রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


প্রথমে ধর্ষণ; পরে মা মেয়ের মাথা ন্যাড়া করে নির্যাতন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

বগুড়ায় সদ্য এসএসসি পাস এক ছাত্রী ও তার মাকে ন্যাড়া করে বর্বরভাবে নির্যাতনের ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত বগুড়া পৌরসভার নারী কাউন্সিলর মার্জিয়া হাসান রুমকি, তার মা রুমি ও ছোট বোন আশা এবং তাদের অন্যতম সহযোগী মুন্নাকে ঘটনার ২ দিন পরেও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তবে এ ঘটনায় গ্রেফতার শ্রমিকলীগের শহর কমিটির আহবায়ক তুফান সরকারসহ গ্রেফতারকৃত ৪ জনকে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ১ জন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করেছে।

এদিকে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নির্যাতিতা মা-মেয়ের নিরাপত্তায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ধর্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে আজ রবিবার নির্যাতিত ছাত্রীর ডাক্তারি পরীক্ষা করা হবে।

যেভাবে ঘটনার শুরু
নির্যাতিদের ভাষ্য মতে, শহরের চকসুত্রাপুর বেগম বাজার লেন এলাকায় মেয়েকে নিয়ে ভাড়া বাসায় বসবাস করেন নন্দীগ্রাম উপজেলার আতাইল গ্রামের ইয়াকুব আলীর স্ত্রী মুন্নি বেগম। এর আগে তিনি ঢাকায় একটি গার্মেন্টসে চাকুরী করতেন। তখন তার মেয়ে চকসুত্রাপুরে কাউন্সিলর রুমকির বাড়ির কাছে নানার বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করতো। পরে তিনি বগুড়ায় ফিরলে মেয়ের শিক্ষা গ্রহণের সুবিধার্থে মা মেয়ে শহরের ভাড়া বাসায় উঠেন। তার একমাত্র মেয়ে সোনারী আকতার চলতি বছর স্থানীয় জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বাণিজ্য বিভাগে এসএসসি পাশ করেছে। বাসা থেকে শহরে যাওয়া আসার পথে শ্রমিকলীগ নেতা তুফান সরকারের বন্ধু আলী আজম দিপু মাঝে মধ্যে সোনালীকে উত্যক্ত করতো। একদিন রিক্সা থামিয়ে মোবাইল নম্বর দাবি করে।

সোনালী বুদ্ধি করে ভুল নম্বর দেয়। এর বেশ কিছুদিন পর সে সোনালীর নম্বর সংগ্রহ করে ফোন করে। তখন সোনালী এসএসসির ফলাফল আশানুরূপ না হওয়ায় সে ভালো কলেজে ভর্তি হবার সুযোগ বঞ্চিত হচ্ছে– এই আশংকার কথা জানায়। তখন দিপু তাকে তুফানের মাধ্যমে ভর্তি করিয়ে দেবার আশ্বাস দেয়। ভালো কলেজে ভর্তির জন্য ৪ হাজার টাকা ও কাগজপত্র জমা নেয় দিপু। পরবর্তীতে সোনালীকে কলেজে ভর্তিতে সহযোগিতার আশ্বাস দিলেও টাল বাহানা করতে থাকে। এর একপর্যায়ে শহরের চকযাদু রোডে অবস্থিত তুফান সরকারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তূর্য স্যানিটারি স্টোরের সামনে সোনালীর সাথে তুফানের কথা হয়। তুফান তাকে ভর্তি করে দেবার আশ্বাস দেয়। ১৭ জুলাই তুফানের বন্ধু আতিক কৌশলে ভর্তির জন্য কথা বলার প্রয়োজন বলে সোনালীকে তুফানের বাসায় নিয়ে যেতে আসে। প্রথমে সোনালী আপত্তি জানালেও পরে তুফানের পাঠানো প্রাইভেটকারে ড্রাইভার জিতুর সাথে তুফানের চকসুত্রাপুরস্থ চামড়াগুদাম এলাকার বাসায় যায়। তখন তুফান সোনালীকে ধর্ষণ করে। এসময় তার সহযোগী দিপু, আতিক ও রূপম, মুন্না, গাড়ী চালক জিতু পাহারা দেয়। বিষয়টি কাউকে না জানাতে হুমকিও প্রদর্শন করে। ফলে পরদিন ১৮ জুলাই মায়ের সাথে ঢাকায় চলে যান ।

এদিকে তুফানের বন্ধুদের মাধ্যমে বিষয়টি তুফানের স্ত্রী আশা বিষয়টি জানতে পেরে ক্ষিপ্ত হয়। সে তার বড় বোন স্থানীয় নারী কাউন্সিলর রুমকিকে বিষয়টি জানায়। অভিযোগ তোলে, সোনালী তুফানের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এই অভিযোগে ১৮ জুলাই বিকেলে কাউন্সিলর রুমকি শহরের চকসুত্রাপুর বেগম বাজার লেনে সোনালীদের ভাড়া বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে দেয়। একই সাথে কাউন্সিলরের বাড়ির পাশে অবস্থিত সোনালীর নানার বাড়ীতেও হুমকি-ধামকি প্রদর্শন করে। পরে শালিস দরবার করে তালা খুলে দেয়া হবে বলে জানায়। তাই সুবিচারের আশায় ২৮ জুলাই বাড়ি ফিরে মুন্নি বেগম তার মেয়েকে সাথে নিয়ে কাউন্সিলরের বাসায় যান। কি কারণে তালা ঝুলানো হয়েছে জানতে চান। এসময় কাউন্সিলর রুমকি তার মা শহরের বাদুড়তলা এলাকার জামিলুর রহমান রুনুর স্ত্রী রুমি বেগম (৪৫) ও ছোট বোন চকসুত্রাপুরের তুফান সরকারের স্ত্রী আশা কাউন্সিলরের বাসাতেই ছিলেন । পরে মোবাইলেরর মাধ্যমে দিপু, আতিক , মুন্না , রূপম সহ কয়েকজনকে ডাক দেয় কাউন্সিলর রুমকি। কাউন্সিলর কোন শালিস দরবার না করেই মুন্নি ও তার মেয়ে সোনালীকে অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করেন। কাউন্সিলর রুমকি নিজে তার মা ও বোনকে সাথে নিয়ে মুন্না নামের যুবকের সহায়তায় মা মেয়ের চুল কেটে ফেলে। পরে নাপিত ডেকে এনে দুইজনের মাথা ন্যাড়া করে দেয় ।এরপর তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে মা-মেয়েকে বগুড়া ত্যাগে এসিড মারার হুমকিও দেয় নারী কাউন্সিলর ও তার মা-বোন সহ অন্যরা।

আহত সোনালীকে শুক্রবার রাতেই শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে বিষয়টি থানা পুলিশকে জানালে থানা এবং গোয়েন্দা পুলিশের যৌথ টিম অভিযান চালিয়ে ৪ জনকে গ্রেফতার করে । তবে কাউন্সিলর রুমকি তার মা ও বোনকে নিয়ে গা ঢাকা দেয়। শনিবার নির্যাতিতা ছাত্রীর মা বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন।

মামলায় গ্রেফতার হওয়া আসামিরা হলো শহর শ্রমিকলীগের আহবায়ক শহরের চকসুত্রাপুরের মজিবর সরকারের ছেলে তুফান সরকার (২৮), একই এলাকার দুলু আকন্দের ছেলে আলী আজম দিপু (২৫), খান্দার সোনারপাড়ার মোখলেসার রহমানের ছেলে আতিক (২৫) ও কালিতলার জহুরুল হকের ছেলে রুপম (২৪)।

নির্যাতিতার বক্তব্য
শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের ভর্তি নির্যাতনের শিকার ওই ছাত্রী জানান, ‘সে এ বছর এসএসসি পাস করেছে। ফল ভালো না হওয়ায় কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়ে চিন্তিত ছিল। এক পর্যায়ে তুফান ও দিপু তাকে বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে ভর্তি করে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। সে তাদেরকে কাগজপত্র ও ৪ হাজার টাকা দেয়। গত ১৭ জুলাই তুফান তাকে ভর্তির কাগজপত্রে স্বাক্ষর দেওয়ার নামে তার চকসূত্রাপুরের বাড়িতে ডেকে পাঠায়। যেতে না চাইলে তাকে চালক জিতুকে দিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে বাড়িতে নেওয়া হয়। স্ত্রী আশা খাতুন বাড়িতে না থাকায় তুফান ধর্ষণ করে। এ সময় তার সহযোগী মুন্না, জিতু ও আতিক পাহারা দেয়। এরপর বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বা অন্য কাউকে জানালে বাড়িতে ককটেল মারার হুমকি দেয়।’ লোকলজ্জা ও সন্ত্রাসীদের ভয়ে তাৎক্ষণিক ভাবে ধর্ষণের কথা কাউকে বলতে পারেনি বলেও জানায় সে।

তদন্ত কর্মকর্তা বলছেন
এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বগুড়া সদর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) আবুল কালাম আজাদ জানান, গ্রেফতার হওয়া ৪ আসামীর মধ্যে আতিক আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছে। শনিবার বিকেলে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আল-মামুন এই জবানবন্দি গ্রহণ করেন। ধর্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে আজ (রবিবার) ভিকটিমের ডাক্তারি (মেডিকেল টেস্ট) পরীক্ষা করানো হবে ।

পুলিশ যা বলেন
বগুড়া সদর থানার ওসি এমদাদ হোসেন জানান, ‘শনিবার দুপুরে কিশোরীর মা সদর থানায় তুফান, তার আত্মীয় সংরক্ষিত আসনের স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মার্জিয়া হাসান রুমকি, তারমা রুমি বেগম, তুফানের স্ত্রী আশাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে অপহরণ, ধর্ষণ ও অন্যান্য ধারায় মামলা করেছেন। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে একজন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও প্রদান করেছে। পরে তাদের আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।’ ওসি এমদাদ হোসেন আরও জানান, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নির্যাতিত মা-মেয়ের নিরাপত্তায় দুইজন পুরুষ ও দুইজন নারী কনস্টেবল মোতায়েন করা হয়েছে।

বগুড়া সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সনাতন চক্রবর্তী জানান, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তুফান ওই ছাত্রীকে ধর্ষণ ও অন্যরা সহযোগিতার কথা স্বীকার করেছে। তুফানের বিরুদ্ধে মাদক আইনের মামলা বিচারাধীন রয়েছে।’ খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে, তুফানরা মোট সাত ভাই। ক্ষমতা প্রদর্শনে ত্রাস হিসেবে এলাকা শাসন চালায় তারা। মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজির মতো অপরাধের পরও স্থানীয়রা তাদের ভয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরও বলেন , ‘যতই প্রভাবশালী হোক কাউন্সিলর রুমকিসহ অন্য আসামিদের গ্রেফতার করা হবে। পুলিশ তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছে।’ সূত্র: ইত্তেফাক


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ