আতাউর রহমান খসরু
কুরবানির পশুর চামড়া কওমি মাদরাসার আয়ের বড় একটি উৎস। প্রতিবছর মাদরাসার শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে কুরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করেন। এটাই কওমি মাদরাসার শত বছরের ঐতিহ্য। কিন্তু সম্প্রতি মাদরাসাসমূহ চামড়া সংগ্রহ থেকে বিমুখ হচ্ছে। শহরের অনেক মাদরাসাই ছাত্রদের ছুটি দিয়ে দিচ্ছে ঈদের পূর্বে। কেউ আবার সীমিত করে ফেলছেন তাদের কুরবানির চামড়া সংগ্রহের কার্যক্রম।
কোনো কোনো মাদরাসা ছুটির বিনিময়ে ছাত্রদের বলছে বাড়ি থেকে নিজ পরিবার ও আত্মীয়দের কাছ থেকে চামড়ার টাকা সংগ্রহ করে আনতে।
কিন্তু শত বছরের ঐতিহ্য ‘চামড়া সংগ্রহ’ ছেড়ে বিকল্প আয়ের উৎস কেন চিন্তা করছে মাদরাসাগুলো? কেনো ভিন্ন পথে হাঁটতে হচ্ছে?
ঢাকা ও ঢাকার বাইরের কয়েকটি মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় চামড়ার বাজার মূল্যের পতন কিংবা ইচ্ছাকৃত ধস নামানো, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও মাদরাসাগুলোর সামর্থ্য বৃদ্ধির কারণেই বিকল্প ভাবছে কওমি মাদরাসাগুলো।
কুরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করে কওমি মাদরাসাগুলো অতীতে বড় অংকের টাকা উপার্জন করতো। ২০১৫ সাল পর্যন্ত একটি গরুর চামড়ার গড় মূল্য ছিলো ২২০০ থেকে ২৫০০ টাকা। কিন্তু ২০১৬ সালে তার মূল্য নেমে এসেছে ১২০০ টাকায়। এ বছর চামড়ার গড় মূল্য আরও নেমে যাওয়ার আশঙ্কা করছে কওমি মাদরাসাগুলো।
জামিয়া কারীমিয়া সাঈদিয়া, ভাটার প্রিন্সিপাল হাফেজ মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ এ আর্থিক বাস্তবতার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘চামড়ার মূল্য কমে যাওয়া চামড়া কালেকশন থেকে বিমুখ হওয়ার অন্যতম কারণ। গত বছর আমাদের বলতে গেলে কোনো লভ্যাংশই ছিল না। এজন্য আমরা ছাত্রদের সাধারণভাবে ছুটি দিয়েছি এবং কুরবানির কার্যক্রম সীমিত করে ফেলেছি।’
আর্থিক সামর্থ্য বৃদ্ধি পাওয়াও মাদরাসাগুলোর চামড়া সংগ্রহ থেকে বিমুখ করছে মনে করছেন অনেকে। জামিআ ইকরার সহকারী প্রিন্সিপাল (শিক্ষা) মাওলানা হুসাইনুল বান্না মনে করেন, ‘শুধু চামড়ার বাজার দরপতনই কারণ নয়; এর সাথে এটাও বলতে হবে কওমি মাদরাসাগুলোর বিকল্প আয়ও বেড়েছে। ফলে তারা চামড়া সংগ্রহ থেকে বিমুখ হচ্ছে।’
শুধু চামড়ার আর্থিক মূল্য কমে যাওয়ার সাথে সাথে মাদরাসা-মসজিদ, আলেম-উলামাদের সামাজিক মূল্যায়ন কমে যাওয়া একটি চামড়া কালেকশন থেকে বিমুখ হওয়ার একটি কারণ। কওমি মাদরাসার ছাত্রদের অধিকাংশ এবং শিক্ষকদের বড় একটি অংশ ঈদের দিন চামড়া কালেকশনকে অপমানকর মনে করেন। চামড়া কালেকশন করতে যেয়ে লাঞ্ছনার শিকার হওয়ারও অভিযোগ রয়েছে কারো কারো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার জামিয়া ইসলামিয়া লালমাটিয়ার একজন শিক্ষক আওয়ার ইসলামকে বলেন, ‘চামড়া কালেকশনের বিষয়টি এক সময় উপভোগ করতাম। কিন্তু এখন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেছে। আগে চামড়া সংগ্রহ করতে গেলে বাসায় ঢেকে নাস্তাও করিয়েছে। আর এখন তাদের দৃষ্টিতে থাকে তাচ্ছিল্য। এর সাথে যোগ হয়েছে এলাকা বড় ভাইদের (সন্ত্রাস) উৎপাত।’
সন্দেহ নেই কওমি মাদরাসার আয়ের বড় একটি খাত চামড়া সংগ্রহ বন্ধ হলে মাদরাসার সার্বিক ব্যবস্থাপনার উপর তার বিরূপ প্রভাব পড়বে। তাই মাদরাসাগুলো বিকল্প আয়েরও চিন্তা করছে। বিকল্প চিন্তাগুলোর মধ্যে রয়েছে, মাদরাসার ছাত্রদের উপর টাকার একটি অংক ধার্য করে দেয়া, মাদরাসার হিতাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ বৃদ্ধি ইত্যাদি।
অনুসন্ধান করে জানা যায়, কুরবানির সময় ছাত্রদের ছুটি দেয়া মাদরাসাসমূহে ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত ধার্য করা হয়েছে। যেমন ঢাকার শেখ জনূরুদ্দীন রহ. দারুল কুরআন চৌধুরীপাড়া মাদরাসার ছাত্রদের জন্য ২ হাজার টাকা ধার্য করা হয়েছে। জামিয়া ইকরা ধার্য করা হয়েছে ১ হাজার টাকা। শাইখ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারে ধার্য করা হয়েছে ১ হাজার টাকা।
সাধারণভাবে পরিবারের সাথে ঈদ করতে পারায় শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত খুশি কিন্তু টাকার পরিমাণ নিয়ে তাদের কারো কারো রয়েছে আপত্তি। ছাত্রদের দাবি হলো, সবার উপর একই হারে টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ সব শিক্ষার্থীর সামর্থ্য সমান নয়।
জামিআ ইকরার শিক্ষার্থী মুহাম্মদ সাকিব বলেন, ‘ঈদের সময় পরিবারের খরচ অনেক বেশি থাকে। ঈদের ছুটি শেষে মাসিক খরচের টাকা দিতে হয়। সব মিলিয়ে ঈদের মাসে এক হাজার টাকা দেয়া অনেক পরিবারের জন্য কষ্টকর।’
জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার ছাত্র হাফেজ আবদুর রহীম মনে করেন, ছাত্রদের টাকা বিলম্বে পরিশোধের অবকাশ দেয়া যেতে পারে । একই সঙ্গে তিনি শিক্ষকদের কাছে ছাত্রদের পারিবারিক সামর্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রাখারও অনুরোধ করেন।
কুরবানির সময় কওমি মাদরাসা ছাত্ররা শুধু চামড়া কালেকশন করে না; বরং সামাজিক সেবাও প্রদান করে। এতো বিপুল সংখ্যক পশু জবাই করা এবং তার চামড়ার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা তাদের মাধ্যমেই হয়। কওমি মাদরাসা চামড়া সংগ্রহ বন্ধ করে দিলে একদিকে যেমন আর্থিকভাবে মাদরাসাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে অন্যদিকে মানুষও সামাজিক সেবা থেকে বঞ্চিত হবে। কিন্তু কার ক্ষতির মাত্রা বেশি?
মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ মনে করেন কওমি মাদরাসা চামড়া সংগ্রহ থেকে বিমুখ হলে সমাজের সাধারণ মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তার ভাষায় ‘আল্লাহ তায়ালা কওমি মাদরাসাগুলোকে কোনো না কোনোভাবে চালিয়ে নিবেন কিন্তু সমাজ এতো সুন্দর ব্যবস্থাপনার থেকে বঞ্চিত হবে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি যেটা হবে তা হলো তাদের কুরবানির পশু শরিয়াহ পদ্ধতি অনুযায়ী জবাই করার লোক পাওয়া যাবে না। চামড়ার ভোগান্তি তো আছেই।’
মাওলানা হুসাইনুল বান্না মনে করেন, ‘কওমি মাদরাসা শিক্ষার্থীরা কুরবানির দিন মাঠে না থাকলে সমাজের সাধারণ মুসলমানরা অসুবিধায় পড়বে কোনো সন্দেহ নেই।’
তিনি মনে করেন, ‘সমাজের এ উপলব্ধি আসা প্রয়োজন, মাদরাসার শিক্ষার্থীরা তাদের অনেক বড় সেবা প্রদান করছে।’
সাধারণ মানুষের ভেতর কী কওমি মাদরাসার সামাজিক সেবার এ বিবেচনাবোধ একেবারেই নেই? ঢাকার মুগদা, ওয়ারি, ভাটারা অঞ্চলের কয়েকজন মুসল্লি -যারা এবার কুরবানি দিবেন- তাদের সঙ্গে কথা বললে তারা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
তাদের কেউ স্বীকার করেছেন কওমি মাদরাসা তাদের সেবা দেন, কেউ আবার অস্বীকার করেছেন। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন সেবা দিলেও তা নিঃস্বার্থ নয়। যেমন, মুগদা এলাকার বাসিন্দা জনাব আহাদ আলী চাকরি করেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। তিনি বলেন, কওমি মাদরাসা ছেলেরা আমাদের সেবা করে এটা ঠিক। কিন্তু এখানে তাদের স্বার্থটাই মূখ্য।
তিনি মনে করেন না, কওমি মাদরাসা ছাত্ররা মাঠে না নামলে চামড়া ব্যবস্থাপনায় কোনো সমস্যা হবে। কেননা পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় চামড়ার অনেক মৌসুমি ক্রেতা ঈদের সময় দেখা যায়। তবে তিনি স্বীকার করেন, একজন আলেম কুরবানির পশু জবাই দিলে মনের যে তৃপ্তি পাওয়া যেতো তা পাওয়া যাবে না।
আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার মূল্য না কমলেও দেশি বাজারে চামড়ার অস্বাভাবিক দরপতনকে স্বাভাবিক চোখে দেখছেন না অনেকেই। বিশেষত কওমি আলেমগণ মনে করেন, উচ্চ মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের লালসার খেসারত দিচ্ছে সারা দেশের কওমি মাদরাসাগুলোকে। এর সঙ্গে জড়িত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নেতা ও আমলাগণ। সম্মিলিতভাবে সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই চামড়ার দরপতন ঘটানো হয়েছে।
দেশের প্রবীণ আলেম ও জামিয়া এমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ-এর প্রিন্সিপাল আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ বলেন, ‘আমি মনে করি, চামড়ার দরপতন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দীর্ঘ ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চামড়ার দরপতন ঘটানো হচ্ছে। তারা মূলত কওমি মাদরাসার কোমর ভেঙ্গে দিতে চাচ্ছে। কিন্তু কওমি মাদরাসা আল্লাহর দীনের প্রতিষ্ঠান, আল্লাহই তা রক্ষা করবেন।’
তিনি বলেন, ‘শুধু চামড়া নয়; সামাজিক আয়ের সব পথই বন্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এজন্য কওমি মাদরাসাগুলোর উচিৎ স্থায়ী আয়ের প্রতি মনোযোগ দেয়া।আমার পিতা মাওলানা আতহার আলী রহ. ১৯৫৭ সালে জামিয়া এমদাদিয়া কিশোরগঞ্জের জন্য স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করে গেছেন। আল হামদুলিল্লাহ! জামিয়া এমদাদিয়া তার সুফল ভোগ করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকার আলেমগণ পারেন চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা বসতে। তাদের বোঝাতে পারেন, চামড়া মূল্য কমিয়ে দিলে মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ দেশের সাধারণ মানুষ। যাদের সন্তানরা মাদরাসায় এসে শিক্ষার আলো লাভ করছে। কওমি মাদরাসা আয় কমে গেলে অসহায় দরিদ্র্য মানুষের সন্তানদের কিভাবে শিক্ষাসেবা দিবে কওমি মাদরাসাগুলো?’
সময়ের দাবিতে হোক বা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে হোক কওমি মাদরাসা আয়ের উৎস হিসেবে কুরবানির পশুর চামড়ার সংগ্রহের বিকল্প খুঁজছে এটাই সত্য। আশা করি, তারা হয়তো পেয়েও যাবে। কিন্তু মানুষের ধর্মীয় ও সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যদি আগাম প্রস্তুতিও কি আবশ্যক নয়? আল্লামা আনোয়ার শাহ-এর পরামর্শটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার অনুরোধ রইলো কওমি ধারার নীতি নির্ধারকদের প্রতি।
হাটহাজারী মাদরাসার সব দায়িত্ব থেকে মুনির আহমদকে অব্যহতি