয়েছেন এবং তাদের বিবেক তাদের রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে মিলে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর জাতিগত নিধন চালাতে উৎসাহিত করেছে। তাদের এই হিংস্রতা মানবতার বাণীকে কলুষিত করে দেয়।
সকল ধর্মে প্রত্যাখ্যাত এই নিষ্ঠুরতা মিয়ানমারের ইতিহাসে একটি লজ্জাজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে, যা কখনোই মুছে যাওয়ার নয়। পবিত্র আযহারের ধর্মীয় ও মানবিক দায়িত্ববোধের কারণে এবং বৈশ্বিক আবেদনের প্রেক্ষিতে এই অসদাচরণের বিরূদ্ধে আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। অচিরেই আরব ও ইসলামী বিশ্বে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে 'আযহার' মিয়ানমারে চলা এই বর্বরতা বন্ধে তার মানবিক প্রচেষ্টা শুরু করবে।
এই মুহূর্তে আযহার সকল আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছে আবেদন জানাচ্ছে, তারা যেন এই ঘৃণিত অপরাধ তদন্ত করে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করে এবং আন্তর্জাতিক আদালতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাদের বিচারের মুখোমুখি করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়। এবং তারা যে নির্মমতা চালিয়েছে সেটির অভিযোগে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করে।
সবাইকে বুঝতে হবে, এই ধরনের অপরাধই জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের উত্থানের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ। যার ফল ভোগ করতে হয় সকল মানবজাতিকে।
আমরা আজ আরব ও ইসলামের প্রাণকেন্দ্র মিসর থেকে, এবং পবিত্র আযহারের পক্ষ থেকে আরব লীগ, ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের মানবিক আবেদন জানাচ্ছি। বিশেষ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এবং আরব ও ইসলামী নীতিনির্ধারকদের কাছে দাবি জানাচ্ছি, তারা যেন মায়ানমারের নিপীড়িত মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাদের সাধ্যের সবটুকু দিয়ে সাহায্য করেন। যাতে মিয়ানমার সরকারের সুমতি হয় এবং তারা নাগরিকদের মাঝে জাতিগত ও ধর্মীয় বৈষম্য নীতি বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
একজন নোবেলজয়ীর দ্বৈতনীতির কারণে আযহার তার বিস্ময় ও মর্মপীড়া প্রকাশ করছে! যিনি এক হাতে শান্তির জন্য নোবেল গ্রহণ করেন এবং অন্য হাতে সকল অপকর্মকে উৎসাহ দিয়ে যান; যেটি তার রচিত শান্তি প্রতিষ্ঠার বাণীকে ঠুনকো বানিয়ে দেয় এবং সারহীন শব্দে পরিণত করে।
পরিশেষে আমরা আমাদের রোহিঙ্গা ভাইদের বলব, এই নিষ্ঠুর আগ্রাসনের মুখে আপনারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকুন। আমরা আপনাদের পাশে আছি, কখনোই ছেড়ে চলে যাব না। আল্লাহ্ আপনাদের সাহায্য করবেন; নিঃসন্দেহে আল্লাহ দুস্কর্মকারীদের কাজকে মূল্যায়ন করেন না; এবং নিপীড়নকারীরা শিগগির জানতে পারবে তাদের গন্তব্যস্থল কিরূপ!
রোহিঙ্গা শিবিরের হিরো : গাজী ইয়াকুব