আওয়ার ইসলাম : দেশের ঐতিহ্যবাহী ইসলামি রাজনৈতিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশে আবারও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। অস্থিরতার ফলে আবারও সামনে এসেছে দলের মহাসচিব আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী ও নির্বাহী সভাপতি মুফতী মুহাম্মদ ওয়াক্কাসের বিভক্তি। এতে দলের অখণ্ডতাও হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে আশংকা করছেন সাধারণ নেতা-কর্মীদের অনেকে।
জমিয়তের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ অস্থিরতার মূলে রয়েছে দলে বহিরাগতদের পদায়ন। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৪ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা আবদুর রব ইউসুফী ও মাওলানা তাফাজ্জুল হক আজিজ এবং ইসলামী ঐক্যজোটের মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীবসহ একদল নবীন ও প্রবীণ ইসলামি রাজনৈতিক নেতা জমিয়তে যোগদান করেন এবং তাদের বিভিন্ন পদে পদায়ন করা হয়। সে সময় জেলে ছিলেন তৎকালীন মহাসচিব মুফতী মুহাম্মদ ওয়াক্কাস। তার অনুপস্থিতিতে এ পদায়নে ক্ষুব্ধ হন তিনি।
মুফতী ওয়াক্কাস জেল থেকে বের হয়ে প্রস্তাব দেন পরবর্তী কাউন্সিলের পূর্ব পর্যন্ত তাদেরকে সাংগঠনিক পদ প্রদান না করে অনারারি (সম্মানসূচক) পদ দেয়া হোক। কিন্তু তাতে রাজি হননি আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী। এভাবেই জমিয়তে মুফতী ওয়াক্কাস ও আল্লামা হোসাইন কাসেমী দ্বন্ধের সূচনা হয়। তাতে ইন্ধন যোগায় উভয় পক্ষের কিছু উৎসাহী নেতা। সুযোগ সন্ধানী এসব নেতারা ক্রমন্বয়ে দলের শীর্ষ দুই নেতাকে মুখোমুখি দাঁড় করায়। ফলে তাদের মধ্যেও বাড়তে থাকে তিক্ততা।
তাবলিগের ব্যাপারে চার সিদ্ধান্ত; শীর্ষ আলেমদের বৈঠক
এ তিক্ততার মধ্যেই ৭ নভেম্বর ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত হয় জমিয়তের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল। কাউন্সিল সামনে রেখে উভয় পক্ষ নিজ নিজ বেল্টের লোকদের পদায়নে তৎপর হয়ে ওঠে। তবে শেষ পর্যন্ত আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমীর অনুসারীগণ কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়। কাঙ্ক্ষিত হারে পদ না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয় মুফতী ওয়াক্কাস অনুসারী নেতারা। তারা নবাগতদের পদায়ন এবং দলের পুরাতন নেতা-কর্মীদের (মুফতী ওয়াক্কাস অনুসারী) বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ আনেন। দাবি করেন, পূর্বের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে ২২ জন (মুফতী ওয়াক্কাস অনুসারী) কে ২৮ জন নবাগতকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
এ কাউন্সিলে মুফতী ওয়াক্কাসকে মহাসচিব পদ থেকে নির্বাহী সভাপতি করা হয় এবং সিনিয়র সহ-সভাপতি আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমীকে মহাসচিব করা হয়।
আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত জমিয়তের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা ওবায়দুল্লাহ এ অভিযোগের ব্যাখ্যায় বলেন, আমরা চেষ্টা করেছি নবাগত নেতারা নিজ দলে যে যেমন পদে ছিলো তেমন পদে তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে। তাদের তৃণমূলের কোনো নেতাকে তো আমরা টেনে তুলি নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রত্যেক কাউন্সিলে কিছু নেতা পূর্বের কমিটি থেকে বাদ যায়। বিশেষত তারা কারণ দর্শানো ব্যতীত নির্বাহী কমিটির একাধিক বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন।’
এর কিছুদিন পর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী জমিয়তের মহানগর কমিটি বাতিল করলে তা অগঠনতান্ত্রিক বলে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠান মুফতী ওয়াক্কাস। এর ফলে দুই নেতার দ্বন্ধের বিষয়টি প্রকাশ্য রূপ নেয়।
গত ২২ জুলাই রাজধানীর একটি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় জমিয়তের সর্বশেষ বার্ষিক কাউন্সিল। মুফতী ওয়াক্কাস ও তার অনুসারীদের অনুপস্থিতিতেই এ কাউন্সিলে দলের নির্বাহী সভাপতি পদ বিলুপ্ত করা হয়। মুফতী ওয়াক্কাসের অনুসারী নেতা-কর্মীগণ মনে করছেন, দলে মুফতী ওয়াক্কাসের প্রভাব-প্রতিপত্তি খর্ব করতেই এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এ নিয়ে উভয়পক্ষের উত্তেজনা এখন চরমে।
এ ব্যাপারে মুফতী ওয়াক্কাসের মতামত জানতে চাইলে তিনি আওয়ার ইসলামকে বলেন, ‘কিছু মানুষ অসাংবিধানিক ও অসাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় নির্বাহী পদ বিলুপ্ত করেছেন। কাউন্সিলের মাধ্যমে আমাকে তিন বছরের নির্বাহী সভাপতি করা হয়েছে। আমাকে বাদ দেয়ার সাংগঠনিক এখতিয়ার তাদের নেই।’
তিনি কেনো এ প্রক্রিয়াকে অসাংবিধানিক বলছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘গুটি কয়েক লোক নিয়ে এ কাউন্সিল করা হয়েছে। কাউন্সিল উপলক্ষ্যে চিঠি পর্যন্ত ইস্যু করা হয় নি। অধিকাংশ কাউন্সিলর এ সম্পর্কে জানে না।’
দলীয় সংবিধান পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় দুই তৃয়াংশ কাউন্সিলরও উপস্থিত ছিলো না বলে তিনি দাবি করেন।
এখন কি করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি ঢাকা ফিরে দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলবো। তারা কি বলে তা জেনে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিবো।’
নবাগতদের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘আমি সাংগঠনিক মেজাজের মানুষ। যারা আমার বিরোধিতা করছে তাদের অনেকেই নবাগত। তারা সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে বিভিন্ন কাজ করতে চায়।’
দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট শাহীনূর পাশাকে প্রশ্ন করেছিলাম হঠাৎ করেই কেনো নির্বাহী সভাপতি পদটি বিলুপ্ত করতে হলো? তিনি বলেন, ‘নির্বাহী সভাপতি পদটি পূর্বে দলে ছিলো না। দলের প্রয়োজনে তা সৃষ্টি করা হয়। দীর্ঘদিন সংবিধানের উপর কোনো কাজ করা হয় নি। এবার যখন করা হলোে আমাদের মনে হয়েছে এ পদটি রাখার প্রয়োজন নেই।’
একই প্রশ্নের উত্তরে মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক বলেন, ‘পূর্বে আমাদের মহাসচিব ও সভাপতি উভয়ে ঢাকার বাইরে ছিলেন। তাই একজন সহ-সভাপতিকে নির্বাহী করার প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু এখন মহাসচিব ঢাকায় অবস্থান করায় এ প্রয়োজন নেই।’
অ্যাডভোকেট শাহীনূর পাশা আরও বলেন, ‘আমি সংশোধন বিষয়ক মিটিংয়ে ছিলাম। তখন সিদ্ধান্ত হয় সংবিধান থেকে নির্বাহী সভাপতি পদটি রহিত করা হলেও মুফতী মুহাম্মদ ওয়াক্কাস দলের নির্বাহী সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন আগামী কাউন্সিলের পূর্ব পর্যন্ত। আমি মনে করি, তিনি তার পদে বহাল আছেন।’
মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ফারুকও বলেন, ‘মুফতী ওয়াক্কাস এখনো নির্বাহী সভাপতি পদে বহাল আছেন। আগামী আমেলা তার পদ রহিত না করলে তিনি আপন পদে বহাল থাকবেন।’
নবাগতদের পদায়নের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শাহীনূর পাশা বলেন, ‘মুফতী ওয়াক্কাস জমিয়তের দীর্ঘদিনের মহাসচিব। দলে যারা আছে সবাই তার কর্মী। এ প্রশ্ন কেনো আসবে যে কে কোন গ্রুপের। কাকে মূল্যায়ন করা হয়েছে, কাকে অবমূল্যায়ন করা হলো?’
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘তৃণমূলের কর্মীরা প্রশ্ন তুলতে পারে কে কতো দিন জমিয়ত করে, কে নবাগত বা বহিরাগত। কিন্তু একজন সিনিয়র নেতা এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করবেন কেনো? যে যেখান থেকেই আসুক সবাইকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী পদায়ন করা হয়েছে।’
এ সময় তিনি নবাগতদের পদায়ন যথাযথ হয়েছে বলেই মন্তব্য করেন।
তবে পদপ্রাপ্ত কয়েকজনের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘পদ পেয়ে কেউ যদি সীমা ছাড়িয়ে যেতে চান, সাংগঠনিক কাঠামো অমান্য করেন সেটা তার সমস্যা। যারা তাকে মনোনীত করলো তাদের সমস্যা না। কেননা তারা তার যোগ্যতার বিচার করেই পদ দিয়েছিলেন।’
অ্যাডভোকেট শাহীনূর পাশা স্বীকার করেন, ‘কাউন্সিলের প্রচার-প্রচারণায় ত্রুটি ছিলো। সবাই ঠিক মতো দাওয়াত পায় নি। এ ব্যাপারে তিনি নিজেও অভিযোগ পেয়েছেন।’
কাউন্সিলের উপস্থিতির ব্যাপারে তার বক্তব্য হলো, ‘আমি রেজিস্টার খাতা দেখি নি। তবে জেলাভিত্তিক বক্তাদের যে তালিকা ছিলো তা খুবই কম ছিলো। হল ভর্তি লোক ছিলো কিন্তু সবাই তো কাউন্সিলর ছিলো না।’
সবশেষে তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম দলের অখণ্ডতার প্রশ্ন আসলে তারা কি করবেন? উত্তরে বলেন, ‘আমাদের দল শত বছরের প্রাচীন দল। এমন বহু চড়াই-উৎড়াই পার হয়েই এ পর্যন্ত আসতে হয়েছে। আমি মনে করি না দলের অখণ্ডতা নষ্ট হবে। দলের সর্বোচ্চ অভিভাবক ও মুরব্বিদের হস্তক্ষেপে দলে সৃষ্ট অস্থিরতা দূর হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদি কেউ এগিয়ে না আসে আমি ব্যক্তিগতভাবে ভাঙ্গণ রোধের চেষ্টা করবো। আমার সর্বস্ব দিয়েই চেষ্টা করবো।’
মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ফারুকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, মুফতী ওয়াক্কাসের মান অভিমান আপনারা প্রস্তুত আছেন কী? উত্তরে তিনি বলেন, ‘মুফতী সাহেব এখনো কিছু বলেন নি। যদি আমরা মনে করি তার মনে কষ্ট আছে তাহলে অবশ্যই তার সঙ্গে দেখা করবো। তবে আমরা তাকে যতোটুকু চিনি তিনি দল ভাঙ্গার মানসিকতা রাখেন না।’