"ওদের ছেলেপেলে যে আসছে সে মারছে। আমাদের চারঘণ্টা ধরে নির্যাতন হইছে। মারতে মারতে ওরা হাপায় যায়। ৫ মিনিট করে মারে ৫ মিনিট করে বসে। পরে আম্মুকে আলাদা রাখছে আমাকে আলাদাভাবে একটা রুমে নিয়ে যায়। ওখানে দশ-বার জন ছেলে ছিল। আশা আর রুমকি ছিল। ছেলেদেরকে বলে তোরা কী করবি কর। আজকেই সুযোগ"।
বিবিসি বাংলার কাছে নির্মম এ অত্যাচারের বিবরণ দিয়েছে বগুড়ায় নির্যাতনের শিকার ছাত্রী। তার অভিযোগ ধর্ষিত হওয়ার ১০-১২দিন পরে অভিযুক্ত ব্যক্তির স্ত্রীসহ স্থানীয় নারী কাউন্সিলর তাদের ওপর এ নির্যাতন চালায়।
মেয়েটির অভিযোগ এরকম নির্যাতনের পর তার এবং তার মায়ের চুল কেটে মাথা নেড়া করে দেয়া হয়। বলা হয় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এলাকা ছাড়তে। তার প্রশ্ন "আমি এখন কিভাবে মুখ দেখাবো?"
হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় চিকিৎসাধীন মেয়ে ও তার মায়ের মাথা নেড়া। মেয়েটির হাতে পায়ে আঘাতের কালসিটে দাগ পড়ে আছে। সে জানায় শরীরের বিভিন্ন জায়গায় এসএস পাইপ দিয়ে পিটিয়ে জখম করা হয়েছে। মেয়েটি জানায়, যেখানে দেখানো যায় সেখানে মারেনি।
এ ঘটনা ঘটেছিল ২৮ জুলাই। তবে আরো বড় অভিযোগ হলো দু সপ্তাহ আগে কলেজে ভর্তি করিয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের শিকার হয় এবছর এসএসসি পাশ করা এ কিশোরি। যার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ সে বগুড়া জেলা শ্রমিক লীগের শীর্ষস্থানীয় একজন নেতা। কলেজে ভর্তির কাগজপত্র নেয়ার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে তাকে বাড়ি ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়।
অভিযুক্ত ব্যক্তির স্ত্রীও স্বজনদের হাতে ২৮ তারিখে মা ও মেয়ে নির্যাতনের শিকার হলে ধর্ষণের ঘটনাটি প্রকাশ হয়। তার আগে বিষয়টি সবার কাছে গোপন ছিল। নির্যাতনের শিকার মেয়েটির দাবি তাকে হুমকি ও ভয় দেখানো হয়েছে তাই লোকলজ্জা আর ভয়ে আতঙ্কে বিষয়টি সে চেপে যায়।
"কী বলবো আমরাতো পারবো না। আর পুলিশ প্রশাসন যে আমাদের এইভাবে দেখবে আমরাতো সেটাও জানি না।"
মেয়েটির কাছে জানতে চাই কী কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তির স্ত্রী তাদের এ অবস্থা করলো। নির্যাতনের সময় কী বলেছিল তারা? বক্তব্যে মেয়েটি জানায়- "ওর বউ ধর্ষণের ঘটনা জানার পর আমাদের বাসায় তালা দিছে। আমরা ঢাকায় ঘুরতে গেছিলাম। আমরা বাড়ী আসার পর পাড়ার লোকের সামনে আমাদের চুরির বদনাম দিয়ে মারছে। ও বলে আমিই সব করছি। ওর স্বামীর কোনো দোষ নাই।"
মেয়েটির সঙ্গে অভিযুক্ত ধর্ষণকারীর পূর্বে যোগাযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে সে জানায়, রিকশা থামিয়ে ধর্ষণকারীর এক সহযোগী একদিন তার ফোন নম্বর চায়। ভুল নম্বর দিয়ে রেহাই পেলেও অভিযুক্ত ব্যক্তি তার প্রকৃত নাম্বার সংগ্রহ করে ফোন করে। আর তাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দেয়ার কথা বলে তাদের মধ্যে যোগাযোগ সৃষ্টি হয়। মেয়েটির দাবি এক পর্যায়ে অভিযুক্ত ব্যাক্তি তাকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছে।
মা-মেয়েকে আটকে রেখে নির্যাতনের এই ঘটনা ব্যাপক প্রচার পায় বিশ্ব গণমাধ্যমে
"অনেকদিন আগে থেকেই আমাকে বিয়ে করতে চাইছে। আমি বলছি না। আমি কেন বিয়ে করবো। ওর একটা ছেলে আছে। বউ আছে। আমি কেন একজনের সংসার ভাঙবো। আমাকে বলা হইছে কিন্তু আমি রাজী হইনি।"
"কে জানাইছে জানি না। ফোনে আমাকে নির্যাতনের শিকার হয়ে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায়ও বেনামে টেলিফোনে তাকে অভিযুক্ত ধর্ষণকারীর সঙ্গে বিয়ের কথা বলা হয়েছে। জানাইছে। বলছে ও তোমাকে বিয়ে করতে চাইছে, পুলিশের চাপের জন্য না। তুমিতো জানো সে তোমাকে আগে থেকেই বিয়ে করতে চাইছে। এখন সে চাচ্ছে যে ওর জন্য যেন তোমার কোনো ক্ষতি না হয়। তুমি যেভাবে বলবা সেভাবেই হবে।"
এ প্রস্তাবের জবাবে কী বলেছে জানতে চাইলে মেয়েটি বিবিসিকে বলেন, "এরকম কিছুই ভাবছি না।"
পুলিশ জানাচ্ছে বগুড়ার ঘটনায় আটক একজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। তবে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা সবাই আটক ও রিমান্ডে থাকায় কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। আসামী পক্ষের স্বজনরাও কেউ কথা বলছেনা।
প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, "অভিযুক্ত নারীর স্বামীর সাথে ঘটনাটি ঘটেছে জুলাইয়ের ১৭ তারিখে। স্বামীর সহযোগীর কারো মাধ্যমে সে বিষয়টি জানতে পারে তখন থেকেই এই মেয়ের ওপর তার আক্রোস বাড়তে থাকে। এবং সে এরকম ঘটনা ঘটানোর পরিকল্পনা করে তার বোন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সাথে পরামর্শক্রমে।"
এদিকে এ ঘটনা জানাজানির পর বগুড়াসহ সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইন পত্রপত্রিকায় খবরটি ব্যাপক প্রচার হয়। দুএকটি জায়গায় মেয়ে ও মায়ের চেহারাও প্রকাশ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় মেয়েটির মা বলছেন এখন সবাই পাশে আছে কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত।
"যেভাবে ফিজিক্যালি ব্যবহার করছে তাতেতো আমি সমাজে মুখ দেখাতে পারছি না। করুণ হাল হয়ে গেছে আমাদের। আমরা কি এখন কোথাও মানসম্মান পাবো?" এ প্রশ্ন নির্যাতনের শিকার মেয়েটির মায়ের।
প্রথমে ধর্ষণ; পরে মা মেয়ের মাথা ন্যাড়া করে নির্যাতন