ধর্ম মন্ত্রণালয়ের গঠন করা ১৭১ জনের হজ চিকিৎসকদের সহায়তাকারী দলে এমন সব কর্মকর্তা-কর্মচারী নেওয়া হচ্ছে, যাঁদের অনেকেই এই কাজের উপযোগী নন। তালিকায় ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানের নির্বাচনী এলাকা ময়মনসিংহের ৩৫ ব্যক্তি হজ চিকিৎসকদের সহায়তা দলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, যাঁরা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত।
ওই দলে আরও রয়েছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী ও সংস্থার ২৫ জন গাড়িচালক। এ ছাড়া আছেন নিরাপত্তাকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, অফিস সহায়ক, পাম্প অপারেটর, টাইপিস্টসহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কৃষিবিদ ও ফার্মাসিস্টরাও যাচ্ছেন এই দলের সদস্য হয়ে।
সৌদি আরবে অবস্থানকালে হজযাত্রীদের চিকিৎসকদের সহায়তা করতে এই ১৭১ জন যাওয়া-আসার বিমানভাড়াসহ যাতায়াত ভাতা ও দৈনিক ভাতা পাবেন পদ অনুযায়ী ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা করে।
নিয়মানুযায়ী সহায়ক দলে ধর্ম মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সেবক এবং অফিস সহকারীদের যাওয়ার কথা। মূলত তাঁদের কাজ হচ্ছে অসুস্থ হাজিদের সেবা করা, ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করাসহ বিভিন্ন কাজে সহায়তা করা। কিন্তু এই দলে যাঁদের নেওয়া হচ্ছে, তাঁদের অনেকেই এসব কাজ করবেন না।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, প্রতিবছরই হজ সহায়ক দল ও গাইড হিসেবে পছন্দের লোকজনকে সৌদি আরবে পাঠানো হয়। তাঁদের অনেকেই হাজিদের সেবা দেন না। সহায়তাকারী হিসেবে যাঁদের পাঠানো হয়, তাঁদের খোঁজ না পাওয়ার অভিযোগও বেশ পুরোনো।
সম্প্রতি ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে হজ চিকিৎসক দলের সদস্যদের তালিকা প্রকাশ করে অফিস আদেশ জারি করা হয়েছে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (হজ) মো. শরাফত জামান স্বাক্ষরিত ওই আদেশে বলা হয়, ২০১৭ হজ মৌসুমে সৌদি আরবে অসুস্থ বাংলাদেশি হজযাত্রীদের চিকিৎসাসেবা দিতে এবং চিকিৎসক দলকে সহায়তা করতে হজ সহায়ক টিম গঠন করা হয়েছে।
অসুস্থ হাজিদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ১১৪ জন চিকিৎসক, ৯৭ জন নার্স ও ব্রাদার, ৪৩ ফার্মাসিস্ট ও ১২ টেকনিশিয়ানের টিম সৌদি আরব যাচ্ছেন। তাঁদের সহায়তা করতেই ১৭১ জনের ওই সহায়ক দল গঠন করা হয়।
কারা যাচ্ছেন
তালিকায় ময়মনসিংহের বাসিন্দারা হলেন মন্ত্রীর দপ্তরের কর্মকর্তা (প্রাধিকারপ্রাপ্ত) রাজু জমাদান, সাজ্জাদ হোসেন ও বুলবুল আহমেদ, ময়মনসিংহ জেলার বিশেষ শাখার কর্মকর্তা আল আমিন, ময়মনসিংহ পৌরসভার জোন সুপারভাইজার সারোয়ার আলম, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব খামার শাখার কর্মকর্তা আনিছুর রহমান, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অফিস সহায়ক মো. সাজু, সফিকুল ইসলাম, রাজা মিয়া, সাইফুল ইসলাম সুমন, গোলাম মোস্তাফা মুক্তা, অফিস সহকারী সোহেল রানা, অফিস সহায়ক আফজাল হোসেন, কামরুজ্জামান, বাবুল মিয়া, ফিরোজুল হক, আব্বাস আলী, হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মী কামরুল হাসান, পুলিশ লাইনের ফরিদ উদ্দীন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের আবদুল মান্নান, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের এস এ এ সৈয়দ আওলাদ হোসেন, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্পেন্টার নাজমুল হক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস সহকারী মাহফুজা খাতুন প্রমুখ।
ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান বলেন, ‘আমাদের কাছে ময়মনসিংহের যাঁরা আবেদন করেছেন, তাঁদের নিয়ে যাচ্ছি।’ গাড়িচালকদের নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, অনেক দপ্তর অনুরোধ করেছে, এ ছাড়া অনেকে পরিচিত, তাই তাঁদের নেওয়া হচ্ছে।
নীতিমালা অনুযায়ী ধর্ম মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন মিলে এই তালিকা করার কথা। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যাঁদের নাম সুপারিশ করেছিল, তাঁদের বদলে পছন্দের লোক নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘চিকিৎসক দলে সহায়তাকারী নির্বাচনের জন্য আমরা প্রতিবারই ধর্ম মন্ত্রণালয়ে তালিকা পাঠাই। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের পাঠানো তালিকা বাদ রেখে নানা রকম অনিয়মের মাধ্যমে লোক নেওয়া হয়।’ তাঁর প্রশ্ন, হজ সহায়তাকারী হিসেবে চালক বা নিরাপত্তাকর্মী কোন কাজে আসবে? যাঁদের এসব কাজে অভিজ্ঞতা বা সংশ্লিষ্টতা নেই, তাঁদের নেওয়ার কারণ সবাই বোঝে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এবারও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৫ জনকে সহায়তা দলে রাখা হয়েছে। আমি ধর্ম মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দিয়েছি, এঁদের ছাড়পত্র দেওয়া হবে না।’
এদিকে হজ সহায়তাকারীর তালিকায় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ কে এম সালাউদ্দিন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব আজিজুর রহমান তালুকদার, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের গ্রেইনার কামরুউদ্দিন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক মো. বজলুল ইসলাম, শ্যামলী টিবি হাসপাতালের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. শাহ আলম, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সহকারী সচিব রুহুল আমিন মল্লিক, ওয়াকফ প্রশাসক কার্যালয়ের পরিদর্শক ইউসুফ আলী, নারায়ণগঞ্জ পুলিশ লাইনসের এসআই মো. আনোয়ার হোসেন প্রমুখ।
এ ছাড়া আছেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দপ্তরের অফিস সহকারী ইকবাল হোসেন মোল্লা ও মহিবুর রহমান, সচিবের দপ্তরের অফিস সহায়ক খোরশেদ আলী, অতিরিক্ত সচিবের দপ্তরের অফিস সহায়ক আবদুল জব্বার, প্রমোশন শাখার অফিস সহায়ক আশরাফুল আলম, উপসচিবের অফিস সহায়ক আবুল বাসার, যুগ্ম সচিব হজ দপ্তরের অফিস সহায়ক মহসিন মোল্লা, সংস্থা শাখার অফিস সহায়ক রোকসানা আক্তার, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অফিস সহায়ক আশরাফুল ইসলাম, পরিবহন পুলের অফিস সহায়ক সালমান ইসলাম ও গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পাম্প অপারেটর নজরুল ইসলাম। আরও আছেন বিরোধীদলীয় নেত্রীর গানম্যান কোরবান আলী।
তালিকায় ধর্ম, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার, রেল, প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের একজন করে গাড়িচালকের নাম আছে। এ ছাড়া আছে পরিবহন পুল ভবন ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দুই গাড়িচালকের নাম।
সহায়ক দলে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের দপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুস সাত্তার, স্বরাষ্ট্রসচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা আবদুর রউফ, স্থানীয় সরকার বিভাগের সহকারী প্রধান মোদাচ্ছের বিন আলী, উত্তরা এপিবিএনের সারওয়াত হোসেন, নেত্রকোনার খালিয়াজুরির কনস্টেবল মনোয়ার হোসেন, ভূমি প্রশাসন ট্রেনিং সেন্টারের ব্যক্তিগত সহকারী আলতাফ মাহমুদ, ডেপুটি স্পিকারের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা নুরুল আমিন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মমিনুল হক এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মুহাম্মদ শহিদ উল্লাহ ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর গানম্যান এএসআই কুরবান আলী সহায়ক দলের সদস্য হয়েছেন। তালিকায় আছেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মো. ওমর ফারুক।
জানতে চাইলে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল জলিল বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, বিভিন্ন মন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সুপারিশে এই তালিকা করা হয়েছে। সুপারিশ বা তদবিরের বাইরে মন্ত্রণালয় কাউকে নেয়নি।
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বা প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের কেন সহায়ক দলে নেওয়া হয়েছে, তাঁরা কী সহায়তা করবেন জানতে চাইলে সচিব বলেন, সব ধরনের লোকই প্রয়োজন হয়। গাড়িচালকেরা কী করবেন—এর জবাবে তিনি বলেন, এসব মন্ত্রী মহোদয় অনুমোদন করেছেন। মন্ত্রীর এলাকার ৩৫ জনকে নেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সচিব বলেন, নেওয়া হচ্ছে ঠিক, তবে কেন নেওয়া হচ্ছে, তা মন্ত্রী মহোদয়ই বলতে পারবেন।
-এজেড