সাকিব মুস্তানসির
আলেম ও বস্ত্র প্রকৌশলী
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানিয়েছে, বর্তমানে দেশে খামারের সংখ্যা প্রায় সোয়া পাঁচ লাখ। দেশে এখন গরু আছে ২ কোটি ৩০ লাখ। এর একটি বড় অংশ গাভি ও কম বয়সী। জবাই উপযোগী গরু আছে প্রায় ৪০ লাখ, ছাগল আছে ২ কোটি ৬০ লাখ, ভেড়া আছে ৩৪ লাখ ও মহিষ আছে ১৫ লাখ । কুরবানির উপযোগী গরু আছে ৪০ লাখ, মহিষ ১৫ লাখ, আর ছাগল-ভেড়া আছে প্রায় ৭৬ । সূত্র: আমাদের অর্থনীতি-১৯ আগস্ট-২০১৭ ।
এবার আসেন কিছুক্ষণ পরিসংখ্যান নিয়ে ঘাটাঘাটি করি
৫৫ লাখ গরু মহিষের ৭০ ভাগের বেশি আসে বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবার থেকে যাঁদের কুরবানিতে কন্ট্রিবিউশন মাত্র একটি বা দুইটি গরু বা মহিষ । সে হিশেবে প্রায় ৩৯ লাখ গরু মহিষের সাথে জড়িয়ে আছে প্রায় ৩৯ লাখ পরিবার। ৩৯ লাখ পরিবারে সদস্য সংখ্যা কতো? ধরেন প্রতি পরিবারে যদি ৫ জন করে সদস্য থাকে তবে সদস্য হয় ১ কোটি ৯৫ লাখ মাত্র। এর সাথে যোগ করুন ৭৬ লাখ ছাগল-ভেড়ার সাথে জড়িয়ে থাকা আরো প্রায় ৫০ লাখ লোক।
দেশের প্রায় আড়াই কোটি জনগণ জড়িয়ে আছে কুরবানির পশুর সাথে। জড়িয়ে আছের এঁদের স্বপ্নও।একটু ভালো করে বাঁচার স্বপ্ন। দুমুঠো ভাতের স্বপ্ন। একটা নতুন জামার স্বপ্ন। ফুটো হওয়া ঘরের চালে একটা নতুন চালের স্বপ্ন। ভেঙ্গে যাওয়া ঘরের দেয়ালে একটা নতুন বেড়ার স্বপ্ন। স্কুলের ফি, পরীক্ষার ফিস জমা দেয়ার স্বপ্ন। বোনের বিয়ের স্বপ্ন।ছেঁড়া-ফাঁড়া কাপর পরা গৃহবধূর নতুন শাড়ির স্বপ্ন। এমন হাজারো স্বপ্নে কুরবানির পশুকে ৩৬৪ দিন আদর যত্নে পেলে বড় করে তুলেছে এই পরিবার গুলো। কুরবানির সময় এলে ভালো দামে বিক্রিকরে নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করবে বলে।
যারা গরু পালন করেন তারাই জানেন একটা প্রাণীকে উপযুক্ত করে তুলতে কতটা কষ্ট ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। নিজেরা গরমে কষ্ট করে প্রাণীর উপরে ফ্যান দিয়ে রাখা এখন আর আলোচিত কোন ঘটনা নয়। নিজেরা অপুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করলেও পোষা প্রাণীটিকে ঠিকই নিয়মিত পুষ্ঠিকর খাবারের যোগান দিয়ে যায় অধিকাংশ পরিবার। অনেক পরিবার নিজেদের পাতিলের ভাত পর্যন্ত দিয়ে দেয় চাড়িতে। নিজেদের ঘরে বৃষ্টি এলেই পানি পড়ে অথচ প্রাণীটিকে আগলে রাখে সযতনে শুধুমাত্র এই একটি দিনের জন্যই।
কুরবানির সময় এলে ন্যায্য দামে বিক্রয় করে নিজেদের সব অপুর্ণতা দূর করবে।দরিদ্র মানুষের অর্থনিতি অনেকাংশেই জড়িয়ে আছে কুরবানির সাথে। এই প্রাণীটা বিক্রয় করতে না পারলে এই পরিবার কতটা সংকটে পরবে ভেবে দেখেছেন!!অতিরিক্ত একটা বছর গরু রাখা একটা মানুষ পালার চেয়েও ব্যয় বহুল ও কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ঈদের পর প্রতি বছরই বাজার পরেযায় তখন এই লোকগুলোকে বিশাল লস দিয়ে গরু-মহিষ বিক্রয় করতে হবে যা তাঁদের স্বপ্ন আশা–আকাঙ্ক্ষাকে ধূলিস্মাত করে দিবে।
এবার আসুন বন্যার্তদের কথায়
বাংলাদেশে বন্য প্রায় প্রতি বছরের ঘটনা। এটা আকস্মিক কোন বিপর্যয় নয়। এটার জন্য রাষ্টের আলাদা একটা মন্ত্রণালয় রয়েছে। আছেন মন্ত্রি/প্রতিমন্ত্রী , সচিব আমলা ছাড়াও প্রতিটি জেলা ভিত্তিক আলাদা সেল রয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বিশাল বাজেট আছে দুর্যোগ মোকাবেলায়। আছে দেশ বিদেশ থেকে প্রাপ্ত বিশাল বিশাল অংকের ডোনেশন।আপনারা রাষ্ট্রকে চাপ দিন, বাধ্য করুন যেন উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয় কেননা রাষ্ট্র আপনার ভ্যাটের টাকা দিয়েই কার্যক্রম চালায়। তাঁরা যেটা দিবে সেটা আপনার টাকাই।
সরকারি ব্যাবস্থাপনা ছাড়াও প্রতি বছরই দেশি বিদেশী হাজারো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বন্যা দুর্গতদের নিয়ে কাজ করে এবারো করছে আলহামদুলিল্লাহ।যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু হয়তো হচ্ছেনা তবে যা হচ্ছে তা একেবারে কমও নয়। দেশের সকল লোক মাত্র ১ টাকা করে দিলেই এই সংকট পুরুপুরি যথাযত ভাবে কাটিয়ে উঠা সম্ভব। যেই কাজটা সকলের মাত্র ১ টাকা দিয়েই সমাধান সম্ভব তার জন্য আড়াই কোটি মানুষের স্বপ্ন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার চেষ্টা প্রশ্ন সাপেক্ষ বটে! আপনাকে প্রশ্ন করতেই হবে এখানে কি আদৌ দান করা উদ্দেশ্য না কুরবানি বন্ধ করাই ফ্যাক্টর !!
বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতি এতোটা ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করেনি যে দেশের সবাই সব ছেড়ে-ছুড়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে বা হচ্ছে । দেশের সব কাজই যথারীতি চলছে। সকল ধর্মের সকল ধর্মিও আচারও যথাযথ পালন করা হচ্ছে কোন সমস্যা হচ্ছেনা আলহামদুলিল্লাহ্ । আল্লাহর কাছে দোয়া করি এমন পরিস্থিতি যেন কখনও সৃষ্টি না হয়। যদি কখনো এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় তবে আমাদের বিজ্ঞ মুফতি সাহেবানরা জানাবেন করণীয় সম্পর্কে।এটা নিয়ে সেক্যুলারদের নাক না গলালেও চলবে মনে হয়।
কুরবানি না করে এর টাকা যারা বন্যার্তদের দিতে বলছেন তাদের কথা শুনতে যতই মিঠা মনেহোক এর পেছনে রয়েছে ভয়াবহ তিক্ত ও বিষাক্ত একটা উদ্দেশ্য। সানি আর মৌসুমির সম্মিলিত সম্পদ ২০/২৫ কোটি টাকার কম হবে না । উনাদের যদি এতোই দরদ থাকতো তবে কুরবানির ১ লক্ষ টাকা দান না করে ৮/১০ কোটি টাকা দান করে দিলেই পাড়তেন! ১০ কোটি টাকা দিয়ে দিলেও আরো ১০/১৫ কোটি টাকা থাকবে যা তাঁদের জন্য যথেষ্ট !! বাস্তবে কিন্তু তা করবেন না এমন কি যেই টাকার কথা বলেছেন তাও দিবেন বলে মনে হয় না ! এসব শুধুই মিডিয়ায় ফোকাসড আর সেক্যুলারদের দৃষ্টি আকর্ষনের ধান্ধা ।
সাধারণ ও অল্পশিক্ষিত মুসলমানদের কুরবানি থেকে ফিরিয়ে রাখতে সেক্যুলারদের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিং এর এই পদ্ধতি আজকের আবিষ্কার নয়! স্বাধীনতার সময় থেকেই চালিয়ে আসছে।কুরবানি সামনে এলেই একেক সময় একেক ছুতো আবিষ্কার করে বাংলাদেশের উচ্ছিষ্টভোগী সেক্যুলার ও বাপ বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। এঁদের হুক্কা হুয়ায় শেয়ালের মত কেয়া হুয়া বলে সুর মেলার কিছু ইসলাম বিদ্বেষী ধর্মদ্রোহী আর কিছু অবুঝ মুসলমান !
অনেক আগেই এই রোগের পোস্টমর্টেম করেছেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ আলী আহসান– ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ঈদুল ফিতর উদযাপন করলাম কলকাতায় এবং ঈদুল আযহা উদযাপন করলাম স্বাধীন বাংলাদেশে। এ সময় ধর্মনিরপেক্ষতার স্বপক্ষে নানাবিধ বিবৃতিদাতার উদ্ভব হলো। একটি বিবৃতি ছিল সে বছর কুরবানির বিরুদ্ধে। বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধে যেহেতু বহু প্রাণহানি ঘটেছে, সে আত্মত্যাগই কুরবানির শামিল।সুতরাং নতুন করে কুরবানির নামে প্রাণী হত্যা করা সমীচীন নয়। আমারও অনুরূপ মনে হয়েছিল। পত্রিকায় এ বিবৃতি দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসহাক আমার সাথে দেখা করে বললেন, আলী আহসান সাহেব, কুরবানির কোন বিকল্প নেই। যার উপর কুরবানি ফরজ (ওয়াজিব) তাকে কুরবানি দিতেই হবে। দেশের জন্য মানুষের যে আত্মত্যাগ, সেটার সম্মান আল্লাহ তায়ালা করবেন, আত্মত্যাগকে কুরবানির বিকল্প হিসেবে কখনই ধরা যাবে না। ইসহাক সাহেবের কথায় আমার চৈতন্যোদয় হলো। আমি সে বছর কুরবানি দিয়েছিলাম। এভাবে দেখতে পেয়েছি,আওয়ামী বুদ্ধজীবিরা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মের অপব্যাখ্যা করেছে এবং ধর্মাচরণের বিকল্প উদ্ভাবনের প্রয়াস পেয়েছে।
(ধর্মনিরপেক্ষতা এবং আমি, আমার সাক্ষ্য, ঝিঙেফুল ২০০৩, পৃ. ৩৬)''
কুরবানির অর্থ শুধু ত্যাগ না বরং মনের ভেতরে কুরবানি না দেয়ার যে ইচ্ছা জাগ্রত হচ্ছে তাকে দমন করে কুরবানির ওয়াজিব আদায় করাটাও।