আওয়ার ইসলাম : ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর গোরক্ষার নামে বহু নারকীয় কাণ্ড ঘটেছে। একাধিক রাজ্যে গরু জবাই নিষিদ্ধ করাসহ বহু কসাইখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ভারতের পশুহাটগুলোতে গরুমোষের কেনাবেচা বলেতে গেলে পুরোই নিষিদ্ধ।
ফলে মাত্র তিন বছর আগেও যে ভারত বিফ রফতানিতে বিশ্বে শীর্ষস্থানে ছিল, সেই শিল্পে এখন তীব্র হতাশার ছায়া - আর মাংসের জন্য গরু-মোষ বেচতে না-পেরে গ্রামের খামারিরাও প্রবল বিপদে।
ভারতের শাসক দল বিজেপির এই গোরক্ষা নীতি দেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে তা বোঝা গেলো উত্তর ভারতে মোষ কেনাবেচার সবচেয়ে বড় মান্ডিগুলোর একটা - হরিয়ানার ফিরোজপুর ঝিরকার চিত্র দেখে।
উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা আর রাজস্থান - এই তিন রাজ্যের সীমানায় বলে ওই সব মুলুক থেকেই এই পশুহাটে মোষ নিয়ে আসেন ব্যাপারিরা।
কিন্তু কুরবানির ঈদের ঠিক আগে যেমন ব্যস্ত কেনাকেটা পরিবর্তে সেখানে রীতিমতো ভাঁটার টান। গোরক্ষার নামে জুলুমবাজি আর সরকারি নীতির জাঁতাকলে পড়া খামারিদের গলায় প্রবল বিষাদের সুর।
কাছেই চক রঙ্গালা গ্রামের চাঁদ কুরেশি হতাশার সুরে বলছিলেন, সরকার তাদের মতো কিষাণ ও খামারিদের ব্যবসা একেবারে চৌপাট করে দিয়েছে। অনেক কষ্টে, অনেক খরচ করে একটা মোষকে পালনপোষণ করে তারা বিক্রির জন্য আনছেন - কিন্তু বাজারে দাম মিলছে না, কারণ রাস্তায় গুন্ডাবাজির ভয়ে ক্রেতারাই কেউ আসছে না।
আখতার হোসেন পাশ থেকে যোগ করেন, গত দুতিনবছর ধরেই এই জুলুমবাজিটা শুরু হয়েছে - আর তাদের সঙ্গে যেটা চলছে সেটা চরম অন্যায় ছাড়া কিছু নয়।
কেউ কেউ আবার পরিষ্কার বলছেন, বিজেপি যখন থেকে ক্ষমতায় এসেছে তখন থেকেই তাদের এই দুর্দশার শুরু।
তাদের কথায়, ‘পুলিশ আর গোরক্ষক বাহিনীর মধ্যে সাঁট থাকে। আমাদের লোকজন যখনই মাল নিয়ে যায়, তারা মোষের গাড়ি আটকে মারধর শুরু করে দেয়, গাড়ির কাঁচ ভাঙে - পাঁচ বা দশহাজার টাকা পেলে তবেই ছাড় মেলে।’
অল ইন্ডিয়া মিট অ্যান্ড লাইভস্টক এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, অর্থাৎ ভারতের মাংস রফতানিকারকদের সংগঠনের নেতৃস্থানীয় সদস্য ও মুখপাত্র ফাউজান আলাভি অলিগড়ে নিজের কারখানায় বসে দু:খ করছিলেন, ‘এই কাউ ভিজিল্যান্টে-রা আসলে এখন বাফেলো-ভিজিল্যান্টে হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ গোরক্ষকরা হয়ে উঠেছে মোষ-রক্ষক!’
‘অথচ গরুর মতো মোষের কোনও ধর্মীয় মাহাত্ম্য নেই - বরং মোষকে হিন্দুরা মৃত্যুর দেবতা যমের বাহন হিসেবেই দেখে। কিন্তু এখন সেই মোষকে বাঁচানোর নামেও চলছে জুলুমবাজি - আর পশুপ্রেমীরাও যোগ দিয়েছে সেই ব্ল্যাকমেলিংয়ে।’
অর্থনীতিবিদ রতন খাসনবিশ বলেন, এর ফলে দেশের রফতানি যেমন কমছে - তেমনি অকেজো গরু-মোষ মাংসের জন্য বেচতে না-পেরে গরিব কৃষকও কিন্তু বিরাট বিপদে পড়ছে।’
তার কথায়, ‘প্রথমত মাংস রফতানি-কেন্দ্রিক অর্থনীতির আকারটা কিন্তু এ দেশে মোটেই ছোট নয়, উত্তরপ্রদেশের মতো অনেক রাজ্যে তার ওপর বহু লোকের রুটিরুজি নির্ভর করে। কিন্তু এখন সেটা নিরুৎসাহিত হচ্ছে বলেই সেই খাতে বৈদেশিক মুদ্রার আয় ক্রমশ কমছে, আর তথ্যই সে কথা বলছে।’
‘দ্বিতীয়ত এর আর একটা সমস্যা আছে। আর সেটাও শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক। এই গরু-মোষ আপনি যদি মারতে না-পারেন তাহলে দুধ দেওয়া বন্ধ করার পরও সেগুলোকে অকারণে আপনাকে খাইয়ে যেতে হবে, যেটা ব্যক্তিগত বাজে খরচ। অথবা রাস্তায় ছেড়ে দিলে সামাজিক খরচ - সেগুলো উপদ্রব করবে, কেউ হয়তো দয়া করে কখনও খেতে দেবে!’
অর্থনীতিবিদ রতন খাসনবিশ সতর্ক করে দিচ্ছেন, ভারতে একেই পশুখাদ্যের ব্যাপক সঙ্কট আছে - আর এই বিপুল সংখ্যক গরু-মোষ অথর্ব ও অনুৎপাদী হয়ে পড়লে তাদের বাঁচিয়ে রাখাটাই বিরাট এক সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
‘কিন্তু এই মোষও যদি কেনাবেচা না-করা যায়, তাহলে এই শিল্পর সঙ্গে জড়িত লক্ষ লক্ষ মানুষের রুটিরুজিই শুধু বিপন্ন হবে না - বিপদে পড়বেন কৃষকরাও। গবাদি পশুর কেনাবেচায় এত বিধিনিষেধ আসলে একটা কৃষক-বিরোধী নীতি ছাড়া কিছুই নয়!’
ভারতে এখনও যেহেতু ৬০ শতাংশ মানুষ কৃষির ওপরেই নির্ভরশীল, তাই কোনও কৃষকবিরোধী নীতিই শেষ পর্যন্ত টিঁকবে না - এটাই এখন তাদের শেষ আশা।
কিন্তু অর্থনীতিতে মন্দার স্পষ্ট ছাপকে উপেক্ষা করেই বিজেপি এখনও তাদের গোরক্ষার নীতিতেই অটল রয়েছে - আর গরু-মোষ বেচতে না-পেরে পশুমান্ডিতে পড়ছে খামারিদের দীর্ঘশ্বাস!
সূত্র : বিবিসি