মুফতি মুহাম্মদ শোয়াইব
হজ ইসলামের অকাট্য বিধান। সামর্থ্যবান আল্লাহপ্রেমিকদের প্রেম নিবেদনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে হজ। শরিয়তের অন্যান্য বিধানের মতো হজেরও রয়েছে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, যা লঙ্ঘন করলে হজ ত্রুটিপূর্ণ বা বাতিল হয়ে যায়। হজের ত্রুটি দূর করার জন্য দম বা কোরবানির বিধান রয়েছে, যা ‘দমে জিনায়াত’ নামে পরিচিত। এছাড়াও রয়েছে ‘দমে শোকর’, ‘দমে ইহসার’ ও ‘দমে তাতওউ’। এসব দম বা কোরবানি আদায় করার জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট সময়। যেমন, ‘দমে তামাত্তু’ ও ‘দমে কিরান’ আদায় করতে হয় ১০ জিলহজ মাথা মুন্ডানোর আগে। তবে হাজীরা সহজের জন্য অনেক সময় উকিল বা প্রতিনিধির মাধ্যমে আদায় করে থাকেন। আবার বর্তমানে ব্যাংকের মাধ্যমেও দম আদায় করার প্রচলন দেখা যায়। কিন্তু বাহ্যিক দৃষ্টিতে তা সুবিধাজনক মনে হলেও তাতে সৃষ্টি হয় নানা সমস্যা। ১০ জিলহজ হাজীদের চারটি কাজ করতে হয়। যথা, ১. রমিয়ে জিমার বা কঙ্কর নিক্ষেপ। ২. দম বা কোরবানি (কিরান ও তামাত্তু হজ আদায়কারী হাজীদের জন্য দমে শোকর, যা ওয়াজিব) ৩. হলক করা বা চুল ছাঁটা। ৪. তাওয়াফে জিয়ারত (তাওয়াফে জিয়ারত ১১ ও ১২ তারিখেও করা যায়)।
হানাফি ফিকহ অনুযায়ী ১০ জিলহজের আমলগুলোর মাঝে তারতিব বা ধারাবাহিকতা রক্ষা করা ওয়াজিব। এ আমলগুলোর ধারাবাহিকতা ভঙ্গ হলে দম দিতে হয়। রাসুল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম হজ আদায় করার সময় এ আমলগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) মিনায় আগমন করে ‘জামরাতে’ এলেন। এরপর পাথর নিক্ষেপ করে মিনায় অবস্থিত তাঁবুতে গেলেন এবং কোরবানি করলেন। অতঃপর মাথা মুন্ডনকারীকে স্বীয় মাথা মোবারকের ডান পাশ অথবা বাঁ পাশের দিকে ইশারা করে মাথা মুন্ডানোর নির্দেশ দিলেন। (মুসলিম : ১/৪২১)। এ হাদিসে দেখা যায়, রাসুল (সা.) রমি, কোরবানি ও হলকে ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন।
সাহাবায়ে কেরামও আল্লাহর রাসুলকে অনুসরণ করেছেন। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হজের কোনো কাজ আগ-পিছ করে ফেলেছে, সে যেন একটি দম দেয়।’ (শরহু মায়ানিল আসার : ১/৪৪৭-৪৪৮)। ইমাম সারাখসি (রহ.) বলেন, ‘যদি কেউ হজের কোনো হুকুম অন্যটির আগে করে ফেলে। যেমন, পাথর নিক্ষেপের আগে মাথা মন্ডিয়ে ফেলল অথবা কিরানকারী মাথা মুন্ডানোর আগে কোরবানি করে ফেলল অথবা জবাইয়ের আগে মাথা মুন্ডিয়ে ফেলল তাহলে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মতে দম ওয়াজিব হবে।’ (মাবসুতে সারাখসি : ৪/৪১-৪২)।
ইমাম তাহাবি (রহ.) বলেন, ‘হজের উদ্দেশে গমনকারী ব্যক্তির সামনে যদি এমন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়, যার কারণে তার জন্য হজ করা অসম্ভব হয়ে যায়, তাকে মাথা মুন্ডানোর আগে কোরবানি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কোরবানির আগে মাথা মুন্ডানো সর্বসম্মতিক্রমে নাজায়েজ। আর মুন্ডালে তার ওপর দমে ইহসাব আসবে। দমে ইহসাবের ক্ষেত্রে যদি এ হুকুম হয় তাহলে অন্যান্য ক্ষেত্রেও এ ধরনের হুকুম হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এসব বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায়, ১০ জিলহজের আমলগুলোর মাঝে তারতিব ভঙ্গ করলে দম ওয়াজিব হয়।
ব্যাংকে টাকা জমা দিলে প্রধানত দুইটি সমস্যা সৃষ্টি হয়। ১. যারা ব্যাংক ব্যবস্থাপনা বা ব্যাংকের কোরবানি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত, তাদের দৃষ্টিতে এ আমলগুলোর তারতিব জরুরি নয়। যদি এমন হয়, হজ আদায়কারী হলক করে ফেলেছে অথচ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এখনও তার কোরবানি করেনি, তাহলে তার ওপর ধারাবাহিকতা বিনষ্ট করার কারণে আমাদের মাজহাব অনুযায়ী আরও একটি দম ওয়াজিব হবে। যদিও তাদের মাজহাব অনুযায়ী এটি দোষণীয় নয়। ২. কোরবানির জন্য ব্যাংকে টাকা জমা দিলে ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি স্লিপ দিয়ে দেয়া হয়। তাতে কখন কোরবানি দেবে সে সময় উল্লেখ থাকে। কিন্তু বাস্তবে লিখে দেয়া সময়ে তারা কোরবানি করতে পারে না; বরং অনেক দেরি হয়ে যায়। এদিকে হাজীরা হলক করে ফেলেন। এতে কোরবানি দেয়ার আগেই হলক করা হয়ে যায়, যা আমাদের মাজহাব অনুযায়ী দম ওয়াজিবকারী। তাই বিকল্প ব্যবস্থা থাকলে ব্যাংকে টাকা জমা না দেয়া উচিত।
আর হাজীদের সামনে অনেক বিকল্প রাস্তা খোলা আছে। মিনার মাজবাহ যদিও এখন ৯ থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তর দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে; কিন্তু সেখানে যাওয়া তো যায়। সেখানে গিয়ে নিজের কোরবানি নিজে করার ব্যবস্থা আছে। আল্লাহর অনেক নেক বান্দা তাই করেন। অনুরূপভাবে মক্কা মোকাররমার ‘হালাকাতু কাফিয়া’ নামক জায়গায় পশু কেনার ও জবাই করার ব্যবস্থা আছে। এছাড়াও ‘নাক্কাসা’ থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে পশুর বিশাল হাট রয়েছে। সেখানে যদিও পশু জবাই করার ব্যবস্থা নেই, তবে সেখান থেকে দূরে গিয়ে জবাই করা যায়। এছাড়াও পরিচিত বাঙালি যারা মুকিম আছেন, একটু ফিকির করলেই তাদের বাসায় গিয়ে জবাই করে আসা যায়।
তবে বিকল্প ব্যবস্থাপনা না থাকলে ব্যাংকে টাকা জমা দিলেও সতর্কতামূলক ব্যাংকের দেয়া সময়ের চেয়ে কিছু সময় দেরি করে হলক করা উচিত, যাতে হলক কোরবানির আগে না হয়ে যায়। আরেকটি বিষয় গুরুত্ব দেয়ার মতো তা হলো, আমাদের দেশের অনেক কাফেলা প্রধানের ব্যাপারে কোরবানির টাকা খেয়ানত করার মারাত্মক অভিযোগ আছে। তাই নির্ভরযোগ্য কোনো ব্যবস্থাপনা না থাকলে বা নিজের উদ্যোগে কোরবানি করার সাহস না থাকলে ব্যাংকে টাকা জমা দেয়াই নিরাপদ। তবে সে ক্ষেত্রে উপরের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করলে আশা করা যায় কোনো সমস্যা হবে না।